Skip to main content

করোনা বয়ে এনেছে মানুষের জন্য হেদায়াত

মানুষ গোমরাহীর মধ্যে ডুবে থাকবে এবং দেশে দেশে চলবে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন ও বয়ে চলবে নানাবিধ পাপাচার তা আল্লাহপাকের কাম্য নয়। তাইতো গোমরাহীর চরম পর্যায়ে মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য তিনি যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রসুল পাঠিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে নবুয়তের ধারা সমাপ্ত করে তাঁর কাছে প্রেরিত শিক্ষা কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত করে রেখেছেন। পৃথিবীতে কোনো ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত নেই বা সেটি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও আল্লাহ রাখেননি। অতীতে যে সব ভাষায় কিতাব নাযিল হয়েছে তা সবই মৃত, কোনো ধর্মগ্রন্থের হাফেজ নেই বা সেই সব ভাষায় কেউ কথাও বলে না। অথচ কুরআন জীবন্ত। সূচনালগ্ন থেকে অসংখ্য হাফেজে কুরআন মুখস্ত করে রাখার সাথে ঘরে ঘরে কুরআন রয়েছে এবং সকল ভাষায় কুরআন অনূদিত হয়ে এর শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে। কুরআনের ভাষা আল্লাহপাক সহজ করে দিয়েছেন। মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও একজন অশিক্ষিত মানুষও মাত্র এক মাসের চেষ্টায় কুরআন তেলাওয়াত (Reading) করতে সক্ষম হয়। এটি কুরআনের এক অলৌকিক মুজেজা। আর কুরআনের মত বিশাল একটি গ্রন্থ ২/১ জন নয় লক্ষ লক্ষ আল্লাহর বান্দার মুখস্ত রাখা প্রমাণ করে এটি সাধারণ কোনো কিতাব নয়, এটি মহাপরাক্রমশালী ও সুবিজ্ঞ-বিজ্ঞানী মহান আল্লাহপাকের নাযিলকৃত কিতাব। বাংলা ভাষায় লেখা মাত্র ২০০ বছর পূর্বের যে কোনো কিতাব সংস্করণ ছাড়া পাঠ সম্ভব নয়। অথচ এই কুরআন প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে কোনো সংস্করণ,পরিমার্জন ছাড়াই যুগের পর যুগ মানুষ তেলাওয়াত করছে এবং মর্ম উপলব্ধি করছে। কুরআনের সূচনায় দ্ব্যর্থহীনভাবে এর প্রেরক জানিয়ে দিয়েছেন, এটি আল্লাহর কিতাব এতে কোনো সন্দেহ নেই, আবার এ অর্থও প্রকাশ পায়, এর মধ্যে সন্দেহপূর্ণ কোনো কথা নেই, নির্ভুল জীবন যাপনের বিধান। কুরআন মানবজাতির জন্য হেদায়াত। নির্ভুল জ্ঞানের উৎস, এই কুরআন আমাদের সম্মুখে অনেক ঐতিহাসিক বিষয়াবলী তুলে ধরেছে। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু সে সব সময় চেষ্টা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। শত্রু হওয়া সত্ত্বেও মানুষ শয়তানকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সমাজে আল্লাহর নাফরমানি করেছে এবং বিপর্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীকে মানুষের বসবাস অযোগ্য করে তুলেছে। মানুষ যাতে পাপাচার থেকে ফিরে আসে সেজন্য নবী-রসুল প্রেরণের পাশাপাশি নানাবিধ বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করেছেন। স্বৈরশাসক ও তাদের অনুগামীরা নিকট থেকে নবী-রসুলদের দেখেছেন এবং নানা মুজিজা অবলোকন করার পরও আল্লাহর পথে ফিরে আসেনি। যাদুমন্ত্রের যুগে মুসা (আ)-এর লাঠির মুজেজা দেখে যাদুকররা ঈমান আনলেও ফিরাউনের পক্ষে সম্ভব হয়নি বরং ঈমান আনয়নকারী যাদুকরদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।