এই শব্দটি যেন ইসলামের সমার্থক হয়ে পড়েছে। কেউ যদি ইসলামে বিশ^াস করে ও সে অনুযায়ী জীবনযাপন করে এবং একটু অগ্রসর হয়ে ইসলামের প্রচার করে ও প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে তখনই সে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে একটি পরিচিতি লাভ করে। পক্ষান্তরে ইসলাম মানে না ও মাঝে মাঝে ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান ও মূল্যবোধ সম্পর্কে একটু আধটু বিরূপ কথাবার্তা বলে বা সমালোচনা করে সে পরিচিতি পায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে। আবার অনেক সময় বলা হয় Progressive বা প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অধিকারী।
সাম্প্রদায়িকতা সাধারণত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়। যেমন, আমাদের উপমহাদেশে দু’টি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলিম এবং এদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম ও মারামারি-হানাহানিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাম্প্রদায়িকতা কি কেবল ধর্মীয়? আমি বলবো, না। সাম্প্রদায়িকতা একটি গোষ্ঠী ও শ্রেণিচেতনা। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দোষের কিছু নেই। নিজ গোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন, বিপদাপদে এগিয়ে আসা ও পরস্পরকে সহযোগিতা সম্ভব হয় গোষ্ঠী ও শ্রেণি চেতনার কারণে। যেমন, শিক্ষক সম্প্রদায়, যুব সম্প্রদায়, নারী সম্প্রদায়, কৃষক সম্প্রদায়, শ্রমিক সম্প্রদায়, সরকারি ও বেসরকারি চাকুরীজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন সবই এক একটি সম্প্রদায় এবং তাদের স্বার্থ ও অধিকার সমুন্নত রাখার একটি প্রয়াস।
শিক্ষক সম্প্রদায়ের মাঝে সবার স্বার্থ আবার এক নয়। এজন্য দেখা যায় সরকারি-বেসরকারি, প্রাইমারি, হাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। আবার সরকারি কলেজে পিএসসি ও আত্মীকৃত এবং আরো রয়েছে ব্যাচভিত্তিক ৮ম, ৯ম ইত্যাদি। ভাষা, বয়স ও রাজনীতিভিত্তিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ে মানুষের মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে। বাঙালি-অবাঙালি সম্প্রদায়, তরুণ সম্প্রদায়, যুব সম্প্রদায়, প্রবীণ সম্প্রদায়, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত ইত্যাদি। এ সবই পরিচিতি এবং নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকলে দোষ নেই। সমস্যা তখনই যখন মানুষের মাঝে সংকীর্ণতা চেপে বসে এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রকাশ ঘটে।
সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে। আমরা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত মানুষকে দেখি। মানুষে-মানুষে এই বিভক্তি স্রেফ পরিচিতির জন্য; একজন থেকে আর একজন শ্রেয়-এই বলে গর্ব ও অহংকার করার বিষয় নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী, ‘হে মানব সম্প্রদায়! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমি তোমাদের জন্য জাতি ও গোত্র বানিয়েছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো, কিন্তু আল্লাহর কাছে তোমাদের মাঝে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভয় করে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু জানেন এবং সব কিছুর খবর রাখেন’- সূরা হুজুরাত ১৩।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহপাক মানুষকে বিশ্বভ্রাতৃত্বের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সবাই একই পিতা-মাতার (আদম ও হাওয়া) সন্তান। আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন মানুষ। এর বাইরে আমার পরিচয় রয়েছে- আমি একজন পুরুষ, মুসলিম, বাঙালি, শিক্ষক, প্রবীণ বা এমন শত-সহস্র পরিচয় থাকতে পারে এবং সবই পরিচিতির জন্য। এ সব পরিচয় নিয়ে গর্ব ও অহংকার করা এবং অপরকে হেয় করা বা হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য ও গুনাহের কাজ। মানুষের মাঝে রাজনীতির পরিচয়ও বড়। জনসেবা বা জনহিতকর কার্য সম্পাদনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা খুবই স্বাভাবিক এবং যারা এ দায়িত্ব পালনে তৎপর তারা প্রশংসা পাওয়ারই যোগ্য।
রাজনীতি মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে না হয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে হয়ে পড়েছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ। দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা যে নামেই হোক তার মূলে রয়েছে অসাধু রাজনীতি। এ সব হাঙ্গামার নেপথ্যে রাজনীতিক উস্কানিই মূল কারণ। আমাদের দেশে যে হানাহানি ও বিরোধ তার মূলে হিন্দু-মুসলিম চেতনা বা বিরোধ কখনই ছিল না বা এখনো নেই। একজন ধার্মিক হিন্দু বা মুসলিমের চিন্তা-চেতনায় কখনই অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ আসে না বা আসতে পারে না। দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং ফাসাদ সৃষ্টি সবই অধার্মিক ব্যক্তিদের কারসাজি। এ সবই মানুষের চিরশত্রু ইবলিসের কার্যক্রম।
ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত একমাত্র দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা এবং সমগ্র সৃষ্টির ধর্ম। আল্লাহপাক যেমন তাঁর সকল সৃষ্টির খালেক, মালেক, রব, রাজ্জাক এবং ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই সকলের প্রয়োজন পূরণ করে যাচ্ছেন; ঠিক তেমনিভাবে তাঁর প্রদত্ত ও মনোনীত দ্বীন ইসলাম সকলের জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর। এখানে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুমের সুযোগ নেই।
আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের নামই ইসলাম এবং যারাই আত্মসমর্পণ করে তারাই মুসলিম (অনুগত)। এখানে বংশ-গোত্র-সম্প্রদায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এজন্যই দেখা যায়, লুত (আ)-এর স্ত্রী একজন পয়গম্বরের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান হতে পারেনি পক্ষান্তরে কাট্টা কাফির ফিরাউনের স্ত্রী ছিলেন মুসলমান। এমনি নূহ (আ)-এর ছেলে কেনান, ইব্রাহিম (আ)-এর পিতা আজর, মুহাম্মদ (সা)-এর আপন চাচা ও বেয়াই আবু লাহাব মুসলমান হতে পারেনি। হতে পারেনি এ কারণেই যে তারা ইসলামকে মেনে নেয়নি। আবার ইসলামের দুশমন আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবীর মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, আবু জেহেল সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অধিকারী তার প্রকৃত নাম ছিল আবুল হাকাম (জ্ঞানের পিতা)। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে হয়ে পড়েছে আবু জেহেল (মুর্খের পিতা)।
