জুমার খুতবা১
১.১১.২০২২
আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর উল্লেখ করেন যে গত জুমায় তিনি আল্লাহর স্মরণ প্রসঙ্গে সুরা ত্বহা ১২২-১২৬ নং আয়াত আলোচনা করেছিলেন। আজকে একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন রসুলুল্লাহ সা.- এর আনুগত্য প্রসঙ্গে আজ তিনি আলোচনা করবেন। রসুল সা. এরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি কিতাবুল্লাহ আল কুরআন এবং অন্যটি আমার সুন্নাহ’- (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। তিনি বলেন, আমাদের জীবনে কুরআনের পাশাপাশি রসুল সা.-এর সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে এবং সেই অনুসরণের কথা স্বয়ং আল্লাহপাক তাঁর কিতাবে বলেছেন। সুরা হাশরের ৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘রসুল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থেকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, নবি সা. বলেছেন, ‘আমি কোনো বিষয়ে তোমাদের নির্দেশ দিলে তা যথাসাধ্য পালন করো আর যে বিষয়ে বিরত থাকতে বলি তা থেকে দূরে থেকো’- বুখারি ও মুসলিম।
আল্লাহর হুকুম পালনের পাশাপাশি রসুল সা.-এর হুকুম একসাথে পালনের নির্দেশ প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘এবং আল্লাহ ও রসুলের হুকুম মেনে নাও, আশা করা যায় তোমাদের ওপর রহম করা হবে’- সুরা আলে ইমরান ১৩২। তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করবে সে তাদের সহযোগী হবে, যাদেরকে আল্লাহ পুরস্কৃত করেছেন- নবি, সিদ্দিক, শহিদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। মানুষ যাদের সঙ্গ লাভ করতে পারে তাদের মধ্যে এরা কতই না চমৎকার সঙ্গী’- সুরা আন নেসা ৬৯। আল্লাহপাক তাঁর রসুল সা.-কে মুমিনদের জন্য মডেল হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিনের আকাঙ্ক্ষী এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে’- সুরা আহজাব ২১। জীবনের কোনো বিশেষ দিক নয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল দিকে রসুলুল্লাহ সা.-কে মানতে হবে এবং যে পরিপূর্ণভাবে মানতে পারবে সেই প্রকৃত মুসলমান।
আল্লাহপাক তাঁর কিতাবে নানাভাবে আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্যের কথা বলেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করবে, তাকে তিনি জান্নাতে দাখিল করাবেন, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যাবে তিনি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন’- সুরা ফাতহ ১৭। আরো বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসুলের আনুগত্য করো। আর তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না’- সুরা মুহাম্মদ ৩৩। আল্লাহর বাণী, ‘যে রসুলের আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে মুখ ফিরয়ে নিলো, তবে আমি তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি’- সুরা নেসা ৮০। রসুলের আনুগত্য না করাকে আল্লাহপাক কুফরি বলেছেন, ‘বলুন, আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালোবাসেন না’- সুরা আলে ইমরান ৩২। আল্লাহর বাণী, ‘তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং আমরা আনুগত্য করেছি; অতঃপর তাদের একদল মুখ ফিরে নেয় এবং তারা বিশ্বাসী নয়’- সুরা নুর ৪৭। কাফেরগণ আল্লাহর রসুলের আনুগত্য করতে রাজি ছিল না এবং তাদের কথা ছিল- ‘যদি তোমরা তোমাদের মতই একজন মানুষের আনুগত্য করো, তবে তোমরা নিশ্চিতরূপেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’- সুরা মুমিনুন ৩৪। এককভাবে আল্লাহর রসুলের আনুগত্যের কথাও বলা হয়েছে, ‘নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং রসুলের আনুগত্য করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে’- সুরা নুর ৫৬। এতে স্পষ্ট যে যারা রসুলুল্লাহ সা.-এর আনুগত্য বা হাদিস মানতে অস্বীকার করবে তারা বড়ো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। হ্যাঁ, কুরআনের পরিপন্থী যদি কোনো হাদিস হয়ে থাকে তবে সেটা হাদিসই নয়, সেটা মানা যাবে না। কিন্তু আমরা কুরআন মানি, হাদিস মানি না- এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য প্রসঙ্গে আরো কিছু আয়াতসমূহ- সুরা নেসা ১৩, ৮০, সুরা নুর ৫২, ৫৪, সুরা আলে ইমরান ৫৩, ১৩২, সুরা মায়িদা ৯২, সুরা আহজাব ৩১, ৩৩, ৭১, সুরা মুজাদিলাহ ১৩, সুরা তাগাবুন ১২।
