Skip to main content

ফিলিস্তিনের মজলুম ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানের দাবি

 জুমা আলোচনা

বাঁশেরদিয়াড় আল হেরা জামে মসজিদ

তারিখ : ১৩.১০.২০২৩

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

বাঁশেরদিয়াড় আল হেরা জামে মসজিদ, খুব প্রাচীন না হলেও একেবারে কম নয়, বয়স ২৬ বছর (২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সনে প্রতিষ্ঠিত), অথচ বাড়ির নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও আজই আমার প্রথম জুমা আদায়। আমার  স্নেহধন্য নাহিদের আমন্ত্রণে আজ সেখানে নামাজ আদায় ও কিছু কথা বলার সুযোগ হয়।  

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মকছেদ আলী ড্রাইভার মসজিদের আঙিনায় চিরদিনের জন্য শায়িত আছেন। আমরা তাঁর মাগফেরাত কামনা করি। বর্তমানে মসজিদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আমার একান্ত স্নেহধন্য জনাব মো. ছাইদুর রহমান এবং সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এক ভাইপো  জনাব আবু সাঈদ (ইউপি মেম্বর)। মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ কামনা করি।

সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য -

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

গ্রামে বেশ কিছু মসজিদে আমি নামাজ আদায় করেছি। সম্প্রতি প্রচুর মসজিদ গড়ে উঠেছে। আল্লাহর ঘর শুরু করলে স্বল্প সময়ের মধ্যে তা সুন্দর মসজিদে রূপ নেয়। আলহামদু লিল্লাহ।

অধিকাংশ মসজিদে মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। কিন্তু আপনাদের মসজিদে মুসল্লি সংখ্যা ভালো। গ্রামে দোতলা মসজিদ মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে যাওয়া খুবই খুশির কথা। মসজিদের প্রাণ মুসল্লি এবং এতেই মসজিদের সৌন্দর্য।

জুমার দিন আমাদের ঈদের দিন। ঈদের দিনের মতো সকাল সকাল গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আমরা মসজিদে উপস্থিত হবো ইনশা-আল্লাহ। এদিনে আমাদের কাজ হলো আজানের সাথে সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দু'রাকাত নামাজ আদায় করে মিম্বরের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা। এতো মনোযোগ দিতে হবে যে, পাশে যদি কেউ কথা বলে, ভাই চুপ করো তাও বলা যাবে না।

আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় একটি উট কুরবানি করার। অথচ জুমার দিন মসজিদে প্রথম প্রহরে উপস্থিত ব্যক্তি একটি উট কুরবানির সওয়াব পেয়ে থাকেন। আগমনের ভিত্তিতে ফেরেশতারা উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াব লিখতে থাকেন এবং খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের পরপরই তাঁরা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। আপনাদের আরো একটি সুখবর দেই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে কিয়ামতের দিন মানুষ আসন গ্রহণ করবে মসজিদে উপস্থিতির ভিত্তিতে। দুনিয়ায় যারা মসজিদে প্রথম দিকে আসন গ্রহণ করেন কিয়ামতের দিনও আরশের ছায়ায় তাদের আসন হবে অগ্রভাগে।  

আপনারা মসজিদ নির্মাণ করেছেন এই আশায় যে আল্লাহপাক জান্নাতে আপনাদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিবেন। সেই ঘর কিন্তু তালাবদ্ধ থাকবে। তালা খুলে প্রবেশের জন্য যে চাবি সেটি হলো নামাজ। নামাজে অবহেলা করে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু জুমা নয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করা আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করেছেন এবং  জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে রসুল সা. জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি তাঁর অন্ধ সাহাবি উম্মে মাকতুম রা.-কেও একাকী নামাজ পড়ার সুযোগ দেননি। তিনি বলেছেন, আজান শুনে যারা ঘরে বসে থাকে, আমার ইচ্ছা হয়, আমার এখানে আর কেউ ইমামতি করুক আর আমি গিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেই। দেই না শুধু এই কারণে যে, সেখানে নারী ও শিশু থাকে। আমাদের বোঝা উচিত, রহমাতুল্লিল আলামিন কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে চাইলে তাদের আর কি কিছু থাকে? আলী রা. বলেন, মসজিদের যারা প্রতিবেশী তাদের নামাজ মসজিদেই আদায় করতে হবে। মাইকের কারণে আজান না শোনার মতো এখন আর কেহ নেই। রসুল সা. বলেছেন, আমাদের ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য হলো ফজর ও এশার সালাতে হাজির হওয়া। আবার বলেছেন, যারা এশা ও ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করে তাদের সারাটি রাত ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হয়। আপনারা নামাজ ছাড়বেন না, আশা করা যায় নামাজে কোনো অবহেলা না করলে জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

