রমযান আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তির মাস। বান্দার
অপরাধ ক্ষমা করার জন্য আল্লাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে
ব্যক্তি ঈমান ও এহতেছাবের সাথে রোযা রাখবে আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
এ মাসে আল্লাহ জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। মানুষের
চিরশত্রু শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। আল্লাহপাক প্রতি রাতেই নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ
করে তাঁর বান্দাদের ক্ষমা চাওয়ার জন্য আহবান জানাতে থাকেন। আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন,
ঐ ব্যক্তি হতভাগা যে রমযান মাস পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না। বান্দার
জন্য আল্লাহর ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত। ক্ষমা পেতে হলে প্রয়োজন গুনাহ থেকে তাওবা (ফিরে
আসা) করা এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ চান তাঁর
বান্দারা তাঁর গুণে গুণান্বিত হোক। মানুষ হবে উদার ও দরাজদীল এবং ক্ষমাশীল। কেউ জুলুমের
শিকার হলে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর পছন্দ প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা
করা। বলার ভঙ্গিটাও বেশ চমকপ্রদ। আল্লাহর ভাষায়, ‘অন্যায়ের প্রতিবিধান
সম পরিমাণ অন্যায়, কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর
জিম্মায়’ (আশ শূরা ৪০)।
ক্ষমা করে দাও তা নয়, কারণ প্রতিশোধ গ্রহণ তার অধিকার। মজলুম তার অধিকার খর্ব করে শত্রুকে
ক্ষমা করলে আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায় তাঁর বান্দাকে পুরস্কৃত করার। আর আল্লাহ যখন নিজেই
পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন কত দেবেন তা তিনিই জানেন।
ক্ষমা করার জন্য হৃদয়ের প্রশস্ততা প্রয়োজন।
কৃপণ ও সংকীর্ণমনা ব্যক্তি ক্ষমা করতে পারে না। সমস্ত কল্যাণ রয়েছে উদারতার মাঝে। আল্লাহর
বাণী, ‘যে স্বীয় মনের
সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’ (তাগাবুন ১৬)।
ক্ষমা প্রসঙ্গে রসুল (সা)-এর অনেক উক্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যে তার ভাইয়ের
দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবেন’। তিনি আরো বলেছেন,
‘যে তার ভাইয়ের
দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন’। তাঁর বহুল প্রচলিত
উক্তি, ‘যে দয়া করে না,
সে দয়া পায় না’।
এখন চলছে রমযান মাস। রসুল (সা) ছিলেন খুবই
উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী। তাঁর মত উদার দ্বিতীয় জন ছিল না। রসুল (সা) ও সাহাবায়ে
কেরাম এ মাসে আরো বেশি উদার হয়ে পড়তেন। দান-সাদাকা, দাসমুক্তি ও যে কোনো ভালো কাজ আরো
উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে করতেন। তিনি ছিলেন ক্ষমার আধার। ব্যক্তিগত কারণে তিনি কখনই প্রতিশোধ
গ্রহণ করেননি। কতভাবেই না তিনি নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন। ব্যক্তি হিসেবেও মাফ করেছেন
এবং সরকার প্রধান হিসেবেও করেছেন। যুদ্ধবন্দিদের সাথে তাঁর কোমল আচরণ এবং মক্কা বিজয়ের
পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে আছে। মূলত ক্ষমার কারণেই ইসলামের এত
প্রসার ও সমৃদ্ধি।
আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর এতো ওয়াজ-নছিয়তের
পরও আমাদের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। এখানে চলে প্রতিশোধ গ্রহণের বিভৎস কর্মকান্ড। ব্যক্তি
থেকে রাষ্ট্র সর্বত্রই। আমরা অতীতমুখিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। বিশ্বব্যাপী চলছে
করোনার তান্ডব (যা আমাদের হাতের কামাই) এবং আমরা সবাই মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছি। তার ওপর
চলছে রমযান মাস। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো পরিবর্তন নেই। এখানে হিংসার চাষ হয়।
পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেন আমরা আর মানুষ নই, হিংস্র
জন্তু-জানোয়ার। অথচ আল্লাহর রসুল (সা) কী বলেছেন? যার মধ্যে সর্ষেকণা হিংসা আছে তার
ঈমান নেই। আগুন যেমন শুকনা কাঠ জালিয়ে ভস্ম করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল
ধ্বংস করে দেয়। হিংসা কবিরা গুনাহ, এতটুকু নয় বরং হিংসা মানুষকে নেক আমল শূন্য করে
দেয়। হিংসুটে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত। তাই তিনি সূরা ফালাকে তাঁর বান্দাদের
শিখিয়েছেন হিংসুকের অনিষ্ট থেকে তাঁরই কাছে আশ্রয় চাইতে। আল্লাহপাক বিশেষ বিশেষ রাতে
(যেমন লাইলাতুল ক্কদর) তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন, কিন্তু ঐ হতভাগাকে নয় যার অন্তরে
হিংসা রয়েছে।
আমাদের কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও
বেশি বন্দি রয়েছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আজ ইউরোপের কারাগারগুলো কয়েদীর অভাবে
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর একটি মুসলিমপ্রধান দেশে কারাগারে ঠাঁই নেই। দেশের শাসক তো আল্লাহরই
প্রতিনিধি। আল্লাহপাক পবিত্র রমযান মাসে নাফরমান বান্দাদের ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতে
যাওয়ার সুযোগ করে দেন। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে কত নিরীহ-নিরপরাদ মানুষ কারাযন্ত্রণা
ভোগ করছেন, তার হিসেব নেই। অনেক পর্দানশিন নারী যারা জীবনে কোনো দিন একটি মানববন্ধনেও
অংশগ্রহণ করেন না, তারাও আজ কারাবন্দি। ঈমানদার মানুষকে কষ্ট দেয়া আল্লাহর কাছে বড়
ক্রোধ উদ্রেগকারী বিষয়। তাঁর নিজের কথা, ‘যারা ঈমানদার
নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তাওবা করে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে
ভস্ম হওয়ার শাস্তি’ (বুরূজ ১০)।
শুধু ইসলামের নয়, বিচারের স্বাভাবিক নিয়ম,
অপরাধী পালিয়ে যায় যাক, কিন্তু কোনো নিরপরাধী যেন শাস্তি না পায়। রমযান মাস, ক্ষমার
মাস, সহানুভূতি প্রকাশের মাস, এই মাসে আল্লাহপাক যেমন তাঁর বান্দাদের সাথে উদার আচরণ
করেন, মুসলিম সরকারগুলোও তাদের রব থেকে শিক্ষা নিয়ে নাগরিকদের সাথে ক্ষমা ও সহনশীলতার
আচরণ করতো, তাতে কতই না ভালো হত। তারাও লাভ করতে পারতো আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ। আল্লাহপাক
আমাদেরকে তাঁর বান্দাদের সাথে ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করার তাওফিক দান করুন।
Comments
Post a Comment