Skip to main content

আমাদের পারিবারিক বৈঠক নিয়ে কিছু কথা

সাধারণত মাসে বার চারেক আমাদের পারিবারিক বৈঠক হয়ে থাকে। এটি অনেকখানি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যও। আব্বা বেঁচে থাকতে পরিবারের সদস্য এবং আশেপাশে তাঁর মেয়েদেরকে নিয়ে তিনি নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক করতেন। আব্বার ইন্তেকালের পরে সেই ঐতিহ্যটা বাড়িতে আর নেই। বাড়িতে কেউ উদ্যোগ নিয়ে এই দায়িত্ব পালন করলে তাদের সওয়াবের পাশাপাশি আমার আব্বাও কবরে থেকে সওয়াব পেতেন (সদকায়ে জারিয়া হিসেবে)। আমরা বাসায় করি। বৈঠক করার ব্যাপারে আমার স্ত্রীর আগ্রহটা প্রবল। গতকালের বৈঠকে আমি সুরা তাগাবুন থেকে ১১-১৫ আয়াত আলোচনা করলাম, ছেলে একটি হাদিস আর আমার স্ত্রী কিছু হেদায়াতি কথা বললেন। মূলত পারিবারিক বৈঠকের সভানেত্রী তিনিই। এরপর চা বিস্কুট খেয়ে শেষ করা হলো। সিটিং-এর সাথে ইটিং-এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। এজাতীয় বৈঠক সব পরিবারেই হওয়া দরকার। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একত্রে খাওয়া, একটু ঘুরাঘুরি করা ও বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সন্তানদের সময় দিতে না পারলে তার খেসারত আমাদের দিতেই হবে। আমার বন্ধুদের সাথে গতকালের কুরআনের আলোচনা একটু শেয়ার করতে চাই।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

‘আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কখনো কোনো বিপদ আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান পোষণ করে আল্লাহ তার দিলকে হেদায়াত দান করেন। আল্লাহ সবকিছু জানেন। আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসুলের আনুগত্য করো। কিন্তু তোমরা যদি আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে সত্যকে স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার রসুলের আর কোনো দায়িত্ব নেই। তিনি আল্লাহ যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। ইমানদারদের উচিত কেবল আল্লাহর ওপরেই ভরসা করা।

হে সেই সব লোক যারা ইমান এনেছো, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু। তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান’- সুরা তাগাবুন ১১-১৫।

এই সুরার ৯নং আয়াত ‘জালিকা ইয়াওমুত তাগাবুন’ থেকে নামকরণ করা হয়েছে। কেয়ামতের দিনটিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, সে দিনটি হবে পরস্পরের হার-জিতের দিন। দুনিয়ার নাম-যশ-খ্যাতি-প্রভাব- প্রতিপত্তি, ডিগ্রি ও অর্থবিত্ত কোনো কিছুই সেদিন হারজিতের মাপকাঠি হবে না। ইমান ও নেক আমলে যে জিতে যাবে সেই সত্যিকার বিজয়ী। আর যে ব্যর্থ হবে সে চিরদিনের জন্য হেরে যাবে।

মদিনায় হিজরতের পরে সুরাটি নাজিল হয়। মক্কায় বছরের পর বছর জুলুম-নির্যাতন সহ্য করার পর সবকিছু ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন রসুল সা. ও তাঁর সাথিরা। মুহাজিররা ছিলেন সম্বলহীন ও চরম বিপদগ্রস্ত এবং বিপদ মদিনার আনসারদেরও কম ছিল না। বিপুল পরিমাণ মুহাজিরকে আশ্রয় প্রদান ও তাদের ভরণ-পোষণ ছাড়াও সমগ্র আরব তাদের শত্রু হয়ে পড়েছিল এবং এই উদীয়মান শক্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য আরবরা ছিল বদ্ধপরিকর। এমন সময় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এই সুরাটি নাজিল হয়। বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট নিজে থেকে আসে না বা কেউ কারো ওপর চাপিয়েও দিতে পারে না। আল্লাহর অনুমতিক্রমেই আসে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান পোষণ করে সে জানে যে এ বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এবং দূর করার ক্ষমতাও আল্লাহরই রয়েছে। বান্দাকে বিপদে ফেলে দিয়ে আল্লাহ নিজেকে আড়াল করে রাখেন না বরং বান্দার অবস্থা তিনি সবই জানেন। তাই বিপদাপদে সে না ঘাবড়ে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে। আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষায় ফেলে তাঁর বান্দার মর্যাদা বাড়াতে চান। রসুল সা. বলেন- ‘আল্লাহর বান্দার জন্য উভয় অবস্থাই কল্যাণকর। ভালো কিছু হলে সে শুকরিয়া আদায় করে এবং বিপদাপদ আসলে ধৈর্য অবলম্বন করে’।