এখন আর নবি-রসুল নেই এবং আসবেনও না। তাঁদের অবর্তমানে নবিদের দায়িত্ব পালন করেন আলেম সমাজ। রসুলুল্লাহ সা. আলেমদের তাঁর ওয়ারিশ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আলেমগণ হলেন নবিদের ওয়ারিশ। নবিগণ কোনো দিনার বা দিরহাম মিরাসরূপে রেখে যান না; তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’- সুনানে আবু দাউদ ৩৬৪৩। আমার সন্তান আমার উত্তরাধিকার। নিশ্চয়ই আমার সন্তানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমি কষ্ট পাবো। তাই কোনো আলেমকে যদি কেউ কষ্ট দেয় বা তার সাথে অসদাচরণ করে তাহলে বুঝতে হবে রসুল্লাহ সা.-এর প্রতি তার কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। শুধু তাই নয়, তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসাও নেই।  

গ্রামের মসজিদগুলোয় ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকে সামান্যই সম্মানী প্রদান করা হয়। আসলে সম্মানী দেয়ার মতো সামর্থও মসজিদ কমিটির নেই। আমরা আমাদের শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে লাউ হয়েছে প্রথম লাউটি ইমাম সাহেবের, মুরগির ডিম, গরুর দুধ, নারিকেল যা কিছু বাড়িতে হয়েছে আল্লাহর ঘরের খেদমতে যারা নিয়োজিত তাদেরকে প্রদান করে মানুষ তৃপ্তি লাভ করেছে। সাহাবায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-কে অন্তর থেকে মুহাব্বাত করতেন এবং তাঁকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে পরম তৃপ্তি পেতেন। এখন নবি নেই, কিন্তু নবির ওয়ারিশ আলেমদের প্রতি উত্তম ব্যবহারের বিনিময়ে সেই সওয়াব আপনারাও লাভ করতে পারেন।

 মসজিদগুলোয় আয়ের কোনো উৎস নেই। আপনাদের দানই মসজিদের আয়। আপনারা উদার হাতে দান করবেন, বিনিময়ে আল্লাহও আপনাদের বেহিসেবী দান করবেন। আমি ঢাকায় একটি মসজিদ সম্পর্কে জানি যাদের এক জুমায় দানবাক্সে আদায় দুই লক্ষ ছাব্বিশ হাজার টাকা। তাই আমরা আল্লাহর পথে খরচের ক্ষেত্রে একটু উদার হই। আল্লাহপাক আমাদের তাঁর পথে ব্যয় করাকে সহজ করে দিন।

আল্লাহ তায়ালা পিতামাতার সাথে সদাচরণের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সাথে পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণের কথা বলেছেন। পিতামাতা উভয়ই বা কোনো একজন যদি জীবিত থাকেন তাহলে তাদের সাথে উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। সবসময় তাঁদের প্রতি বিনয়ী থাকতে হবে। তাঁরা কষ্ট পান এমন কোনো আচরণ করা যাবে না। বাবা-মার বার্ধক্য অবস্থায় তাঁদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। সন্তানের শৈশাবস্থায় পিতা -মাতা যেভাবে যত্ন করে লালনপালন করেছেন সেটিকে স্মরণে রেখে বাবা-মার সাথে তেমন আচরণ করতে হবে। মানুষ মারা গেলে তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কয়েকটি আমল চলমান থাকে। সদকায়ে জারিয়া, যেমন আপনারা মসজিদ নির্মাণ করেছেন। আর একটি হলো নেক সন্তানের দোয়া। যিনি দোয়া কবুল করবেন তিনি বাবা-মার জন্য দোয়া করার কথা বলার সাথে সাথে দোয়া করার ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন। রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা। এই দোয়া ব্যর্থ হতে পারে না।

