Skip to main content

করোনা অর্থনৈতিক প্রভাব ও উত্তরণের উপায়

বছরজুড়ে চলছে করোনার ভয়াবহ তান্ডব। সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ০৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৪২ জন। গতকাল ২৪ ঘন্টায় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড ১০,৮০৫ এবং আক্রান্ত ৬ লক্ষ ৬ হাজার ৪১০ জন। একক দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর আমেরিয়ায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত ১ কোটি ১৮ লাখ ৮২ হাজার ৯২৭ ও মৃত্যু ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৫ জন। গত ২৪ ঘন্টায় ইউরোপে মৃত্যু ৫ হাজার ২০০ ও আমেরিকায় ১ হাজার ৬১৫ জন। বাংলাদেশে ২৪ ঘন্টায় শনাক্ত ২৩৬৪ ও মৃত্যু ৩০ জন। মোট শনাক্ত ৪ লক্ষ ৪১ হাজার ১৫৯ ও মৃত্যু ৬,৩০৫ জন। আমি একসময় করোনা নিয়ে নিয়মিত লিখতাম। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল হতদরিদ্র, ঘনবসতি ও বস্তি এলাকায় (এশিয়া ও আফ্রিকা) করোনা ভয়াবহ রূপ নেবে এবং রাস্তঘাটে লাশ পড়ে থাকবে। চিকিৎসা নয়, লাশ দাফনে মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছিল ৮ কোটি লোক আক্রান্ত হবে এবং ২০ লক্ষ মারা যাবে। না, সে সব সত্য হয়নি। বাংলাদেশে মারা যাওয়ার মধ্যে বস্তিবাসী ও হতদরিদ্রের তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে বস্তিবাসী হতদরিদ্রদের প্রবেশিধার নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরিচিত কারো কাছে এ পর্যন্ত শুনিনি যে তার কাজের মহিলাটি মারা গেছে। বলা যায়, আল্লাহর রহমত তাদের উপর বর্ষিত হয়েছে। আমি শুরু থেকেই বলতে চেয়েছি, করোনা মুসলিম (অনুগত), সে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে চলে। কুরআন মজিদে আদ, সামুদ, শোয়াইব (আ) ও লুত (আ)-এর জাতির ধ্বংসের কাহিনী উল্লেখ রয়েছে। তারা ছিল খুব শক্তিমান জাতি। কিন্তু তাদের শক্তিমত্তা আল্লাহর মোকাবেলায় কোনো কাজে আসেনি। এবারে করোনা উন্নত শির ও গর্বিত রাষ্ট্রসমূহকে বড় অসহায় করে দিয়েছে। আল্লাহপাক গজব দিয়ে অতীতে জাতিসমূহকে সতর্ক ও শাস্তি দিয়েছেন। যখন আল্লাহর গজব আসে ভালো-মন্দ উভয়ের উপর নিপতিত হয়। বালা-মুছিবতে ভালো লোকগুলো আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট ও ধৈর্য অবলম্বনসহ মৃত্যুবরণ করলে হাদিসে শহীদের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। বালা-মুসিবত দিয়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করতে চান যাতে তারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে। দুর্ভাগ্য, ফিরে আসার কোনো লক্ষণ নেই। করোনা নিয়ে হয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি যেন বেড়েছে। জুলুমের মাত্রাও কমেনি। আসলে মানুষ আল্লাহকে ভুলে গেছে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস, আল্লাহ স্রষ্টা হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ব জাহানের নিয়ন্ত্রকও। অবকাশ দেয়ার অর্থ এ নয় যে, বান্দার উপর জুলুম-নির্যাতন ও দুষ্ট লোকের অপকর্ম আল্লাহ দেখেন না। তাই করোনা থেকে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি সকল অন্যায় ও জুলুম থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে চললে তিনি তাঁর অনুতপ্ত বান্দাদের প্রতি রহমত নাজিল করবেন। করোনা বিশ্বের পাশাপাশি জনবহুল ও দরিদ্র বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক স্থবিরতা নিয়ে এসেছে। দেশের উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য গতিহীন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত। একটি বছর শিক্ষা থেকে ছেলে-মেয়েরা বঞ্চিত। এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারী ও টিউশনি করে যে সব ছাত্র-ছাত্রীরা চলতো তারা সবাই বেকার হয়ে পড়েছে। দেশের বেসরকারি খাত একেবারে পর্যদস্তু। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাঁটাই, আবার অনেকে বেতন হ্রাস করেছে। আমাদের বিল্ডিং-এ নতুন এক দারোয়ানের খোঁজ নিয়ে জানলাম, দৈনিক ১২ ঘন্টা ডিউটি (সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা বা রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা), বেতন ৯,০০০/- এবং কোম্পানি থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে ৩,০০০/- টাকা কেটে রাখার পর সে পায় ৬,০০০/- টাকা। এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী। বিপুল পরিমাণ কর্মী বিদেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে ও বেসরকারি খাতে দৈন্যদশা; ফলে স্বাভাবিকভাবে দেশে চলছে মন্দা। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, রাজনীতিক টাউট ও অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। এদের সংখ্যা বড়জোর ১০% হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই সৎ কিন্তু সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী স্বল্পসংখ্যক অসাধু লোকজনের কাছে সবাই অসহায়। দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নেই, সুযোগ পেলেই এরা অর্থ পাচার করে। মন্দা উত্তরণে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস থেকে শুরু করে অমর্ত্যসেন সবারই একই কথা, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া মন্দা দূর করা সম্ভব নয়। দুর্যোগকালে ধনীদের দানের হাতটাও প্রসারিত করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, দান-সদকা ক্রমবৃদ্ধি দান করে। হতদরিদ্র মানুষ হাতে পয়সা পেলে বা তাদের হাতে দ্রব্যসামগ্রী তুলে দিলে দেশে বেচা-কেনা বাড়ে ও অর্থনীতিতে গতি আসে। সীমাহীন বেকারত্বের কারণে দেশের যুব সমাজ চরম হতাশায় ভুগছে। অথচ সরকারি পর্যায়ে ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ৪৫১টি পদ খালি রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম শ্রেণি ৫৫,৩৮৯, দ্বিতীয় শ্রেণি ৪৯,১৪২, তৃতীয় শ্রেণি ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৭৭৯ এবং চতুর্থ শ্রেণি ৮৭ হাজার ১৪১ জন। সরকারি অফিস-আদালতে সীমাহীন দুর্নীতির মূলে রয়েছে অস্বচ্ছ নিয়োগ। মেধার ভিত্তিতে স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ হলে জাতি উপকৃত হবে। সরকারি উদ্যোগে বেকারদের চাকুরি প্রদানের ফলে তার ঢেউ বেসরকারি খাতে লাগবে এবং অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে। সামনে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে একটি বড় ধরনের নিয়োগ হতে যাচ্ছে। অর্থনীতির স্বার্থে বাকি পদসমূহ পর্যায়ক্রমে পূরণ হওয়া দরকার। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে লকডাউন সম্ভব নয়। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া দরকার। শহরে ধনীর সন্তানরা যারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বাস ও লেখাপড়া করে তাদের জন্য আপাতত বন্ধ রেখে সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। আমার ধারণা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তারা অনলাইনে মোটামুটি লেখাপড়ার সাথে সংশ্লিষ্টও রয়েছে। পক্ষান্তরে গ্রামে ছুটে চলা শিক্ষার্থীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক ভালো। বাড়িতে গেলে আমার ভাতিজাদের সারাক্ষণ খেলাধুলায় ব্যস্ত দেখি। গ্রামে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ রয়েছে। এসেম্বলির সাথে আধা ঘন্টা ব্যায়াম/শারীরিক পরিশ্রম বাধ্যতামূলক করা যায়। রৌদ্রে প্রতিদিন আধা ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করোনা প্রতিরোধে যথেষ্ট হতে পারে। মাঝে-মধ্যে বাড়ি গিয়ে দেখি গ্রামের মসজিদে, বাজারে লোকে ঠাসা; করোনা নিয়ে তাদের ভীতি ও চেতনা মোটেই নেই। আমার এই পর্যবেক্ষণটা বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন। করোনা থেকে মুক্ত হওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এদেশে কলেরা, যক্ষা মহামারি অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। দীর্ঘ চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর মানুষ এ-সব মহামারি থেকে রক্ষা পেয়েছে। করোনাও এক সময় দূর হবে। কিন্তু মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না। তাই মৃত্যু পরবর্তী জীবনে আমরা যারা বিশ্বাসী হায়াত-মউতের মালিক সেই আল্লাহকে বেশি করে ভয় করি যিনি আমাদেরকে সুস্থতা দানের সাথে সাথে আখিরাতে নাজাতও দিতে পারেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দাহ হয়ে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন। ২০.১১.২০২০

Comments