আমরা স্পষ্ট করেছি, ইসলামের প্রতি বিশ্বাস ও মেনে চলেই একজন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে। এর বাইরে মুসলিম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কুরআন মজিদে জান্নাতের যে সুসংবাদ শোনানো হয়েছে তা সবই তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও নেক আমল করেছে। মানুষকে গালি দেয়া, কষ্ট দেয়া, আঘাত করা, গুম-খুন করা কোনো ব্যক্তি কখনই মুসলমান নয় এবং প্রশ্নও উঠে না। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে’- সূরা হুমাযা। রসূল (সা)-এর উক্তি, ‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা) কাউকে মু’মিন স্বীকৃতি না দিলে আর এমন কে আছে যার স্বীকৃতি গ্রহণযোগ্য হবে? তাই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যারা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধায় তাদের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই।
সুধারণা ও কল্যাণ কামনার নাম ইসলাম। তাই ইসলামের আর একটি অর্থ শান্তি অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে শান্তি। সমাজে শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নির্ভর করে পরস্পরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে। আল্লাহর রসুল (সা) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না তারা আমাদের সমাজভুক্ত নন’। একটি মুসলিম সমাজে হিংসা-বিদ্বেষের প্রশ্নই উঠে না। হিংসুটে মানুষের জান্নাতে কোনো অংশ নেই। হিংসা করা কেবল কবীরা গুনাহ নয়, বরং হিংসা অতীতের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। হাদিসের ভাষাটি এমন, ‘আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, হিংসা তেমনি মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়’। আল্লাহপাক হিংসুককে খুব অপছন্দ করেন, তাই সূরা ফালাকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। সমাজে যত দাঙ্গা-ফাসাদ ও গুম-খুন তার মূলে রয়েছে হিংসা। দেশে-দেশে শয়তানের অনুচররা সেই হিংসারই চাষ করছে।
আমরা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি, ইসলাম স্রেফ কোনো ধর্মবিশ্বাসের (সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়) নাম নয় এবং মুসলমানও কোনো জাতিগোষ্ঠীর নাম নয়। ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত একমাত্র হেদায়াত (জীবনাদর্শ বা দ্বীন) এবং এই জীবনাদর্শের প্রতি বিশ্বাসী ও আনুগত্যশীল এক বিপ্লবী জনগোষ্ঠীর নাম মুসলিম। এই মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেরা কেবল বিশ্বাস ও অনুগত হয়েই ক্ষান্ত হয় না বরং তা সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায়। এই একটি কারণেই যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসূল সমসাময়িক স্বৈরশাসক ও তাদের অনুগতদের দ্বারা নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েছেন। আর সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং নিজ জাতি থেকে আল-আমিন ও আস-সাদিক উপাধীপ্রাপ্ত মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীরা অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ ও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। আল্লাহপাক মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, আর যারা কুফুরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে, তোমরা শযতানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, আর বিশ্বাস করো শযতানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’-সূরা আন নেসা ৭৬।
আল্লাহপাক তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-কে পাঠিয়েছেন তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। এ কথাটি তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মজিদে তিন জায়গায় সূরা তাওবা (৩৩ নং), সূরা ফাতাহ্ (২৮ নং) ও সূরা সফে (৯ নং) বলেছেন। নবীর (সা) উম্মত হিসেবে আমাদেরও একই দায়িত্ব এবং যারাই এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন আল্লাহপাক তাদের অপরাধ ক্ষমা করে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। অবশ্য আল্লাহ ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ সকলকেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন একটি শর্তে, তা হলো তাদেরকে হতে হবে ইসলামের পক্ষের শক্তি। ইসলামের শত্রু কারো জন্য জান্নাতে কোনো অংশ নেই। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসলামে প্রবেশ করেছিল এবং মসজিদে নববীতে নামায আদায় করেছে ও পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে মুসলিম হলেও সে কখনই ইসলামের বিজয় কামনা করেনি বরং অন্তরের দিক দিয়ে ইসলামের দুশমন ছিল। ফলে তার কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সাম্প্রদায়িকতা বলতে অপর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, অকল্যাণ কামনা, জানমালের ক্ষতিসাধন ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি বোঝালে ইসলাম কখনই তা সমর্থন করে না এবং যারা এ জাতীয় কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলাম তাদেরকে এই পবিত্র ধর্মের অনুসারী বলে স্বীকার করে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনার আড়ালে কারো যদি ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ বা ইসলাম পালনে কোনো শৈথিল্য ও ইসলামের বিজয়ে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেললো। সে বড় হতভাগা। আল্লাহপাকের দয়া অনুগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। আল্লাহর ক্ষমার দ্বার অবারিত। তাওবা করে ইসলামের পথে ফিরে আসলে আশা করা যায় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। ২৩.০৬.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment