Skip to main content

প্রিয়তম নবী (সা)-এর মিশন

প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ফেরেশতাদের কাছে তাঁর পরিকল্পনা পেশ করেন। আল্লাহর বর্ণনাটি এমন, ‘যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা বানাতে চাই; তারা বললো, তুমি কি সেখানে এমন কাউকে খলিফা বানাতে চাও যে সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে, আমরাই তো তোমার প্রশংসা সহকারে তাসবিহ পড়ছি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি; তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না’- সূরা বাকারা ৩০। এখানে মানুষের সাথে অন্যান্য সৃষ্টির পার্থক্য উপলব্ধি করা যায়। সকল সৃষ্টির ধর্ম ইসলাম এবং তারা আল্লাহর দেয়া নিয়মের অধীন ও সর্বক্ষণ তাঁরই প্রশংসা করছে। খলিফা (প্রতিনিধি) শব্দ থেকে বোঝা যায় মানুষের স্বাধীন সত্তা রয়েছে এবং আল্লাহর হুকুম মানা ও অমান্য করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে। আবার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবাই যাতে মানে তেমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করাও তার দায়িত্ব। আল্লাহপাক আদম (আ)-কে মাটি থেকে সৃষ্টি করে নিজের পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দেন এবং সকল সৃষ্টির মাঝে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা সর্বোচ্চ প্রমাণ করার লক্ষ্যে ফেরেশতাদেরকে সেজদা করার নির্দেশ দেন। ইবলিস ছাড়া সকলেই সেজদা করেন। আল্লাহর আদেশ অমান্য করে ইবলিস অভিশপ্ত ও ঘৃণিত হয়। আদম (আ)-এর সঙ্গী হিসেবে তিনি মা হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করেন। তাঁর ভাষায়, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের একটি প্রাণ থেকে পয়দা করেছেন এবং তার থেকে তিনি তার জুড়ি বানিয়েছেন, যেন তার কাছে সে পরম শান্তি লাভ করতে পারে (সূরা আরাফ ১৮৯)। আদম (আ)-এর মাধ্যমে মানবসৃষ্টির সূচনা; তিনিই প্রথম মানুষ এবং আমরা তাঁরই সন্তান। মানুষের আদিবাস জান্নাত। বাবা আদম (আ) ও মা হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাতে রেখে স্বাধীনভাবে চলার অনুমতি প্রদানের সাথে সাথে একটি গাছের নিকটে না যাওয়ার নির্দেশ দান করেন এবং সতর্ক করেন এই বলে, সেখানে গেলেই তোমরা জালেমে পরিণত হবে। ইবলিস প্রকাশ্য দুশমন এ কথা বলেও তাঁদেরকে সতর্ক করা হয়। শয়তান তাঁদের কল্যাণকামী সেজে প্ররোচিত করে এবং এক পর্যায়ে সেই গাছের ফল ভক্ষণ করায়। কুরআন বলে, শয়তান উভয়কেই প্ররোচিত করে; হাওয়া (আ)-কে আগে এবং তাঁর কারণে আদম (আ) ফল ভক্ষণ করেন, এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। গাছের নিকটে যাওয়ায় বা ফল ভক্ষণ করায় তাঁদের শরীর থেকে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে যায়। তাঁরা জান্নাতের লতা-পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করার চেষ্টা করেন। শয়তানের বড় অস্ত্র মানুষের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়া। নগ্নতা, পর্দাহীনতা, বেয়াহাপনায় যারা ঝুঁকে পড়ে মূলত তারা শয়তানেরই দাসত্ব করে এবং নগ্নতা তাদের কাছে লোভনীয় হিসেবে ধরা দেয়। পরিধেয় বস্ত্র খুলে পড়লে আল্লাহপাক আদম ও হাওয়াকে বেহেশত থেকে চলে আসার নির্দেশ দেন। তখন তাঁরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং কিভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন সে ভাষা তাঁদের জানা ছিল না। আল্লাহপাক দয়া পরপরবশ হয়ে তাঁদেরকে ভাষা শিখিয়ে দেন এবং তাঁরা দুআ করেন। আল্লাহর ভাষায়, ‘অতপর তারা দু’জনেই বলে উঠলো, হে আমাদের রব, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, যদি তুমি আমাদের মাফ না করো এবং আমাদের ওপর দয়া না করো তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো’- সূরা আ’রাফ ২৩। অনেকে প্রচার করেন, সে সময়ে আদম (আ) ও হাওয়া (আ) আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন আল্লাহপাকের নামের সাথে মুহাম্মদ (সা)-এর নাম জড়িয়ে আছে এবং সেই নামের অসিলা করে তাঁরা আল্লাহর কাছে দুআ করেন। ফলে তাঁরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। ক্ষমা করার পর আল্লাহপাক আদম (আ) ও হাওয়া (আ) এবং ইবলিসকে পৃথিবীতে চলে আসার নির্দেশ দেন এবং বলেন, শয়তান ও তোমরা পরস্পরের দুশমন। সে সময়ে তাঁদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয় বাণী শোনানো হয়, ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই, কোনো দুঃখ-বেদনাও নেই’- সূরা বাকারা ৩৮। আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসূল তিনি পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ নবী হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)। মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে এবং অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারে পৃথিবী যখন পূর্ণ হয়ে ওঠে তখনই আল্লাহ সেই সমাজে নবী পাঠান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আরবের মক্কানগরীতে মহানবী (সা)-এর আগমনকালটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অধপতিত, যা ইতিহাসে আইয়ামে জাহিলিয়াত বলে পরিচিত। সেই পাপ-পঙ্কিল সমাজে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন ব্যতিক্রম। এক অনুপম চরিত্রের অধিকারী, যাঁর সততা ও বিশ্বস্ততার কারণে তিনি তাঁর জাতির কাছ থেকে উপাধী পেয়েছিলেন আল-আমিন, আস-সাদিক। দীর্ঘ ৪০টি বছর তাঁর সমাজে তিনি একজন ভদ্র ও শরীফ মানুষ হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। কখনো তিনি নিজেকে নবী দাবী করেননি বা তিনি যে একজন নবী তা জানতেনও না। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর তিনি তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত হন। সূরা আলাকের পাঁচটি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে তাঁর নবুয়তের সূচনা হয় এবং কিছুদিন বিরতির পর আল মুদ্দাস্সিরের ৭টি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করার নির্দেশ পান। সেই সমাজে দাসপ্রথা ছিল, ছিল নারী সমাজের সমস্যা ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যসহ হাজারো সমস্যা। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি উদাত্তকণ্ঠে আহবান জানান, হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা বলো আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে। এটি শুধু তাঁর আহবান নয়, সকল নবী-রসূলের একই আহবান ছিল। নবী-রসূল কেউ তাঁদের ব্যক্তিসত্তার দিকে আহবান জানাননি, আহবান জানিয়েছেন আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মহানত্ব ও সার্বভৌমত্বের দিকে। পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী নবী-রসূলদের এই সহজ আহবান কেউ গ্রহণ করতে পারেনি। আল্লাহপাক সকল নবী-রসূলকে সমসাময়িক স্বৈরশাসকদের মোকাবেলায় দাঁড় করিয়েছেন। কারণ কালিমা তাইয়্যেবা শুধু ধর্মীয় বাণী নয়, ছিল সমাজ পরিবর্তনের এক বৈপ্লবিক ঘোষণা। শাসক ও শোষক শ্রেণি নিজেদের কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে একযোগে তাঁদের বিরোধীতা করে। মক্কায় সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে যাঁরা আল্লাহর রসূল (সা)-এর দাওয়াতে সাড়া দেন প্রতিকূল পরিবেশে তাঁরাই খাঁটি সোনায় পরিণত হন। আবিসিনিয়ায় হিজরত, সামাজিক বয়কট এবং এক পর্যায়ে রসূল (সা) ও তাঁর সাথীরা মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ১৩টি বছরে তৈরী হয় একদল ত্যাগী, যোগ্য ও আল্লাহভীরু নেতা যাঁরা মদীনায় একটি ইসলামী সমাজ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হন। মক্কায় প্রস্তুত নেতৃবৃন্দ ও মদীনার অনুকূল পরিবেশে সেখানে গঠিত হয় এক ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র এবং সেই নবগঠিত রাষ্ট্রে মুহাম্মদ (সা) হন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, প্রধান সেনানায়ক, প্রধান বিচারপতি, এককথায় তিনিই সব। আল্লাহপাক তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-কে পাঠিয়েছেন তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। এ কথাটি তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মজিদে তিন জায়গায় সূরা তাওবা (৩৩ নং), সূরা ফাতাহ্ (২৮ নং) ও সূরা সফে (৯ নং) উল্লেখ করেছেন। ‘তিনি আপন রসূলকে হেদায়াত ও সঠিক জীবনব্যবস্থা (দ্বীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক না কেন’- সূরা সফ ৯)। আল্লাহপাক মুহাম্মদ (সা)-কে পাঠিয়েছেন রসূল হিসেবে এবং কালিমা তাইয়্যেবার