শুধু বাবা-মা নয় আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের সাথে সদাচরণ করতে হবে। সদাচরণ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও গিবত ছাড়তে হবে। রসুলুল্লাহ সা. মসজিদে বসাবস্থায় জনৈক সাহাবির আগমন দেখে বলেন, এইমাত্র যাকে প্রবেশ করতে দেখলে সে জান্নাতি। এভাবে একই ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি পরপর তিনদিন বলেন এবং তাঁর এ কথার প্রেক্ষিতে একজন সাহাবির মাঝে উৎসুক্য জাগে। তিনি সেই সাহাবির বাড়িতে তিনদিনের জন্য মেহমান হয়ে বাড়তি ইবাদত-বন্দেগি কিছুই লক্ষ করলেন না। অবশেষে সেই সাহাবিকে জিজ্ঞেস করলেন, রসুল সা. আপনাকে পরপর তিনদিন জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। আপনার এমন কী আমল যার জন্য আপনি এতো সৌভাগ্যের অধিকারী হলেন।সেই সাহাবি বললেন, ভাই আমার তো এমন কোনো আমল নেই, তবে ঘুমানোর আগে আমি সবাইকে মাফ করে দেই, আর কারো প্রতি আমার কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই। সেই সাহাবি বুঝলেন, এমন আমলের কারণেই সে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। আপনারাও মানুষকে ক্ষমা করবেন তাহলে আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমা করবেন। এটি হাদিসের কথা, 'যে তার ভাইকে ক্ষমা করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে ক্ষমা করবেন।' আবার বলেছেন, 'যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন করে রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।' গিবত জঘন্য অপরাধ। মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে আল্লাহ তুলনা করেছেন। হদিসে বলা হয়েছে, গিবত জেনা অপেক্ষাও জঘন্য। গিবত, মিথ্যাবলা ও হিংসা-বিদ্বেষ ছাড়তে পারলে জান্নাতে যাওয়া কঠিন হবে না। আল্লাহপাক বিশেষ বিশেষ দিনে ও রাতের শেষাংশে তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন কিন্তু করেন না কেবল মুশরিক ও হিংসুককে। আল্লাহ তায়ালা সুরা ফালাকে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে আমাদের সাহায্য চাওয়ার কথা বলেছেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়। তাই আমরা যদি জান্নাতের প্রত্যাশা করি তাহলে অবশ্যই আমাদের হিংসা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। 

ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আমি আপনাদের কিছু বলতে চাই। পৃথিবীতে ওরাই সবচেয়ে নির্যাতিত। সত্তরটি বছর ধরে তারা নিজেদের আবাসভূমি অভিশপ্ত ইহুদি কর্তৃক বেদখল অবস্থায় রয়েছে। এই ফিলিস্তিন হাজারো নবি-রসুলদের স্মৃতিবিজড়িত এবং মসজিদুল আকসা আমাদের প্রথম কেবলা, তা আজ অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র কর্তৃক পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ও মুসলমানরা নামাজে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই ইহুদিরা আল্লাহর অসংখ্য নবি ও রসুলকে হত্যা করেছে। মদিনায় আমাদের প্রিয়তম নবি সা.-কে হত্যাসহ নানাবিধ ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। শেষে মুহাম্মদ সা. তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তারা দীর্ঘদিন উদ্বাস্তু জীবন যাপনের পর বৃটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে জোরজবরদস্তি করে একটি ভূখণ্ড দখল করে ক্রমাগতভাবে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে নিজেদের সীমানা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে।

প্রতিনিয়ত ইসরাইলের দ্বারা ফিলিস্তিনি নারী- শিশু-বৃদ্ধ হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে ইসরায়েলের কারাগারে পাঁচ সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছে। বন্দিদের মুক্তি এবং দীর্ঘ জুলুম-নির্যাতনের বদলা গ্রহণের লক্ষ্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে। ইসরায়েলের পক্ষে ইউরোপ-আমেরিকা ও ইসলামের সকল শত্রু প্রকাশ্যে সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে। একা ফিলিস্তিনের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন মুসলিমবিশ্বের প্রকাশ্যে সমর্থন ও সহযোগিতা। আমি মনে করি তাদের পক্ষে সোচ্চার হওয়া, তাদের সহযোগিতা করা আমাদের ঈমানের দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফিলিস্তিনি মজলুম ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।

Comments