Skip to main content

বিপদ মুসিবত উত্তরণে রাসূল (সা) এর নীতি ও আদর্শ

মানুষ আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি, জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সকল সৃষ্টির সেরা। আল্লাহর সৃষ্টিজগতের সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারী তাঁরই প্রতিনিধি (খলিফা)। জ্ঞান-বুদ্ধির পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বোত্তম নেয়ামত হিসেবে নবী-রসূল ও কিতাবের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে হেদায়াত। হযরত আদম (আ)-কে বেহেশত থেকে চলে আসার জন্য যখন বলা হয় তখন তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সে সময় আল্লাহ তাঁকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, তাঁর পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই (সূরা বাকারা ৩৮)। আল্লাহপাক আদম (আ)-কে তাঁর ত্রুটি ক্ষমা করে একজন নবী হিসেবে দুনিয়ায় পাঠান এবং তিনি প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। তাঁরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহতায়ালা অসংখ্য নবী-রসূল পৃথিবীতে পাঠান এবং সর্বশেষ নবী ও রসূল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহতায়ালা সকল জাতির মাঝে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন এবং সকলের দাওয়াত ছিল অভিন্ন। আল্লাহর বাণী, ‘প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর বন্দেগী করো এবং তাগুতের বন্দেগী পরিহার করো’- সূরা নাহল ৩৬। আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর দাসত্বের জন্য (নিশ্চয়ই আমি জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য-সূরা আয যারিয়াত ৫৬)। যুগে যুগে মানুষ আল্লাহর দাসত্ব অস্বীকার করে নিজেরাই মনিব হয়ে আল্লাহর বান্দাদেরকে দাসত্ব করতে বাধ্য করেছে। আর আল্লাহ নবী-রসূল পাঠিয়েছেন এ-সব ভুয়া মনিবদের (তাগুত) আনুগত্য অস্বীকার করে কেবল আল্লাহতায়ালাকে ইলাহ মেনে পরিপূর্ণভাবে তাঁর আনুগত্য করার জন্য। ফলে সকল নবী-রসূলের সাথে সমসাময়িক রাজা-বাদশা ও শাসকদের শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে। নবী-রসূল ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীদের কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কাউকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে আবার কাউকে জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। কুরআন মজিদে স্বল্প সংখ্যক নবী-রসূলের বর্ণনা রয়েছে। অধিকাংশ নবী-রসূল নানাবিধ বিপদ-মুসিবত ও জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। মুহাম্মদ (সা) তার ব্যতিক্রম নন। তিনি ছিলেন তাঁর সমাজের সর্বোত্তম ব্যক্তি। দীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি তাঁর সমাজে একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি হিসেবে সম্মান পেয়েছেন। সততা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতায় তিনি ছিলেন সেরা। নির্ভরযোগ্য হিসেবে মানুষ তাঁর কাছে মালামাল গচ্ছিত রাখতো। তিনি ছিলেন তাঁর সমাজের মানুষের সুখে-দুঃখের সাথী, বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা ও বিবাদ-বিসংবাদের মিমাংসাকারী এবং অসহায়দের আশ্রয়স্থল। সততা ও বিশ্বস্ততায় মানুষ খুশি হয়ে তাঁকে উপাধী দিয়েছিলেন আল-আমিন ও আস-সাদিক। নবুয়তের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর জাতির মাথার মুকুট। তাঁর সম্পর্কে জাতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কোনো অভিযোগ ছিল না। মুহাম্মদ (সা)-এর আগমন কালটা ছিল সবচেয়ে অধপতিত এবং ইতিহাসে আইয়ামে জাহিলিয়াত (অন্ধকার যুগ) হিসেবে খ্যাত। চুরি-ডাকাতি, যিনা-ব্যাভিচার, খুন-যখম-মারামারি এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা সেই সমাজে চালু ছিল না। মানুষ হাটে-বাজারে কেনা-বেচা হয়েছে, নারী জাতির অবস্থা ছিল বড় করুণ, মানুষ এতোটা অধপতিত হয়েছিল যে, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পিতা অনেক সময় অপমান বোধ করে মাটির গর্তে জীবন্ত পুঁতে রাখতো। মানবতার এই চরম অধপতনের যুগে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন ব্যতিক্রম। সমাজের দুরবস্থা ও অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁকে ব্যথিত করতো। দুরবস্থা লাঘবের লক্ষ্যে সমবয়সীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন হিলফুল ফুজুল। সমাধান পাওয়ার লক্ষ্যে একপর্যায়ে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকেন। চল্লিশ বছর বয়সে এমনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হন। সূরা আলাকের পাঁচ আয়াত নাজিলের মধ্য দিয়ে তাঁর ওপর ওহী অবতরণ শুরু হয় এবং ফেরেশতা জিবরাইল (আ)-এর মাধ্যমে ওহী অবতরণের ফলে তিনি এক নতুন অভিজ্ঞতায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রীকে বলেন, আমার ভয় হয়, না জানি আমার ওপর কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসে। স্ত্রী খাদিজা (রা) তাঁকে সান্ত্বনা দেন এই বলে, আপনি গরীব-দুঃখী মানুষের আশ্রয়স্থল, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচারী, সকল অন্যায় থেকে দূরে অবস্থানকারী, অতএব আপনার কোনো ভয় নেই। এরপর খাদিজা (রা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকার কাছে নিয়ে যান এবং সবকিছু শোনার পর তিনি বলেন, এতো সেই ফেরেশতা যিনি মুসা (আ)-এর কাছে এসেছিলেন। ওয়ারাকা ছিলেন অতীতের আসমানি কিতাবের সুপন্ডিত এক বয়োবৃদ্ধ ও সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি খাদিজা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, তাঁর জাতি অত্যাচার-নির্যাতনসহ তাঁকে দেশ থেকে বের করে দিবে। তাঁকে সহায়তা করার আমার কোনো শক্তি-সামর্থ নেই। মুহাম্মদ (সা) বলেন, আমাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করবে? জবাবে ওয়ারাকা বলেন, অতীতেও তাই করা হয়েছে। ওহী অবতরণের কিছুদিন বিরতির পর সূরা মুদ্দাচ্ছিরের ৭টি আয়াত নাজিল হয় এবং নবী হিসেবে তাঁর কাজ বলে দেয়া হয়। কম্বলাবৃত মুহাম্মদ (সা)-কে বলা হয়, ওঠো মানুষকে সাবধান করো এবং তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। পৃথিবীতে নবী-রসূলদের সাথে সমসাময়িক রাজা-বাদশা-শাসক ও তাদের অনুসারীদের সাথে লড়াই-সংগ্রামের মূলে ছিল শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। নমরুদ, ফিরাউন, আবু জেহেল-আবু লাহাবসহ সব স্বৈরশাসক চায় জমিনে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব চলবে, বড় মনে করে মানুষ তাদের আনুগত্য করবে ও ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ করবে। কর্তৃত্বের পথে যাদেরকেই তারা বাধা ও প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করেছে তাদের প্রতি চালিয়েছে নির্মম নিপীড়ন-নির্যাতন। নবী-রসূলদের আগমনের উদ্দেশ্যই ছিল তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে মানুষকে ডাকা। সকল নবী-রসূলের আহবান ছিল একই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং প্রতিত্তোরে সকলের সাথে একই আচরণ করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে তিনি তাঁর নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন ও বংশীয় লোকদের পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করে বলেন, আমি যদি তোমাদের বলি, পাহাড়ের অপর পার্শ্বে তোমাদেরকে আক্রমণের জন্য একদল শত্রু অপেক্ষা করছে, তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে? তারা সমস্বরে জবাব দেয়, অবশ্যই, কারণ তুমি তো আল-আমিন। তাঁর সত্যবাদিতার স্বীকৃতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা বলো আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’। এই জবাবে মুহাম্মদ (সা)-এর আপন চাচা আবু লাহাব বলে উঠেন, তাব্বান লাকা ইয়া মুহাম্মদ! মুহাম্মদ, তুমি ধ্বংস হও! এই কালেমার মর্মবাণী তারা বুঝতো। ফলে মানুষের সম্মুখে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার সাথে সাথে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনসহ বংশের লোকজন বিরোধীতা শুরু করে দেয়। মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দান, পরিশুদ্ধ করা ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্তভাবে আল্লাহর। মানুষের সমাজে যারা এই দায়িত্ব পালন করেন তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী। আল্লাহপাক তাঁর মিশন এগিয়ে নেয়ার জন্য নবী (সা)-কে নিজেই নির্দেশনা প্রদান করেন। পরিবেশ প্রতিকূল হওয়ায় মুহাম্মদ (সা) প্রথমে তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে গোপনে দাওয়াত দেন। তাতে তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা), ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর (রা) ও পরিবারের সদস্য চাচাতো ভাই আলী (রা) দাওয়াত কবুল করেন এবং আরো বেশ কিছু লোকের দাওয়াত কবুলের পর একপর্যায়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে দাওয়াতের নির্দেশ আসে। দাওয়াত দানের সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় তাঁর ও তাঁর সাথীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। আল্লাহর পক্ষ থেকে করণীয় সম্পর্কে ওহীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও প্রদান করা হয়। এ দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। পরীক্ষা কখনো আসে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে আবার কখনো দ্বীনের কারণে তাঁর অবাধ্য বান্দাদের পক্ষ থেকে। পরীক্ষায় যারা ধৈর্যাবলম্বন করেন ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাঁদেরকেই তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে পুরস্কৃত করেন। সকল নবী-রসূল নানাবিধ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাঁদের অনেকের সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে। বিস্তারিতভাবে এসেছে হযরত ইবরাহিম (আ), মুসা (আ), ইসা (আ) সম্পর্কে। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-এর পরীক্ষাও কম নয়। সে-সব পরীক্ষায় উত্তরণের কৌশল স্বয়ং আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন। তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর আনুগত্য তখনই সম্ভব যখন জমিনে আল্লাহর দ্বীন পৃথিষ্ঠিত থাকে। তাই আল্লাহপাক সকল নবী-রসূলকে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েই পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই (বিধান) নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহী করে পাঠিয়েছি, যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম: তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না; তুমি যে দিকে আহবান করছো, এটি মুশরিকদের কাছে একান্ত দুর্বিসহ। মূলত আল্লাহতায়ালা যাকেই চান তাকে বাছাই করে তাঁর নিজের দিকে নিয়ে আসেন এবং যে ব্যক্তি তাঁর অভিমুখী হয় তিনি তাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করেন’-সূরা আশ শূরা ১৩। দ্বীনকে বিজয়ী করার দায়িত্ব দিয়ে এককভাবে নবী মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণের কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর বাণী, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি তাঁর রসূলকে হেদায়াত (আল কুরআন) ও সত্য দ্বীনসহ (আল ইসলাম) পাঠিয়েছেন, যাতে অন্য সব দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করেন। সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট’- সূরা ফাতাহ: ২৮। একই কথা বলা হয়েছে সূরা তাওবা ও সূরা সফে। দ্বীন কায়েমের প্রাথমিক কাজ হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। মানুষ আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে দ্রুত জাহান্নামের দিকে ধাবিত হয়; এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা সকল নবী-রসূলের জীবনের লক্ষ্য ও কর্মপ্রচেষ্টা। নবুয়তের সূচনালগ্নে মানুষকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ নবী মুহাম্মদ (সা)-কে নির্দেশ প্রদান করেন (সূরা