মাধ্যমে আমরা সেই স্বীকৃতিই দিয়ে থাকি। রসূল (সা)-এর ওপর ঈমান আনার অর্থই হলো তাঁর আনুগত্য করা, অনুসরণ করা, তাঁর প্রতি মুহাব্বত পোষণ করা। সাহাবায়ে কেরামের কী কাজ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমার যে কাজ তোমাদেরও তাই। দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাফিরদের মোকাবেলার মধ্য দিয়ে রসূল (সা)-এর সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে। সূরা সফের পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে তাঁর পথে জিহাদ করার জন্য বলেছেন এবং যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল করার স্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। কারা আল্লাহর প্রিয়ভাজন সে প্রসঙ্গে তিনি এই সূরার ৪র্থ আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই ভালোবাসেন যারা সীসাঢালা প্রাচীরের মত কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে’-সূরা সফ ৪। আল্লাহপাক মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, আর যারা কুফুরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে, তোমরা শযতানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, আর বিশ্বাস করো শযতানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’-সূরা আন নেসা ৭৬। একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবী করবে আর সে তাগুতের সহযোগী হবে এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করবে এটি স্বাভাবিক নয়। এমনটি হলে সে বর্ণচোরা, নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নন। কুরআন তাদেরকে মুসলিম স্বীকার করে না। একজন মুসলিম সেই, যে ইসলামে বিশ্বাস করে, ইসলামকে শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ হিসেবে জানে ও মানে এবং এটিকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় চালায়। আল্লাহপাক একজন মু’মিনের কাছ থেকে শুনতে চান- ‘নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, যাঁর কোনো শরীক নেই। এই নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী (মুসলিম)। একজন মুসলিমের ইবাদত যেমন আল্লাহর জন্য তেমনি তার বেঁচে থাকা ও মৃত্যুও হবে আল্লাহরই জন্য। না সে নিজের, না তার পরিবার ও সমাজের জন্য। হ্যাঁ, সে সবই করবে তার রবের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও রসূল (সা)-এর পন্থায়। দ্বীনের এই মৌলিক কাজ থেকে শয়তান আমাদেরকে বিচ্যুত করে নানা ফেরকায় নিমজ্জিত করেছে। আল্লাহপাক রসূল পাঠিয়েছেন তাঁর আনুগত্য করার জন্য। কোনো নবী-রসূল তাঁর ব্যক্তিত্বের দিকে আহবান জানাননি এবং পারেনও না। নবী-রসূলগণ মানুষকে আল্লাহর ইবাদত করার কথা বলেছেন কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের অনুসারীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা আল্লাহর সাথে তাঁদের নবী-রসূলদের গুণকীর্তন ও পূজা-উপাসনায় লিপ্ত হয়েছে যা সম্পর্কে কুরআনে তীব্রভাবে নিন্দা জানানো হয়েছে। মুহাম্মদ (সা) ছিলেন এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। মদীনায় আসার পর তিনি দু’টি উৎসবের (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) প্রচলন করেন এবং এ দু’টি উৎসব কোনোভাবেই তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। অথচ জগতবাসী পরিচিত ছিল বড় দিন (যীশু ক্রিষ্টের জন্মদিন), বুদ্ধপূর্ণিমা (গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন), জন্মাষ্টমী (শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন) পালনের সাথে। মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম মদীনাকেন্দ্রিক নগর রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বে এক বিজয়ী দ্বীনের (জীবনব্যবস্থার) পথে অগ্রসর হয় এবং এর মধ্য দিয়ে নবীর দায়িত্বও সমাপ্ত হয়। মোট ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের মধ্যে মদীনায় দশটি বছরে ইসলামের এতো বড় বিজয় এবং বিশ্বসভ্যতায় বড় অবদানে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর কোনো ক্রেডিট উল্লেখ করা হয়নি বরং সকল ক্রেডিট দেয়া হয়েছে আল্লাহকে। সূরা নসরে আল্লাহপাক সেটিই বলেছেন যখন ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলো’। সে সময়ে রসূল (সা)-কে বলা হয়, বেশি বেশি করে আল্লাহর তাসবিহ করতে ও তাঁর কাছে মাফ চাইতে। আর আল্লাহর রসূল (সা)ও সারাক্ষণ তাঁর রবের তাসবিহ পড়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কুরআন মজিদ খুললে যে শব্দটি প্রথম চোখে পড়ে তা হলো ‘আলহামদু লিল্লাহ’। প্রশংসা আল্লাহর এতোটুকু নয়, সকল প্রশংসার আল্লাহর। এ শব্দটি দ্বারা ব্যক্তিপূজা ও সৃষ্টিপূজার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ‘জয় মুহাম্মদ’, ‘মুহাম্মদ জিন্দাবাদ’ কোনো মুসলমানের শ্লোগান নয়। মুসলমানের শ্লোগান একটিই-‘আল্লাহু আকবর’। উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে একজন মুসলমানের মুখে উচ্চারিত হয় ছুবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর। শুধুই আল্লাহর গুণকীর্তন, তাঁরই প্রশংসা এবং আল্লাহরই নির্দেশক্রমে নবীর (সা) প্রতি দরুদ পাঠ। প্রশ্ন উঠতে পারে, নবী (সা)-এর প্রতি আমরা কিভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করবো। সেটিও আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা) আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, শর্তহীনভাবে নবী (সা)-এর আনুগত্য করতে হবে (আল্লাহরই হুকুম), নবী (সা)-এর নাম উচ্চারিত হলে ভক্তিভরে তাঁর প্রতি দরুদ পড়া (আল্লাহ ও তাঁর রসূলেরই নির্দেশ), যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা)-এর কথা আলোচনা হয় সেখানে মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা। যারা কুরআনের আলোচনা শোনার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে আল্লাহ তাদেরকে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এসব কাফিররা বলে, তোমরা কখনো এ কুরআন শুনবে না। আর যখন তা শুনানো হয় তখন হট্টগোল বাধিয়ে দেবে। হয়তো এভাবে তোমরা বিজয়ী হবে। আমি এসব কাফিরদের কঠিন শাস্তির মজা চাখাবো এবং যে জঘন্যতম তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে তার পুরো বদলা তাদের দেবো’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ২৬-২৭। মানবসমাজে হেদায়াতের জন্য আল্লাহ মানুষকেই রসূল হিসেবে বাছাই করেছেন। কাফির-মুশরিকরা এব্যাপারে ঘোর আপত্তি করেছে। তাদেরই মত মানুষ যে ঘর-সংসার করে, বাজার করে আবার অনেকে গরীব ও সাধারণ মানুষ তারা কেমন করে নবী-রসূল হবে, এটি ছিল তাদের এক জিজ্ঞাসা। তারা নবী-রসূলদের মধ্যে অতি মানবীয় কিছু আশা করতো। আল্লাহপাক তাদের প্রশ্নের জবাবে তারা মানুষ নন, এ কথা না বলে জোরের সাথেই বলেছেন, রসূলগণ সবাই মানুষ ছিলেন। মুহাম্মদ (সা)-কে নিয়েও মাজারপূজারী ভন্ড লোকজন তাঁর প্রতি অতি মানবীয় কিছু আরোপ করতে চায়। কখনো বলে, মুহাম্মদ (সা) নূরের তৈরী, তিনি হায়াতুন্নবি, তিনি গায়েব জানতেন, তাঁকে সৃষ্টি করা না হলে কিছুই সৃষ্টি করা হতো না, তিনি প্রথম মানুষ, যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করবে আমার শাফায়াত তার জন্য ওয়াজিব হবে, মুহাম্মদ (সা)-এর অসিলায় দুআ করায় আল্লাহ আদম ও হাওয়াকে ক্ষমা করেছেন, আবার বাড়াবাড়ি এতদূর পর্যন্ত গিয়েছে যে কেউ কেউ বলে আহাদ আহমদরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ইত্যাদি। ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তাদের নবীকে নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি করেছে মুসলমানদের মাঝেও এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত। অতি মানবীয় কিছু কল্পনা করার কারণেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের কিছু আয়াত নিম্নে উল্লেখ করা হলো। ‘হে রসূল! আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ, তবে আমার ওপর ওহী নাযিল হয়’- সূরা কাহাফ ১১০। ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারা সকলে মৃত্যুবরণ করবে’- সূরা যুমার ৩০। ‘মুহাম্মদ একজন রসূল ছাড়া কিছুই নয়, তার আগেও বহু রসূল গত হয়েছে’- সূরা আলে ইমরান ১৪৪। ‘তুমি বলো, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, ওহীর মাধ্যমে আমাকে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, তোমাদের উপাস্য এক আল্লাহ। সুতরাং তাঁর দিকে সত্য পথে চলো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো’- হামীম-আস-সাজদা ০৬। ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের প্রতি রসূল প্রেরণ করেছি, যে তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে, তোমাদের কিতাব ও প্রজ্ঞা এবং নতুন জ্ঞান শিক্ষা দেয়’- সূরা বাকারা ১৫১। এ প্রসঙ্গে আরো অনেক আয়াত রয়েছে এবং সব আয়াতই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। তোমাদের মতো মানুষ বলে অতি মানবীয় বলে যে কিছু নেই তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এখন যদি কেউ মনে করেন মুহাম্মদ (সা) নূরের তৈরী তাহলে আপনিও তাই, যদি বলেন গায়েব জানেন তাহলে আপনিও জানেন, যদি বলেন তিনি প্রথম সৃষ্টি তাহলে আপনিও। এটি খুব সহজ হিসাব। তিনি আমার আপনার মতই মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন, বেড়ে উঠেছেন ও ঘর-সংসার করেছেন। তাঁর আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহপাক তাঁকে রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং সেজন্য তিনি আল্লাহর সুরক্ষা পেয়ে গুনাহমুক্ত। তাঁর আনীত কিতাব এবং তাঁর বাণীসমূহ আমাদের জন্য হেদায়াত ও শর্তহীনভাবে তিনি আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী। শর্তহীন আনুগত্য বা সমমর্যাদার আর কেউ নেই। মানব জাতি যে আদম (আ)-এর বংশধর এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তারা সবাই তাঁর সন্তান এব্যাপারে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। আল্লাহর বাণী, ‘হে মানব সম্প্রদায়! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমি তোমাদের জন্য জাতি ও গোত্র বানিয়েছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো, কিন্তু আল্লাহর কাছে তোমাদের মাঝে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভয় করে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু জানেন এবং সব কিছুর খবর রাখেন’- সূরা হুজুরাত ১৩। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা ইসলাম নিয়ে ও মুসলমান হিসেবে গর্ববোধ করি না। আমরা পরিচয় দেই শিয়া, সুন্নি, হানাফি, আহলে হাদিস ইত্যাদি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবে অথচ আল্লাহপাক আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান। তাঁর বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’-সূরা আলে ইমরান ১০৩। অনৈক্য ও দলাদলির ব্যাপারে মুসলমানদেরকে আল্লাহ তাঁর কিতাবে ভীষণভাবে সতর্ক করেছেন- ‘তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জল হয়ে ওঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নেয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফুরি নীতি অবলম্বন করেছিলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এ নেয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো। আর যাদের চেহারা উজ্জল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং চিরকাল তারা এ অবস্থায় থাকবে’-আলে ইমরান ১০৫-১০৭। তিনি আরো বলেন- ‘মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা আল্লাহতায়ালার শরিক বানিয়ে উপাসনা করে। তাদের মতও হয়ো না যারা দ্বীনে মতভেদ সৃষ্টি, বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় আর প্রত্যেক দল উল্লাস করে যে, তারাই সঠিক ও সত্যের পথে আছে’-সূরা রুম ৩১-৩২। আল্লাহপাক আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং মতভেদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে হুশিয়ার করেছেন। আমাদের দ্বীন ইবরাহীম (আ.)-এর দ্বীন, আর তিনি আমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম-সূরা হজ্ব ৭৮। আল্লাহর বাণী- ‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে আর বলে, আমি একজন মুসলিম’-সূরা হামীম আস সেজদা ৩৩। তিনি আরো বলেন- ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি, যাতে করে আমি প্রথম মুসলিম হতে পারি’- সূরা যুমার ১২। তাই আসুন, আমরা সকল সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলি এবং কুরআন ও হাদিসকে আঁকড়ে ধরে একটি পরিচয়ই ধারণ করি ‘আমরা মুসলিম’ অর্থাৎ আত্মসমর্পণকারী। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করো এবং মুসলিম অবস্থায় টিকিয়ে রেখ ও মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিও। আমিন। ২৫.০৬.২০২০।

Comments