পরীক্ষাগ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। ভয়, সম্পদহানি, রোগ-শোক, নানাভাবে বিপদ আসতে পারে এবং সে জানে, এই বিপদ দূর করার ক্ষমতা কেবল আল্লাহরই। তাই বিপদ দূর করার জন্য সে আল্লাহরই কাছে ধর্ণা দেয়। পক্ষান্তরে কাফেরের কোনো অভিভাবক নেই। শয়তান তার সামনে অভিভাবক হিসেবে নিজেকে পেশ করে যদিও সে তার প্রকাশ্য শত্রু। ফলে বিপদে পড়লে সে তাগুতের কাছে আশ্রয় চায় এবং অনেক সময় আত্মহত্যা করে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই হারায়।

পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য সর্বাবস্থায় করতে হবে। রসুলের আহবানে সাড়া দেয়া মুমিনদের জন্য ফরজ। একটুও ব্যতিক্রম ঘটানোর অবকাশ নেই এবং এই আনুগত্য চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহপাকের স্পষ্ট ঘোষণা, আনুগত্য করা থেকে কেউ যদি মুখ ফিরায়ে নেয় তবে রসুলের দায়িত্ব কেবল পৌঁছে দেয়া। আল্লাহর বড়ো পরিচয়, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই অর্থাৎ তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় সবই আল্লাহর করায়ত্বে। কাজেই মুমিনদের উচিত কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করা।

মানবজীবনে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তায়ালার বড়ো নেয়ামত। কিন্তু সবসময় তারা চোখ শীতলকারী হয় না। এখানে আল্লাহপাক বলেছেন, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মাঝে কতিপয় শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। এখানে সতর্ক থাকতে বলেছেন অর্থাৎ এরা যেন তোমাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ না হয়। ধনসম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি সবই পরীক্ষার সামগ্রী। এমন অনেক স্ত্রী আছে যাদের কারণে স্বামীর জীবনে সুখ-শান্তি সব হারিয়ে যায়। স্বামীর ইসলামের পথে চলা ও সৎ জীবনযাপন স্ত্রী মোটেই সহ্য করতে পারে না। আবার অনেক স্বামী আছে স্ত্রীর পর্দা মেনে চলা ও শালীন জীবন যাপন তাদের পছন্দ নয়, চায় তার বন্ধুদের সাথে খোলামেলা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করুক। এমন স্বামীর পাল্লায় পড়ে অনেক নারীর জীবনে সুখ-শান্তি দূর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্বামী-স্ত্রী একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা সন্তানকে ত্যাজ্য করার কথা না বলে আল্লাহ বলেছেন, তাদের সাথে ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করো। আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদি স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে এবং পিতামাতা সন্তানকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে।

মানুষ স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি দুর্বল থাকে। সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের প্রতি লোভ ও মায়ার কারণে মানুষ অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। সুরা তাকাসুরে আল্লাহ বলেছেন, কবরের মুখ পর্যন্ত পেঁছেও সে সম্পদের মায়া ছাড়তে পারে না। রসুল সা. বলেছেন, মানবসন্তান এমন যে এক উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হলে সে আর একটি চায়, মাটি ছাড়া কোনো কিছু তাকে তৃপ্ত করতে পারে না। মৃত্যুর পরে এই ধনসম্পদ, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয় পরিজন কেউ কারো উপকারে আসবে না। ফলে আমরা দায়িত্ব পালন করবো ঠিকই কিন্তু কারো মায়ায় পড়ে আমরা যেন আখেরাত ধ্বংস না করি সেজন্য আল্লাহপাক সতর্ক করেছেন। আল্লাহপাক ইসলামের উপর অবিচল থাকার তৌফিক আমাদেরকে দান করুন। ঈষৎ সংযোজিত। ১৩.১১.২০২২

Comments