করোনা ভাইরাস
আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে। মৃত্যুর মিছিল
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৯,৩৫,৫৮২ জন এবং মৃত্যু
হয়েছে ৪৭,২৩২ জনের। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকায় করোনা আক্রান্ত রোগীর
সংখ্য ২,০৩,৬০৮ জন, মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার এবং একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড ১,০৪১ জন। আমেরিকার
সাথে ইউরোপের অবস্থাও বড় করুণ এবং ইউরোপে মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার। এক ইতালিতেই মারা
গেছেন ১৩,১৫৫ জন। করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে চলছে লকডাউন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড
স্থবির হয়েছে পড়েছে।
বর্তমানে করোনা
ভাইরাস বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশে ইউরোপ-আমেরিকার মত অবস্থা না হলেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে
পড়ার আশঙ্কায় গত ২৬ তারিখ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলছে সরকারি ছুটি ও লকডাউন। ফলে অর্থনৈতিক
কর্মকান্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। দেশের রপ্তানিমুখি শিল্প গার্মেন্টস খাতসহ সকল শিল্প-কারখানা
বন্ধ। পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণি
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শ্রেণির মানুষের হাতে কোনো ক্রয়ক্ষমতা নেই। তারা
বড় বিপদগ্রস্ত।
বিশ্ব অর্থনীতি
বিভিন্ন সময়ে মন্দার মুখোমুখি হয়েছে। খুব বড় মন্দা দেখা দিয়েছিল ১৯৩০-র দশকে যেটা ইতিহাসে
‘মহামন্দা’ নামে পরিচিত। সেই সময়ে আমেরিকা
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তাদের জাতীয় আয় এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছিল। মূলত সমাজে
মোট আয় ও ব্যয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার ফলেই মন্দা দেখা দেয়। সে সময়ে সমাধান নিয়ে এগিয়ে
আসেন সাড়া জাগানো অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস। তিনি সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির উপর জোর তাগিদ
দিয়েছিলেন।
বিরাট জনগোষ্ঠীর
ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় সামগ্রিক ব্যয় হ্রাস পায়। এটা মোকাবেলা করার জন্য সরকারি ব্যয়
বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার নানামুখি
কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূদের হার শূন্য করে ঋণদানকে
সহজ করেছে। দেশে দেশে সরকারসমূহ তাদের গরীব নাগরিকদের নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান শুরু
করেছে। পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকার পাঁচ
হাজার কোটি টাকা প্রদান করছেন যা মাত্র ২% হারে সার্ভিস চার্জসহ দুই বছরের মধ্যে পরিশোধ
করতে হবে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আবাসনসহ অন্যান্য খাতেও সহযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে
পড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয়তো পোশাক শিল্প শীঘ্রই খুলে দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও
ঋণদানের ক্ষেত্রে উদার নীতি অবলম্বন করছে। এ সবই ইতিবাচক দিক।
দেশের এই সংকটকালে
সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে।
এর কোনো বিকল্প নেই। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশি, এরা সমাজে দ্বিবিধ ভূমিকা পালন
করে। এক. এরা উৎপাদনের চাকাকে সচল রাখে, দুই. এরা উৎপাদিত জিনিস ভোগ করে সহযোগিতা করে।
ধনির তুলনায় দরিদ্র মানুষের ভোগপ্রবণতা বেশি। এরা যা আয় করে তার পুরোটাই বা বেশিই ব্যয়
করে বা বাধ্য হয়। এই শ্রেণির মানুষ দোকানে বাঁকি খেয়ে দিন শেষে বা সপ্তাহ শেষে বা মাস
শেষে পরিশোধ করে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য এই শ্রেণির মানুষের হাতে অর্থ তুলে
দিতে হবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, প্রাচুর্যের মাঝেও দারিদ্র
থাকতে পারে যদি তাদের ক্রয়ক্ষমতা না থাকে।
দরিদ্র মানুষের
ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ইসলাম যাকাত প্রদানকে বাধ্যতামূলক করেছে। যাকাত ধনিরা প্রদান
করে এবং অধিকার হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী পেয়ে থাকে। যাকাত দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে
দেয়, যেটা অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। আল্লাহর ভাষাও তাই, ‘আল্লাহ দান-সাদাকাকে ক্রমবৃদ্ধি
দান করেন আর সূদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন’। সূদের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক বিপরিত, পক্ষান্তরে ব্যয়বৃদ্ধির (সামগ্রিক
চাহিদা) সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক খুবই ইতিবাচক। যাকাত সমাজে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি
করে। ইসলামে শোষণের কোনো সুযোগ নেই। শোষণের সকল প্রক্রিয়া ইসলামে হারাম। সূদ, ঘুষ,
ওজনে কমবেশি করা, ধোকা-প্রতারণা, ভেজাল দেয়া, মজুদ করে মূল্যবৃদ্ধি সবই সুস্পষ্ট হারাম
এবং দন্ডযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্র এ সব অপরাধ শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করবে। সমাজে শোষণ বন্ধ
হলে আয়-বৈষম্য হ্রাস পাবে। তদুপরি যাকাত ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য আরো দূর করে।
ইসলাম তার অনুসারীদের
উদার ও প্রশস্ত হওয়ার জন্য জোর তাগিদ দেয়। সূরা বাকারার শুরুতেই মু’মিনদের অন্যান্য গুণাবলীর সাথে
উল্লেখ করা হয়েছে ‘কুরআন তাদের জন্যই হেদায়াত,আমরা যা রিজিক দিয়েছি যারা তা থেকে খরচ করে’। সমাজে ধনিক শ্রেণিকে অন্যান্যদের
তুলনায় বাড়তি সম্পদ প্রদান সেটা আল্লাহরই দান এবং আল্লাহ সেটি তাঁর পথে ব্যয় করার জন্য
বলেছেন। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের কল্যাণে সব ধরনের ব্যয়কে আল্লাহর পথে
ব্যয় বলা হয়। আবার আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের হক রয়েছে (সূরা
মায়ারিজ)। আল্লাহর পথে চলাকে দুর্গম পথ উল্লেখ করে সূরা বালাদে তিনি বলেছেন, ‘তুমি কি জানো সেই দুর্গম পথটি কি?
তা হচ্ছে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে কাউকে মুক্ত করা, অথবা দুর্ভিক্ষের দিন কাউকে খাবার
দেয়া, নিকটতম কোনো ইয়াতিমকে আহার পৌঁছানো, কিংবা ধুলোলুণ্ঠিত কোনো মিসকিনকে কিছু দান
করা’। দেশের
এই সংকট দূর করতে সবারই উদার মনোভাব নিয়ে তাঁর বান্দাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে
যার যা সামর্থ তাই নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর ঘোষণা, ‘জিজ্ঞেস করে, কী খরচ করবে? বলে
দাও, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত’। মু’মিনদের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তারা সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় খরচ করে’। রসুল (সা) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করো, কত
খরচ করলে তার হিসাব করো না, তহলে আল্লাহও বেহিসেবী দান করবেন’। আমরা নিজেদের জীবনে কিছুটা কৃচ্ছতা
অবলম্বন করে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশির সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারি।
আল্লাহর বান্দাদের প্রয়োজনে কেউ এগিয়ে আসলে আল্লাহ সেই বান্দার বিপদাপদ দূর করে দেন।
কুরআন-হাদিসে
দানের কথা অসংখ্যভাবে বলা হয়েছে। এখনই সময়, দেশের ধনিক শ্রেণির উদার হস্তে এগিয়ে আসার।
এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের জীবন। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহর পথে খরচ করো, নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংস করো না’। বাঁচতে চাইলে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে
হবে। লকডাউন করা হয়েছে, যার ঘরে খাবার নেই সে বের হবেই। আবার অভ্যাসগত দরিদ্রও আছে।
আমাদের গ্রাম পর্যন্ত সরকারি মেকানিজম রয়েছে-ইউনিয়ন পরিষদ এবং চেয়ারম্যান ও মেম্বর।
তাদের কাছে রয়েছে তালিকা। তালিকা ধরে তাদের কাছে খাবার পৌঁছাতে পারলে লকডাউন সহজেই
কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির কারণে আমাদের আস্থার জায়গাটি একেবারেই
ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ একজন মুসলিম হবে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক। দরিদ্রদের ত্রাণ, তা
থেকে চুরি হওয়া একজন মুসলমানের কাছে একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু সেটিই আজ বাস্তব।
করোনা ভাইরাস
আমাদের জীবনযাত্রায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। শুধু আমাদের সমাজেই নয়, বিশ্বব্যাপী
দেখা দিয়েছে এক পরিবর্তন। করোনার আঘাতটা বিশ্বের সম্পদশালী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
সব দিক দিয়ে সেরাদের উপরই বেশি পড়েছে। পারমানবিক শক্তিধর এ সব দেশের সরকার প্রধানদের
চরম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। যুদ্ধবাজদের যুদ্ধ উন্মাদনা হ্রাস পেয়েছে, বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুদের
উপর নিপীড়ন-নির্যাতন অনেক কমে এসেছে। একটি সৌহার্দ-সম্প্রীতি ও উদারতা দৃশ্যমান। আমার
বিশ্বাস, মানবতার জন্য করোনা ভাইরাস আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা। আমরা সবাই
আল্লাহর নাগালের মধ্যে। সবারই আল্লাহর দিকে ফিরে আসার এখনই সুযোগ।
এই মুহূর্তে
সরকারের ভূমিকাটি অনেক বড়। গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এটি একটি সুযোগ। জাতীয় দুর্যোগ
জাতীয়ভাবেই মোকাবেলা করা উচিত এবং আমাদের কর্তব্য, মহান আল্লাহর কাছে সামগ্রিকভাবে
তাওবা করা। একটি দিনকে সরকারের পক্ষ থেকে তাওবা দিবস হিসেবে ঘোষিত হতে পারে। আমরা এমন
এক আল্লাহতে বিশ্বাসী যিনি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক এবং কোনো বিষয়ে তিনি শুধু বলেন, ‘হও’ তাৎক্ষণিক সেটি হয়ে যায়। আমরা
আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা পুরোটাই কাজে লাগাবো, এই কাজে লাগানোটা আল্লাহর প্রতিনিধি
হিসেবে আমাদের করণীয় এবং এটিই আল্লাহর সুন্নাহ। এরপর আমরা আল্লাহরই উপর নির্ভর করবো
ও তাঁরই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো। কোনো জনপদের মানুষ যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
করে তাহলে সাধারণত আল্লাহ তাদের উপর কোনো বালা-মুসিবত দেন না এবং দিলেও ক্ষমা প্রার্থনার
কারণে তা হটিয়ে দেন। আল্লাহ আমাদেরকে করোনা ভাইরাস থেকে হেফাজত করুন। ০২.০৪.২০২০
Comments
Post a Comment