আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর দ্বীন
প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গকারীকে ইসলামের পরিভাষায় শহীদ বলা হয়। একজন শহীদের মর্যাদা অতি
উচ্চে দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। দুনিয়ায় সে বীরের মর্যাদায় মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা
ও ভালোবাসা পায়, আর আখিরাতে রয়েছে বিনা হিসাবে জান্নাত। দুনিয়ায় সুখি ও সুন্দর জীবনযাপনের
লক্ষ্যে আল্লাহপাক হেদায়াতসহ অসংখ্য নবী-রসুল প্রেরণ করেছেন। সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী
নবী-রসুলদেরকে কোনো সময়ই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। দুনিয়ার ইতিহাস
হলো হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব এবং এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন। কুরআন আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন
করেছে নমরুদের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম (আ), ফিরাউনের বিরুদ্ধে মুসা (আ) এবং আরব জাহিলিয়াতের
বিরুদ্ধে মুহাম্মদ (সা)-কে। দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা ঈমানদার
তারা আল্লাহর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায়, আর যারা কাফির তারা তাগুতের (খোদাদ্রোহীতা)
পথে চালায়, তোমরা শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করো, আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই
দুর্বল’।
হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে নিহত ব্যক্তিকে
মৃত বলতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহর ভাষায়, ‘যারা আল্লাহর
পথে নিহত হন তাদেরকে মৃত বলো না, তারা জীবিত, তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোনো চেতনা
নেই’। কখনো বলেছেন,
তারা রিজিকপ্রাপ্ত। কত আবেগভরা কথা। সন্তানহারা মাকে যেমন ছেলে মারা গেছে এ কথা বলা
যায় না, আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তি মারা গেছেন-এ কথা শুনতে আল্লাহ নারাজ। তাতে বোঝা
যায়, শহীদের প্রতি আল্লাহর রাজি-খুশি কতো, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। শুধু কী তাই?
তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টাকারীর সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষমা করে তাকে জান্নাত
দানের ঘোষণা দিয়েছেন।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আল্লাহর দ্বীন
প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টাকারী ও শহীদের মর্যাদা আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি। মানুষের প্রতি
আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ সীমা-সংখ্যাহীন। আল্লাহ অত্যন্ত উদার এবং তাঁর বান্দাদের মর্যাদা
দান ও ক্ষমা করার ক্ষেত্রে তাঁর মাঝে কোনো কার্পণ্য নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রসুল
(সা) আরো কয়েক শ্রেণির মানুষের শহীদের মর্যাদার কথা বলেছেন। যেমন, মহামারি ও প্রাকৃতিক
দুর্যোগে নিহত ব্যক্তি, সন্তান জন্মদানকালে নিহত মা, নিজ বা পরিবারের অধিকার প্রতিষ্ঠায়
নিহত ব্যক্তি, পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি, দেয়াল ধ্বসে বা দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তি ইত্যাদি।
আল্লাহপাক তাঁর মু’মিন বান্দাদের জান্নাতপ্রাপ্তির পথকে সহজ
করে দিয়েছেন।
সমগ্র বিশ্ব আজ করোনা মহামারিতে আক্রান্ত।
বিশ্বব্যাপী কোনো মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতোপূর্বে লক্ষ্য করা যায়নি। মহামারি
প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমরা মহামারি
আক্রান্ত এলাকায় যেও না, আবার মহামারি আক্রান্ত এলাকায় তোমরা অবস্থান করলে, সেখান থেকে
বের হবে না। আক্রান্ত এলাকায় ধৈর্যধারণ করে অবস্থান করবে এবং এ অবস্থায় তোমাদের মৃত্যু
হলে তোমরা শাহাদতের মর্যাদা পাবে’। সংক্রামক রোগ হিসেবে মহামারি
যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য তাঁর এত সতর্কতা। এ প্রসঙ্গে তিনি কঠোরভাবে সাবধান করেছেন,
যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া সম
অপরাধ।
৩১ ডিসেম্বর উহান শহরে করোনার সূত্রপাত
(বাংলাদেশে ৮ মার্চ, প্রথম মৃত্যু ১৮ মার্চ) এবং এই কয় মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে
প্রায় ২১ লক্ষ ৫৭ হাজার এবং মারা গেছেন ১ লক্ষ ৪৪ হাজার। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত
১৫৭২ এবং মৃত্যু ৬০। দ্রুত এর বিস্তার ঘটছে। করোনার বিস্তৃতি রোধ করার জন্য সারা বিশ্বে
চলছে লকডাউন। সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশেও চলছে সরকারি ছুটি।
ফার্মেসি ও সীমিত পরিমাণ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া বাজারঘাট ও সবধরনের পরিবহন বন্ধ।
মসজিদসহ সবধরনের উপাসনালয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিও বন্ধ।
করোনা এখন সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা
প্রতিরোধ করার জন্য হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি পালন ও ঘরে অবস্থানকে বাধ্যতামূলক করা
হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আমাদের সরকার তার নাগরিকদের ঘরে অবস্থানের জন্য উদ্বুদ্ধকরণসহ
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োগ দিয়েছেন। কে করোনা আক্রান্ত, এখন আর আমাদের জানা নেই, ঘর
থেকে বের হওয়া অর্থ মহামারি উপদ্রুত এলাকায় যাওয়া। এজন্য ঘরে অবস্থান করাটাই হবে সুন্নাতের
ওপর আমল। ঘরে থাকলে আমরা করোনায় আক্রান্ত হবো না এমনটি নয়। মৃত্যুটা আল্লাহর হুকুম,
সতর্ক ও সাবধান থাকাটাও আল্লাহর হুকুম। এমতাবস্থায় মৃত্যু হলে সেটা হবে শহীদের মৃত্যু।
করোনায় আক্রান্ত লোকদের চিকিৎসার সাথে
ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জরুরী সেবা চালু রাখা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও
দুস্থদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া কাজে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি করোনায় আক্রান্ত
হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসহ সতর্কতার সাথে
তারা দায়িত্ব পালন করছেন এবং এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।
হাদিসে আবার এমনও বলা হয়েছে, ছোঁয়াছে বা কুলক্ষণ বলে কিছু নেই। হাদিস ঘটনাকেন্দ্রিক।
এই হাদিসটি আমাদেরকে সাহস যোগাবে। বান্দার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পর
সে তার রবের কাছে নিজেকে সঁপে দিবে। আল্লাহ তাকে অভয় বাণী শুনিয়েছেন, ‘কোনো বিপদ কখনো
আসে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া’। মৃত্যুর সময়ও সুনির্দিষ্ট। এক
সেকেন্ড আগেও না পরেও না। তকদিরের প্রতি বিশ্বাস একজন বিশ্ববাসীকে সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব
পালনে উদ্বুদ্ধ করে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেউ যদি মারা যান তাহলে সে যথার্থ শহীদের
মর্যাদা পাবে। আবার ঘরে অবস্থান করেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রেও
তিনি শহীদ।
এখন প্রশ্ন, কেউ যদি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে
ঘুরাঘুরি করে করোনা আক্রান্ত হয় ও ছড়িয়ে দেয় এবং এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে কি সে শহীদের
মর্যাদা পাবে না খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে? বিষয়টি বড় জটিল। করোনার বিস্তার ঠেকানোর
জন্য সাধারণ মানুষের ঘরে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন সকালে বাজার করে টাটকা
শাক-সব্জি খাওয়ার এখন এটি সময় নয়। বিকেলে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে
ফাঁকি দিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া, যখন-তখন ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাইরের পরিবেশ দেখা
মোটেই যথার্থ নয়। এ সব শুধু নিয়ম লঙ্ঘনই নয়, এগুলো সবই গুনাহের কাজ। কোনো মানুষের অধিকার
নেই তার নিজের ক্ষতি করা বা অপরের ক্ষতি করা।
দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর এবং সরকার বেশ কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ সব নির্দেশনা মেনে চলা নাগরিকদের
ওপর অত্যাবশ্যক (ফরজ), এর অন্যথা ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। করোনার এই মহামারি থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য সকলের সমন্বিত উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের আলেম সমাজ
ইতিবাচক বক্তব্য রেখে করোনা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং তা অব্যাহত
রেখেছেন। তাঁরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমার এ লেখা কোনো ফতোয়া নয় এবং আমি তার যোগ্যও
নই। এটি আমার উপলব্ধি এবং একটি একাডেমিক আলোচনা মাত্র। ১৭.০৪.২০২০
Comments
Post a Comment