মুদ্দাস্সির)। আল্লাহপাক সে সময়ে যে-সব সূরাসমূহ নাজিল করেন সেগুলোতে তাওহিদ, রেসালাত ও আখিরাতের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসই মানুষকে সকল অন্যায়-অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে থাকতে সাহায্য করে। প্রকাশ্যে দাওয়াতের সাথে সাথে মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীদের ওপর কাফির-মুশরিকদের পক্ষ থেকে নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। এই নির্যাতন ছিল এক তরফা। নির্যাতনের বিপক্ষে গোপনে বা প্রকাশ্যে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো নজির রসূলুল্লাহ (সা)-এর মক্কীজীবনে পাওয়া যায় না। কাফির-মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বরং চেষ্টা করা হয়েছে তাদের থেকে নিজেদের আড়ালে রাখা বা প্রকাশ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত না হওয়া, চাচা আবু তালেবসহ বন্দীজীবন, আবিসিনিয়ায় হিজরত এবং সর্বশেষ গোপনে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করা। কাফির-মুশরিকদের পক্ষ থেকে অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকেও তাঁর নবী (সা)-কে পরীক্ষার মুখোমুখি করা হয়েছে। একে একে তাঁর পুত্র সন্তানগুলো ইন্তেকাল করলে তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও বংশের লোকদের কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি-সহমর্মিতা নয় বরং রসূল (সা)-এর দুঃখ-কষ্ট ছিল তাদের কাছে আনন্দের। আপন চাচা আবু লাহাব কাফির সরদারদের কাছে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, মুহাম্মদ আবতার হয়ে গেছে। তাকে স্মরণ করার মতো কেউ থাকলো না। আল্লাহপাক নিজে সূরা কাউসার অবতীর্ণ করে তাঁর প্রিয়তম নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, তোমাকে কাউসার (সীমাহীন প্রাচুর্য, নাম-যশ-খ্যাতি সবদিক দিয়ে) দান করা হয়েছে এবং তোমার শত্রুরাই আবতার (শিকড়কাটা)। দীর্ঘ তেরোটি বছর মক্কায় রসূল (সা) ও তাঁর সাথীদের জীবন দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ছিল। সে সময়ে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন। আখিরাতের বিশ্বাস ও বিপদ-মুসিবতের মধ্য দিয়ে এই লোকগুলো নিখাদ খাঁটি হয়ে পড়েন। আল্লাহপাক তাঁর ওপর বিশ্বাসস্থাপনকারী বান্দাদের মৌলিক মানবীয় গুণে ভূষিত হওয়ার লক্ষ্যে সূরাসমূহ অবতীর্ণ করেন। ঈমান গ্রহণকারী লোকেরা হবে নেক আমলে সমৃদ্ধ (সূরা আসর), গরীব-দুঃখী ও ইয়াতিম-মিসকিনের প্রতি সহানুভূতিশীল ও উদার (সূরা মাউন), মানুষকে গালাগাল, গীবত-পরনিন্দা ও জুলুম থেকে মুক্ত (সূরা হুমাযা), সর্বোপরি মানুষ হবে শিরকমুক্ত ও আল্লাহর সমকক্ষ কাউকে মানবে না (সূরা ইখলাস)। মক্কীজীবনে অবতীর্ণ সূরাসমূহে কোনো লড়াই-সংগ্রাম নয়, বরং আত্মগঠন, পরম ধৈর্যাবলম্বন ও সকল প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে যে, আমি একজন মুসলমান’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ৩৩। সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী রসূল (সা) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা কাফির-মুশরিকরা কখনই মেনে নিতে পারেনি। হক ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। কাফিরদের বাজে কথাবার্তা ও হীন আচরণের মোকালেয়ায় আল্লাহপাক তাঁর রসূল (সা)-কে নছিয়ত করেছেন। ‘(হে নবী) ভালো ও মন্দ কখনো এক নয়, তুমি মন্দকে দূর করো সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম, তাহলে দেখবে জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ৩৪। দীর্ঘ তেরোটি বছর রসূলুল্লাহ (সা) ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে প্রতিশোধ তো নয়ই বরং আল্লাহর হেদায়াত অনুসারে সাধারণ মানুষ ও শত্রুদের কল্যাণকামী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। পথে কাঁটা দেয়া বুড়ির কাহিনী আমরা জানি। আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের মিথ্যা প্রচারণায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে কিন্তু যখনই তারা রসূল (সা)-এর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছে তখনই তাদের কাছে প্রকৃত সত্য স্পষ্ট হয়েছে। মন্দ আচরণ নীরবে সহ্য করা ও ধৈর্যাবলম্বন অনেক সময় সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেয়া এতো সহজ নয়। অতি সৌভাগ্যবান ছাড়া এমন আচরণ কেউ করতে পারে না। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর এটি শুধু তাদের ভাগ্যেই জোটে-যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এ সকল লোক তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ৩৫। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু, শয়তান চায় মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হোক এবং মানবসমাজ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ফ্যাসাদে ভরে উঠুক। ক্ষমা করাকে শয়তান দুর্বলতা বলে প্ররোচণা দেয় এবং মানুষ অনেক সময় শয়তানের খপ্পরে পড়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাঁর বান্দাকে তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য এভাবে বলেছেন, ‘যদি কখনো শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও, অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ৩৬। দ্বীনের দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা) মানুষের কাছে আল্লাহর কুরআনকে পেশ করেছেন। নবী (সা)-এর কাজ হিসেবে আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন, তিনি মানুষকে আল্লাহর আয়াত শোনান ও পরিশুদ্ধ করেন এবং কুরআন ও হিকমাত শিক্ষা দেন (সূরা বাকারা ১৫১)। কুরআন শোনানো ও প্রচারের ক্ষেত্রে কাফিরদের বড় আপত্তি ছিল এবং বর্তমানেও কুরআনের বিরোধীতা অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহপাক তাদের প্রতি চরম ক্রোধ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এই কাফিররা বলে, তোমরা কখনই কুরআন শুনবে না এবং যেখানে কুরআন শোনানো হয় সেখানে হট্টগোল করবে, হয় তো তোমরা জয়ী হবে। আমি অবশ্যই কাফিরদের কঠিন আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাবো এবং নিশ্চয়ই আমি তাদের সে কাজের প্রতিফল দেবো, যে আচরণ তারা করে এসেছে। এই জাহান্নামই হচ্ছে আল্লাহর শত্রুদের পাওনা, সেখানে তাদের জন্য চিরস্থায়ী আযাবের ঘর থাকবে; তারা যে আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো, এটা হচ্ছে তারই প্রতিফল’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ২৬-২৮। কাফিরদের শত বাধা উপেক্ষা করে আল্লাহর রসূল (সা) তাঁর দাওয়াত অব্যাহত রাখেন। দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুসিবত কোনো কিছু এ পথ থেকে তাঁকে ও তাঁর সাথীদের একটি মুহূর্তের জন্যও বিরত রাখতে পারেনি। কাফিরদের জুলুম-নির্যাতন বৃদ্ধির পাশাপাশি ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এর মূলে ছিল কুরআনের অপূর্ব বাণী ও মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীদের উত্তম চরিত্র মাধুর্য। তৎকালে মানুষের মাঝে নৈতিকতা বলতে কিছু ছিল না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, যিনা-ব্যাভিচার, ধর্ষণসহ মানবচরিত্রের সকল কদর্য দিক কাফির-মুশরিকদের মাঝে ছিল। আর ব্যতিক্রম ছিলেন মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীরা। কাফিরদের লক্ষ্য ছিল যাতে সাধারণ মানুষ মুহাম্মদ (সা)-এর সান্নিধ্যে না আসে। হাজারো অপপ্রচার রসূল (সা)-এর বিরুদ্ধে তারা করতো। আল্লাহপাক নিজেই তাঁর নবী (সা)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন, ‘(হে রসূল!) আমি জানি, এরা যা বলে, তা তোমাকে পীড়া দেয়, এরা শুধু তোমাকেই মিথ্যা সাব্যস্ত করে না; বরং এই যালেমরা আল্লাহতায়ালার আয়াতকেই অস্বীকার করে’- সূরা আনয়াম ৩৩। রসূল (সা)-এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার আল্লাহপাক নিজের ওপর গ্রহণ করে বলেছেন, তোমাকে নয় বরং যালেমরা আল্লাহর নিদর্শনকেই অস্বীকার করে। মুহাম্মদ (সা) তাঁর সমাজে সুদীর্ঘ ৪০টি বছর কাটিয়েছেন এবং সর্বোত্তম চরিত্রের কারণে তিনি আল-আমিন ও আস-সাদিক হিসেবে সমাজে সমাদৃত ছিলেন। যখনই মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা হয়েছে তখনই তাঁর সাথে শত্রুতা শুরু হয়ে গেছে। আসলে কাফির-মুশরিকরা ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা)-এর শত্রু নন, এরা শত্রু মূলত আল্লাহর এবং আল্লাহ নিজেও তাদেরকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন ‘এই জাহান্নামই হচ্ছে আল্লাহর শত্রুদের পাওনা’- সূরা হা-মীম আস সাজদা ২৮। বর্তমানেও যারা দ্বায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে সমাজে ভূমিকা পালন করছেন তারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হলেও আবু জেহেল-আবু লাহাবদের উত্তরসূরীরা একই আচরণ করছে। গুম, খুন, জেল-জুলুম তাদের পাওনা হয়ে রয়েছে। অতীতকালের নবী-রসূলদের কাহিনী উল্লেখপূর্বক তাঁর প্রিয়তম নবী (সা)-কে ধৈর্যাবলম্বনের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমার আগেও রসূলদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা ও নানাভাবে নির্যাতিত হবার পরও তারা ধৈর্য ধারণ করেছে, শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে আমার সাহায্য এসে হাজির হয়েছে। আসলে আল্লাহর কথা বদল করার কেউ নেই, অবশ্য নবীদের সংবাদ তো তোমার কাছে আগেই এসে পৌঁছেছে’- সূরা আনয়াম ৩৪। ইসলামের এ পথ বড়ই কন্টকাকীর্ণ। আল্লাহপাক তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারী বান্দাদের ধৈর্যাবলম্বনের ক্রমাগত তাগিদ দিয়েছেন। মানবজীবনের দু’টি দিক। এক. দুনিয়ার জীবন, দুই. আখিরাতের জীবন। দুনিয়ার জীবনটা বড় ক্ষণস্থায়ী কিন্তু আখিরাতের জীবন স্থায়ী এবং যার কোনো শেষ নেই। আল্লাহ ঈমানদার বান্দাদের আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী, ‘তোমাদের যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের কতিপয় ভোগের সামগ্রী মাত্র, কিন্তু (পুরস্কার হিসেবে) যা আল্লাহতায়ালার কাছে আছে তাই হচ্ছে উত্তম ও স্থায়ী, আর তা সে সব লোকের জন্য যারা তাঁর ওপর ঈমান আনে এবং সর্বাবস্থায় তাদের রবের ওপর নির্ভর করে’- সূরা আশ শূরা ৩৬। দুনিয়ায় যালেমরা আল্লাহর বান্দাদের ওপর যুলুম করে সাময়িক আনন্দ ভোগ করলেও আখিরাতে তার পূর্ণ বদলা পাবে এবং বদলা হিসেবে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা। যুলুম-নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ আল্লাহ রেখেছেন কিন্তু আল্লাহ চান তাঁর নেক বান্দারা প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে ক্ষমার গুণে গুণান্বিত হোক। আল্লাহর বাণী, ‘মন্দের প্রতিদান অনুরূপ মন্দ, কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর দায়িত্ব, নিশ্চয়ই তিনি যালেমদের পছন্দ করেন না’-সূরা আশ শূরা ৪০। আল্লাহ পুরস্কৃত করবেন, এটি জানার পর ক্ষমা করার ক্ষেত্রে আর বাধা কোথায়? শয়তান ক্ষমা করাকে ভীরুতা ও দুর্বলতা বলে অপপ্রচার চালায় ও মানুষকে উস্কানি দেয়। কিন্তু আল্লাহ বলেন এর বিপরিত। তাঁর বাণী, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে ও ক্ষমা করে দেয় (সে যেন জেনে রাখে), অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম’- সূরা আশ শূরা ৪৩। সংকীর্ণতা মু’মিনের মধ্যে স্থান পেতে পারে না। মু’মিন প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী এবং ক্ষমা করা হৃদয়ের প্রশস্ততারই পরিচায়ক। আল্লাহ তাঁর কিতাবে নবী-রসূল ও তাঁদের অনুসারী দ্বায়ীদের উপস্থাপন করেছেন নির্লোভ, ক্ষমাকারী ও অতি উচ্চ মানের চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। সূরা ইয়াসীনে একটি কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তিন তিন জন রসূলের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। ঈমান আনার সাথে সাথে তিনি ছুটে আসেন তাঁর গোমরাহ জাতির কাছে এবং বলেন, তোমরা আনুগত্য করো সেই রসূলদের যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চান না এবং নিজেরা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ’-সূরা ইয়াসীন ২০-২১। শেষ পর্যন্ত জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয় দাখিল হও জান্নাতে। এই শরীফ ব্যক্তিটি তাঁর হন্তার জন্য কোনো অকল্যাণ কামনা করেননি এবং কোনো অভিশাপও দেননি। বরং তাঁর যবান থেকে উচ্চারিত হয়েছে, ‘হায়! আমার জাতির লোকেরা যদি বুঝতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন’-সূরা ইয়াসীন ২৬-২৭। একজন মু’মিন আল্লাহর সাহায্যকারী এবং আল্লাহর পক্ষে সে কাজ করে এবং সে জানে তার আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিমান ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহর রসূল (সা)-এর জীবনের দু’টি দিক। এক. মক্কায় তেরো বছরের প্রস্তুতির যুগ। এখানে এক তরফা শুধু মা’র খেয়েছেন, পাল্টা মা’র দেননি। আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাঁকে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মক্কায় আমীর হামজা (রা) ও ওমর ফারুক (রা)-এর মতো অনেক বাহাদুর ইসলাম গ্রহণ করে রসূল (সা)-এর সাথী হয়েছেন। কিন্তু নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রেক্ষিতে কোনো পাল্টা জবাব দেয়া হয়নি। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তোমাদের হাত সংবরণ করো ও নামায কায়েম করো। দ্বিতীয়ত, মদিনায় বিজয় যুগ। যতো লড়াই-সংগ্রাম ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সবই মদীনায় হিজরত করার পর। মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহে যুদ্ধ-বিগ্রহের পাশাপাশি ইসলামের বিধানসমূহ নাজিল হয়। যে উদ্দেশে (দ্বীনের বিজয়) আল্লাহপাক তাঁর রসূল (সা)-কে প্রেরণ করেছেন সেটি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয় মদীনায়। এখানে স্পষ্ট যে, সশস্ত্র যুদ্ধ (কিতাল) মূলত রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেয়ার কোনো সুযোগ নেই, সেটি হবে সমাজে ফিতনা সৃষ্টির শামিল। ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের মতামাতের ভিত্তিতে শাসক নির্বাচিত হবে। অবৈধ উপায়ে কেউ শাসক হলেও তাকে পরিবর্তন নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় করতে হবে। অর্থাৎ জনমত গঠন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ (যদি সুযোগ থাকে) বা মিছিল-মিটিং সমাবেশের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে। গোপন তৎপরতায় বা সশস্ত্র পন্থায় সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। দ্বীন কায়েমের বিষয়টি একান্তভাবে আল্লাহর। কিভাবে সেটি দেখার বিষয় তাঁর। তাঁর মু’মিন বান্দাদের দায়িত্ব মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং নিজেদেরকে নেক আমলে সমৃদ্ধ করা। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’-সূরা নূর ৫৫। নবী-রসূলদের মতো একামতে দ্বীনের দায়িত্ব যারাই পালন করবে বিপদ-মুসিবত বন্যার পানির মতো তাদের ওপর ধেয়ে আসবে। এর থেকে উত্তরণের জন্য নবী মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর হেদায়াত অনুসারে যে পন্থা অনুসরণ করেছেন সেটিই হচ্ছে মু’মিনদের অনুসরণীয় পথ। সে পথটি হলো, বিপদ-মুসিবতে পরম ধৈর্যাবলম্বন এবং সকল প্রতিকূল অবস্থাকে উপেক্ষা করে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয়ে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া ও তাদেরকে সংগঠিত করা। প্রতিকূল পরিবেশেও সাধারণ মানুষের দ্বীন গ্রহণের মূলে কাজ করেছিল আল্লাহর রসূল ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের চরিত্র মাধুর্য অর্থাৎ নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়া। আখিরাতে জান্নাত প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহ বারবার বলেছেন, যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে। ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ ব্যক্তিরাই জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য। আল্লাহপাক আমাদেরকে ঈমান ও নেক আমলের পুঁজি নিয়ে জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।

Comments