জুমা আলোচনা
কাজিপাড়া জামে মসজিদ
তারিখ : ০৬.১০.২০২৩
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
কাজিপাড়া জামে মসজিদ, অনেক প্রাচীন মসজিদ, বয়স আটষট্টি বছর (১৫ই জুন ১৯৫৫ সনে প্রতিষ্ঠিত), অথচ ইতোপূর্বে আমার যাওয়া হয়নি। আজই প্রথম জুমা আদায়। আমার একটু বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। খতিব মহোদয় খুতবা দানরত অবস্থায় আমি উপস্থিত হলে মুয়াজ্জিন সাহেব খতিব মহোদয়কে কানে কানে বললে খতিব মহোদয় আমাকে আলোচনা করার সুযোগ দান করেন। খতিব মহোদয়ের সাথে আজই আমার প্রথম পরিচয়। অবশ্য তিনি আমার আব্বাকে চিনতেন।
মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আফিল উদ্দিন সরদার (১৯০৭-২৬.০৭.১৯৯৮) নিজ বাড়ির আঙিনায় জমি দান করে এই মসজিদটি গড়ে তুলেন। তাঁর মেজ ছেলে জনাব মতিউর রহমান (মুকতার) বর্তমানে মসজিদের সভাপতি এবং সেক্রেটারি ও ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে জনাব মো. হাফিজুর রহমান ও জনাব মো. জিয়াউল হক। এর পূর্বে সুদীর্ঘ দশ বছর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এলাকার বিশিষ্ট সমাজকর্মী জনাব মো. মোফাককার হোসেন (বাবুল ডাক্তার)। তাঁর সময়ে মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার করা হয় এবং দ্বিতল মসজিদ করে উপর-নিচ পুরোটাই টাইলস, বাথরুম, ওজুখানা সবমিলে এক দৃষ্টিনন্দন মসজিদে রূপ নেয়। মসজিদকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার পর ২০১৯ সনে জনাব বাবুল ডাক্তার সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে বর্তমানে মসজিদকেন্দ্রিক জীবন পরিচালনা করছেন এবং মসজিদের অবৈতনিক মুয়াজ্জিন হিসেবে সেবা করছেন।
মসজিদের পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে পরিবারের কিছু সদস্যসহ মরহুম আফিল উদ্দিন সরদার শায়িত আছেন। তাঁর পরিবার আমাদের ইউনিয়নে এক সমৃদ্ধ পরিবার এবং ডাক্তার পরিবার হিসেবে পরিচিত। নামাজ শেষে সভাপতি ও খতিব মহোদয়, মুয়াজ্জিন সাহেব এবং কিছু মুসল্লিসহ আমরা কবর জিয়ারত করে তাঁদের মাগফেরাত কামনা করি।
সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য -
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
গ্রামে সম্প্রতি বেশ কিছু মসজিদে নামাজ আদায় করেছি। অনেক মসজিদে আমিই প্রথম উপস্থিত হয়েছি। অধিকাংশ মসজিদে মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। কিন্তু আপনাদের মসজিদ তার ব্যতিক্রম। মসজিদ মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে আছে। মসজিদের প্রাণ মুসল্লি এবং এতেই মসজিদের সৌন্দর্য। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় একটি উট কুরবানি করার। অথচ মসজিদে জুমার দিন প্রথম উপস্থিত ব্যক্তি একটি উট কুরবানির সওয়াব পেয়ে থাকেন। আগমনের ভিত্তিতে ফেরেশতারা উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াব লিখতে থাকেন এবং খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পরপরই তাঁরা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। আমি লক্ষ করলাম, আপনারা অধিকাংশই খতিব মহোদয়ের মিম্বরে বসার পূর্বেই উপস্থিত হয়েছেন। আলহামদু লিল্লাহ। আপনাদেরকে জানাই অভিনন্দন।
আপনারা মসজিদ নির্মাণ করেছেন এই আশায় যে আল্লাহপাক জান্নাতে আপনাদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিবেন। সেই ঘর কিন্তু তালাবদ্ধ থাকবে। তালা খুলে প্রবেশের জন্য যে চাবি সেটি হলো নামাজ। নামাজে অবহেলা করে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু জুমা নয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করা আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি ফরজ করেছেন। জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সা. জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি তাঁর অন্ধ সাহাবি উম্মে মাকতুম রা.-কেও একাকী নামাজ পড়ার সুযোগ দেননি। তিনি বলেছেন, আজান শুনে যারা ঘরে বসে থাকে, আমার ইচ্ছা হয়, আমার এখানে আর কেউ ইমামতি করুক আর আমি গিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেই। দেই না শুধু এ কারণে যে সেখানে নারী ও শিশু থাকে। আপনারা এতক্ষণ খতিব মহোদয়ের রসুলুল্লাহ সা.-এর দয়া ও মহানুভবতার কথা শুনছিলেন। আমাদের বোঝা উচিত, রহমাতুল্লিল আলামিন কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে চাইলে তাদের কি আর কিছু থাকে? আলী রা. বলেন, মসজিদের যারা প্রতিবেশী তাদের মসজিদেই নামাজ আদায় করতে হবে। মাইকের কারণে আজান না শোনার মতো এখন আর কেহ নেই। রসুল সা. বলেছেন, আমাদের ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য হলো ফজর ও এশার সালাতে হাজির হওয়া। আবার বলেছেন, যারা এশা ও ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করে তাদের সারাটি রাত ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হয়। আপনারা নামাজ ছাড়বেন না, আশা করা যায় নামাজে কোনো অবহেলা না করলে জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
এখন আর নবি-রসুল নেই এবং আসবেনও না। তাঁদের অবর্তমানে নবিদের দায়িত্ব পালন করেন আলেম সমাজ। রসুলুল্লাহ সা. আলেমদের তাঁর ওয়ারিশ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আলেমগণ হলেন নবিদের ওয়ারিশ। নবিগণ কোনো দিনার বা দিরহাম মিরাসরূপে রেখে যান না; তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’- সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৩। আমার সন্তান আমার উত্তরাধিকার। নিশ্চয়ই আমার সন্তানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমি কষ্ট পাবো। তাই কোনো আলেমকে যদি কেউ কষ্ট দেয় বা তার সাথে অসদাচরণ করে তাহলে বুঝতে হবে রসুল্লাহ সা.-এর প্রতি তার কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। শুধু তাই নয়, তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসাও নেই। আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট উল্লেখ, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয় অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’- সুরা বুরুজ ১০। ‘অতঃপর তওবা করে না’- এই কথার মধ্যে ফিরে আসার একটা সুযোগ রয়েছে। অতীতের গুনাহ থেকে তওবা করলে সে আর শাস্তিযোগ্য থাকে না।
গ্রামের মসজিদগুলোয় ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকে সামান্যই সম্মানী প্রদান করা হয়। আসলে সম্মানী দেয়ার মতো সামর্থও মসজিদ কমিটির নেই। আমরা আমাদের শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে লাউ হয়েছে প্রথম লাউটি ইমাম সাহেবের, মুরগির ডিম, গরুর দুধ, নারিকেল যা কিছু বাড়িতে হয়েছে আল্লাহর ঘরের খেদমতে যারা নিয়োজিত তাদেরকে প্রদান করে মানুষ তৃপ্তি লাভ করেছে। সাহাবায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-কে অন্তর থেকে মুহাব্বাত করতেন এবং তাঁকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে পরম তৃপ্তি পেতেন। এখন নবি নেই, কিন্তু নবির ওয়ারিশ আলেমদের প্রতি উত্তম ব্যবহারের বিনিময়ে সেই সওয়াব আপনারাও লাভ করতে পারেন।
দানের ক্ষেত্রে মসজিদ আবাদকারী আলেমদের অগ্রাধিকার দিবেন এবং এটা আল্লাহরই কথা। তাঁর বাণী, ‘দান-সদকা প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- বাকারা ২৭৩। মসজিদগুলোর আয়ের কোনো উৎস নেই। আপনাদের দানই মসজিদের আয়। আপনারা উদার হাতে দান করবেন, বিনিময়ে আল্লাহও আপনাদের বেহিসেবী দান করবেন। আমি ঢাকায় একটি মসজিদ সম্পর্কে জানি যাদের এক জুমায় দানবাক্সে আদায় দুই লক্ষ ছাব্বিশ হাজার টাকা। তাই আমরা আল্লাহর পথে খরচের ক্ষেত্রে একটু উদার হই। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে ব্যয় করাকে সহজ করে দিন।
