জীব মাত্রই মৃত্যু রয়েছে। আল্লাহর ভাষায়,
‘প্রত্যেক প্রাণীই
মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবে’-সূরা আলে ইমরান ১৮৫। কী আস্তিক, আর কী
নাস্তিক কেউ তা অস্বীকার করে না। পার্থক্য হলো, আস্তিক মৃত্যু পরবর্তী জীবন বিশ্বাস
করে এবং সেই আলোকে সে দুনিয়ার জীবনটা পরিচালনা করে। মৃত্যু এজন্যই, যাতে নেক ও বদ আমলের
বিনিময়ে মানুষ জান্নাত বা জাহান্নাম ভোগ করতে পারে।
মৃত্যু এ দুনিয়ার সকল আনন্দ, ভোগ-বিলাস
মুহূর্তেই শেষ করে দেয়। মৃত্যুর কথা স্মরণ হলে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বাঁচার
জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। একজন কাফিরের জন্য মৃত্যু যতখানি ভয়ের, মু’মিনের জন্য ততখানি
নয়। এ দুনিয়ায় মু’মিনের নামায-রোযা ও সকল নেক আমলের পেছনে
একটিই লক্ষ্য, মৃত্যুর পরে সে যেন আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত পায়। জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য
ও জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব সম্পর্কে সে পুরোপুরি অবহিত; তাই মৃত্যুকে নয়, জাহান্নামের
আযাবকে সে ভয় পায়।
মু’মিন হয় সাহসী,
চলার পথে সব ধরনের সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করে সে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে
যায় এবং সে জানে মৃত্যুর বিষয়টি একান্তই আল্লাহর হাতে। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহই মানুষের
জীবন দেন, তিনি মানুষের মৃত্যু ঘটান এবং তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপের ওপর তিনি সার্বিক
দৃষ্টি রাখেন’- সূরা আলে ইমরান ১৫৬। সে আরো জানে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও
রোগ-মহামারি কোনো কিছুই তাকে মৃত্যু দিতে পারে না, যদি আল্লাহ না চান এবং জানে মৃত্যুর
সময় সুনির্দিষ্ট। আল্লাহর কথা, ‘কোনো প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া
মরতে পারে না। মৃত্যুর সময় তো লেখা আছে’- সূরা আলে ইমরান
১৪৫।
সূরা আলে ইমরানের বেশ কিছু আয়াত আমি এখানে
উদ্ধৃত করেছি। মূলত এই অংশটি উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অবতীর্ণ এবং এসব আয়াতে সেই
যুদ্ধেরই পর্যালোচনা করা হয়েছে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁরই সৃষ্ট এক অদৃশ্য শক্তি করোনাভাইরাসের
বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছেন। সেই যুদ্ধের সৈনিক হচ্ছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী,
ডাক্তার-নার্স-ত্রাণকর্মী-স্বেচ্ছাসেবক এবং তাদের সহযোগী হলেন দেশের জনগণ।
মহামারি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস বা বিপদ-মুসিবত
যাই বলি, তা নিজ থেকে আসে না, আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহর বাণী, ‘কোনো বিপদ কখনই
আসে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া’-সূরা তাগাবুন ১১। আল্লাহর ভাষায়,
এ সবই আমাদের হাতের কামাই। মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে এবং যমিনে অশ্লীলতা ও পাপাচার বেড়ে
যায় তখন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করার জন্য নানাবিধ বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন। করোনা
ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই লাখের
কাছে মানুষ মারা গেছেন। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এটিকে প্রতিরোধ
করার চেষ্টা করছে। একজন বিশ্বাসী হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, এই বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে,
তাই বৈষয়িক সকল ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদেরকে আল্লাহরই কাছে ফিরে আসতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মহামারি যেহেতু আল্লাহর
পক্ষ থেকে, সেহেতু সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা আল্লাহর কাছে ধর্ণা দিতে পারি এবং