ছোটখাটো বিপদাপদ, যেমন-উকুন, বেঙ, রক্ত নানাবিধ উপদ্রব তাদেরকে নাজেহাল করলে বিপদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তারা মুসা (আ)-এর কাছে যেত এবং মুসা (আ)-এর দুআর বরকতে মুক্তি পেলেও তারা নাফরমানি ত্যাগ করেনি। হত্যার উদ্দেশ্যে নমরুদ হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করে। কিন্তু সেই আগুন তাকে স্পর্শ করে না। এত কিছু দেখার পরও নমরুদ ও ইব্রাহিম (আ)-এর পিতার সৌভাগ্য হলো না ঈমান আনার। ভয়াবহ বন্যা হযরত নুহ (আ) ও তাঁর নৌকার আরোহীদের ছাড়া সবাইকে ভাসিয়ে দিলে আপন সন্তান বিশ্বাস না করে উঁচু পাহাড়ে উঠে প্রাণে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। হযরত লুত (আ)-এর স্ত্রী তার স্বামীকে বিশ্বাস না করে পেছনে পড়ে থাকা লোকদের দলভুক্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। একজন নবীকে তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও পিতা যত নিকট থেকে দেখে ও জানে অন্য কারোর পক্ষে তা সম্ভব নয়। তারপরও তাদের নছিবে হেদায়াত নেই। মুহাম্মদ (সা)-এর সাথেও তাঁর জাতি একই আচরণ করেছে। ইসলামের দাওয়াত দানের সাথে সাথে আল-আমিন ও আস-সাদিক খ্যাত মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে তাঁর জাতির লোকেরা শত্রুতা শুরু করে। একজন নিরক্ষর ব্যক্তি তাদের মাঝে কুরআনের মত বিস্ময়কর বাণী পেশ করলেও তারা ঈমান আনেনি। এমন কি আপন চাচাও প্রচন্ড বিরোধীতায় নেমে পড়ে। ঢাল হিসেবে যে চাচা আজীবন ভাতিজাকে আগলে রাখেন তাঁর পক্ষেও হেদায়াত নসিব হয় না। মুহাম্মদ (সা) শেষ নবী হওয়ায় আর কোনো নবী আসবে না। মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব আল কুরআন এবং তাঁর জীবনাদর্শ (বাণী ও কার্যক্রম) অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু মানুষ নবী-রসুলদের শিক্ষা প্রায়ই উপেক্ষা করে চলে এবং তারা যখন নাফরমানির চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন আল্লাহ তাদের ওপর নানাবিধ বিপদাপদ প্রদান করেন। তাঁর ভাষায় এটি আমাদের হাতের কামাই। ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, মহামারি নানাবিধ উপায়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। বিপদাপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসে না বা কেউ চাপিয়েও দেয় না। সবই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহ তাঁর অনেক বান্দাকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসেন। এবারের মহামারি করোনা সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। নানা জনে নানা ব্যাখ্যা প্রদান করলেও বিশ্বাসীরা মনে করে এই বিপদ তাদের রবের পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আমার ধারণা, যাদের ঈমান দুর্বল ছিল এবং নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছিল, এই করোনা তাদেরকে তাওবা করে ফিরে আসার একটি পথ বাতলে দিয়েছে। এটি আল্লাহতায়ালার এক বড় অনুগ্রহ। মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত, মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। প্রতিনিয়ত মানুষ মৃত্যু দেখছে। দুর্ঘটনা ও নানা রোগ-ব্যাধিতে মারা যাচ্ছে। কিন্তু করোনাভীতি সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। মুখে সাহসের কথা বললেও করোনা আতঙ্কে সবাই কাতর হয়ে আছে। এই করোনা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধোন্মাদনা হ্রাস করেছে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পৃথিবী হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হত। আল্লাহপাক হেফাজত করেছেন। দেশে দেশে বর্ণবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং কট্টোর জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসীন হয়ে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আঘাত হেনেছে এবং অনেক স্থানে বর্ণবাদী নেতৃবৃন্দের মূর্তি উপড়ে ফেলেছে। বর্ণবাদ বলতে শুধু গায়ের রঙ নয় মানুষের বিশ্বাস ও রাজনীতিসহ সবধরনের বৈষম্যকেই বোঝায়। আজকে পত্রিকায় লক্ষ্য করলাম, ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ হিসেবে ইতালীর কারাগারগুলোয় জামাতে নামায ও ইমাম নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ সবই ইতিবাচক দিক। আমি হেদায়াত বা সুপথপ্রাপ্তি বলতে