খতিব মহোদয় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মাঝে হাদিস অস্বীকারকারী একদল ফেতনাবাজের উদ্ভব হয়েছে যারা নিজেদেরকে আহলে কুরআন বলে পরিচয় দেন। শুনতে ভালো লাগে কিন্তু মাকাল ফল। তিনি একটি উদাহরণ দেন এই বলে, এক বাটপার এলাকায় এসে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বলে তাকে কোনো কাজ দিলে সে নিষ্ঠার সাথে পালন করবে। জমিদার জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী? সেই বাটপার বলে, নাতিনজামাই। থাকতে থাকতে জমিদারের নাতনির সাথে সে সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং নাতনিকে নিয়ে একদিন ভেগে যায়। এরপর জমিদার সবাইকে ডেকে বলে, আমার নাতনিকে নিয়ে ভেগেছে এবং সবাই আমাকে সাহায্য করো। সবাই জিজ্ঞাসা করে, কে নিয়ে গেছে? জমিদার বলেন, নাতিনজামাই। তখন সবাই বলে, নাতিনজামাই নাতনিকে নিয়ে গেছে সমস্যা কী? আমরাও শুনতে পাচ্ছি, আহলে কুরআন। সবাই মনে করছে, কুরআনের অনুসারী- সমস্যা কী? কুরআন যার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, যিনি কুরআনের ব্যাখ্যাকারী তাঁকে অমান্য করলে কি আর কুরআন মানা হয়, না মুসলমান থাকা যায়? খতিব মহোদয় বলেন, যারা হাদিস অস্বীকার করে তারা বিভ্রান্ত। তিনি যুবকদের প্রতি আহবান জানান, কুরআনকে বুঝতে হলে, জানতে হলে ও মানতে হলে রসুলুল্লাহ সা.-এর মাধ্যমেই জানতে হবে ও মানতে হবে।
রসুল সা.-এর আনুগত্য প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের আমল উল্লেখ করে তিনি বলেন, খলিফা ওমর রা.-এর শাসনামলে পারস্য সম্রাটের কাছে সাহাবি সাদ ইবনে আবি আক্কাস রা.-কে নেতা নিযুক্ত করে তিনি একটা প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তাঁরা সেখানে পৌঁছে দুজনকে বাদশাহর দরবারে পাঠান। দুজন সাহাবি সাধারণ পোশাকে সেখানে পৌঁছলে রাজ দরবারের রক্ষীরা প্রবেশে বাধা প্রদান করে। তাদের কথা, রাজদরবারে প্রবেশ করতে হলে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে আসতে হবে। সাহাবিদ্বয় বলেন, আমরা আমাদের নবি সা. যেভাবে অনাড়ম্বর জীবন যাপনের শিক্ষা দিয়েছেন সেভাবেই আমরা যাবো। তাদের সাহস-হিম্মত ও দৃঢ়তা দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। রাজকীয় দূত হিসেবে তারা তাঁদেরকে বেশ সম্মান প্রদর্শন করে। দস্তরখানা বিছায়ে খেতে দিলে খানা খাওয়ার সময় দস্তরখানায় পড়ে যাওয়া খাদ্যকনা হুজাইফা রা. উঠিয়ে খান। বাদশাহর লোকজন বলে. দস্তরখানায় পড়ে যাওয়া খাদ্যকনা উঠিয়ে খাওয়া দরবারের মর্যাদার খেলাপ। হুজাইফা রা. বলেন, আমাদের নবির সুন্নাত হলো খাদ্যকনা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খাওয়া এবং প্লেট পরিষ্কার করে ও আঙ্গুলগুলি চেটে খাওয়া। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম সর্বাবস্থায় প্রিয়তম নবি সা.-এর সুন্নাত অনুসরণ করেছেন। একজন মুসলমান যতক্ষণ না পূর্ণভাবে রসুল সা.-কে মনেপ্রাণে অনুসরণ করবে ততক্ষণ না সে মুসলমান হতে পারবে। আল্লাহ ও রসুল সা.-এর বিধান মানা প্রশ্নে একজন মুসলমানের কথা হবে- ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’। খতিব মহোদয় আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের মাধ্যমে একনিষ্ঠ মুসলমান হওয়ার জন্য আল্লাহপাকের নিকট দোয়া করেন। ঈষৎ সংযোজিত।
Comments
Post a Comment