নামায, রোযা ও দুআ-দরুদের মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য কামনা করতে পারি। কিন্তু এটি আল্লাহর
সুন্নাহর (নিয়ম) বিপরিত। মানুষ তো আল্লাহরই প্রতিনিধি। তাকে জ্ঞান-বুদ্ধি-যোগ্যতা দিয়ে
সকল সৃষ্টির ওপর ক্ষমতাবান করা হয়েছে। এজন্য প্রয়োজন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা
ও গবেষণা করা। পৃথিবীতে যত রোগ-ব্যাধি আছে, আল্লাহ তার আরোগ্যেরও ব্যবস্থা রেখেছেন।
সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টার পাশাপাশি যারা নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিতে পারবে তারাই
সফলকাম এবং তারাই হবে সৌভাগ্যের অধিকারী।
করোনা ভাইরাস একটি সংক্রামক ব্যাধি। ফলে
মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। কোনো বাসায় কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার সকল প্রিয়জন
তার থেকে পালিয়ে যাচ্ছে; এমন কি দাফন-কাফনেও শরীক হতে রাজী হচ্ছে না। আখিরাতের সেই
চিত্রই যেন পরিস্ফুট হচ্ছে। সেদিন আপনজনরা একে অপর থেকে পালাবে। এই করোনা ভাইরাস আল্লাহর
অনেক বান্দাকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে ফিরিয়ে এনেছে এবং অনেকে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগের
করে নেকির পাল্লাকে ভারি করতে সক্ষম হয়েছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা
ও সেবা-যত্ন এবং ত্রাণ বিতরণ সবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ বলেই সেখানে গেলে কি কারো
মৃত্যু অনিবার্য? মোটেই না, মৃত্যুর ফয়সালাটা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ারে। এ প্রসঙ্গে
আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা নিজেদের ঘরেও অবস্থান করতে তবুও যাদের মৃত্যু
লেখা হয়ে গিয়েছিল তারা নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো’-সূরা আলে ইমরান
১৫৪। আল্লাহ আরো বলেন, ‘এরা নিজেরা বসে থাকলো এবং এদের ভাই-বন্ধু
যারা লড়াই করতে গিয়ে নিহত হয়েছে তাদের সম্পর্কে বলে : যদি তারা আমাদের কথা মেনে নিতো
তাহলে নিহত হতো না। ওদের বলে দাও, তোমরা নিজেদের এ কথায় যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে
তোমাদের মৃত্যু যখন আসবে তখন তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে দেখিয়ে দিয়ো’- সূরা আলে ইমরান
১৬৮। মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহর স্পষ্ট উল্লেখ, এটি একান্তই তাঁর ইচ্ছাধীন। এখানে অন্য
কারো কোনো অংশ নেই। তাই নিজেদের পক্ষ থেকে সাধ্যমত সুরক্ষা গ্রহণ করেই এই পরিস্থিতির
মোকাবেলা করতে হবে। আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণে যারা এগিয়ে আসবে তাদের সুরক্ষা দানের
দায়িত্ব একান্তই আল্লাহর। কারণ রব হিসেবে সমগ্র সৃষ্টির লালন-পালন ও পরিচর্চার দায়িত্ব
আল্লাহর এবং তাঁর পক্ষে যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারা যথার্থই তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি)।
সাধারণ জনগণের সুরক্ষা হলো সামাজিক দূরত্ব
বজায় রাখা ও ঘরে অবস্থান। আমাদের সমাজে বস্তিতে অনেকে বসবাস করে ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত
হাজারো মানুষ চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে এবং তারা সবাই রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। অথচ অনেক
আগেই আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মহোদয় ও দুদকের
পরিচালক, বয়স পঞ্চাশেরও নীচে। আবার বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ও রজপরিবারের সদস্যসহ সমাজের
অনেক উঁচুস্তরের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি পালন ও সামাজিক
দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বলা যায়, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ০৮.০৪.২০২০
Comments
Post a Comment