সব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাবে এমনটি আশা করি না। আমি চাই এমন একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ যেখানে সবাই তাদের বিশ্বাস, মানবিক অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবে। জোর করে ঈমান আনায়ন ইসলামস্বীকৃত নয়। ঈমান আনয়নের বিষয়টি একান্তই আল্লাহর। আখিরাতে জান্নাতপ্রাপ্তি নির্ভর করে বিশ্বাস ও নেক আমলের ওপর। নেক আমলের ধারণাটি সকল ধর্মে প্রায় একই এবং সেটি বিবেকসম্মত। যেমন, মানুষকে হত্যা করা, গালি দেয়া, কষ্ট দেয়া, মিথ্যা বলা, ধোকা-প্রতারণা করা, ওজনে কম-বেশি ও ভেজাল দেয়া এবং ঘুষ-দুর্নীতিসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজের প্রতি মানবপ্রকৃতিতে রয়েছে ঘৃণা এবং ইসলাম এ সবকে হারাম ঘোষণা করেছে। প্রকৃতির ধর্ম ইসলামে মানবতার জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের আচরণ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং কবীরা গুনাহ। দুর্ভাগ্য, পরকালে বিশ্বাসীদের একটি বড় অংশ এ সব পাপাচারের সাথে জড়িত। এই করোনা আমাদের দেখিয়ে দিল, অঢেল ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি বা সন্তান-সন্ততি কোনো কিছুই খুব একটি কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং মানুষের ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি নিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করতে হয়। অনেক সময় জোর করে শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে দেখা যায়। সমাজে কেউ মারা গেলে সেই সমাজের নেক বান্দারা যখন স্বতস্ফুর্তভাবে দুআ করে এবং ভালো সার্টিফাই করে এমন লোকদেরকে জান্নাতি বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস, করোনা মানুষের মধ্যে পরকাল চিন্তার প্রসার ঘটাবে এবং অন্যায়-অবিচার থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে আনবে। এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার একটি সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এতে তো আর গুনাহ মাফ হবে না বরং অনৈতিক উপার্জনকে বৈধতা দেয়া হলো। প্রয়োজন ছিল, অবৈধ উপার্জনকারীরা হারাম উপায়ে উপার্জিত তাদের সকল সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে আল্লাহ ও জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের পথ অবলম্বন করবে। কারো মধ্যে যদি পরকালবিশ্বাস জাগ্রত হয় তাহলে এমনটি করা তার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। আল্লাহপাক তাওবাকারীকে পছন্দ করেন এবং তাওবা বলতে এমনটিকেই বোঝায়। তাওবা অর্থ সকাল-সন্ধ্যায় হাজারবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ার নাম নয় বরং তাওবা অর্থ মুখে উচ্চারণের (স্বীকৃতি) পাশাপাশি গুনাহ থেকে ফিরে আসা। আমি বলতে চেয়েছি, এই করোনা বিশ্বব্যাপী একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে এবং তা অনেকখানি দৃশ্যমান। সাথে মুসলমানদের আমলে ও চরিত্রেও পরিবর্তন আসবে। দেশে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ও শত্রুতা হ্রাস পাবে এবং ইসলামের দাওয়াত দানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। যাদের মাঝে পরিবর্তন আসবে তারা বড়ই ভাগ্যবান এবং এই পরিবর্তনসহ যারা করোনায় মারা যাবে তারাও ভাগ্যবান। এরা শহীদের মর্যাদা নিয়ে আল্লাহর দরবারে উত্থিত হবে। আর যারা নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হবে তারা সত্যিই দুর্ভাগা যেমন দুর্ভাগা ছিল নমরুদ, ফিরাউন, কানুন, শাদ্দাদ, আবু জেহেল-আবু লাহাব, আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তাদের অনুসারীরা। আল্লাহপাক আমাদেরকে সব ধরনের পাপাচার পরিহার করে নির্ভেজাল ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার তাওফিক দান করুন। ১৪.০৬.২০১৬

Comments