আল্লাহ সৎ কাজে তাঁর বান্দাদের প্রতিযোগিতা করার কথা বলেছেন। তাঁর বাণী, তোমরা দৌড়াও তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিন সমান এবং তা প্রস্তত করা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্য। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় খরচ করে, যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়; আল্লাহ মুহসিন বান্দাদের ভালোবাসেন। সুরা আলে ইমরান ১৩৩-১৩৪।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের আহবান জানিয়েছেন নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও জান্নাত প্রাপ্তির জন্য প্রতিযোগিতা করতে। মানুষ কতো কিছুর জন্যই না প্রতিযোগিতা করে-অর্থবৃত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ইত্যাদি।
জান্নাতের বিশালতা বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সেই জান্নাতের প্রশস্ততা আসমান ও জমিন সমান। আর আল্লাহর এই বিশাল জান্নাত কেবল মুত্তাকিদের জন্য। আর মুত্তাকি বান্দাদের অনেক গুণের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এখানে বলা হয়েছে, তারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা উভয় অবস্থায় আল্লাহর পথে খরচ করে। কৃপণ, অর্থলিপ্সু ও সংকীর্ণমনাদের জন্য জান্নাত নয়।
দ্বিতীয় গুণের কথা বলা হয়েছে, ক্রোধ সংবরণ করে। ক্রোধ বড়ো সর্বনাশা। ক্রোধের কারণেই মানুষ মানুষের প্রতি জুলুম করে, পশুর মতো হিংস্র হয়ে উঠে, সম্পর্ক নষ্ট করে। এমনকি নিজের প্রতি জুলুমের সকল সীমা লঙ্ঘন করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাই ক্রোধ মানুষের চরম শত্রু। ক্রোধের উদ্রেগ হলে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসা, বসা থেকে শোয়া এবং অজু করার কথা হাদিসে বলা হয়েছে।
তৃতীয় গুণের কথা বলা হয়েছে যে মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে, রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দৌড়াও। কোনো মানুষ তার আমল দ্বারা জান্নাতে যাবে না। নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করবেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের একে অপরকে ক্ষমা করার কথা বলেছেন এবং ক্ষমার বিনিময়ে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। হাদিসে স্পষ্ট করা হয়েছে, যে তার ভাইকে ক্ষমা করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে ক্ষমা করবেন। যারা ক্ষমা করে তারা দুনিয়ার জীবনেও সম্মান লাভ করে। ক্ষমা, উদারতা, মানবিক মূল্যবোধের কারণে নেলসন ম্যান্ডেলা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আর আমরা হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধপরায়ণতার কারণে বিশ্বব্যাপী ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়াচ্ছি। বিশেষ বিশেষ দিনে আল্লাহ তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। বাদ পড়ে কেবল মুশরিক ও হিংসুক। রসুলুল্লাহ সা.-এর উক্তি- আগুন যেমন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়।
আল্লাহপাক তাঁর মুত্তাকি বান্দাদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। মুহসিনদের মর্যাদা হবে আরো উচ্চতর। সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হলো তারা যারা আল্লাহর পথে ব্যয়কারী, ক্রোধ সংবরণকারী ও ক্ষমাকারী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর মুহসিন বান্দা হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment