মুহাম্মদ (সা) আল্লাহপাকের সর্বশেষ রসূল, তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রসূল নেই। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দ্বীনের পরিপূর্ণতা দান করেছেন। সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন যা কিয়ামত পর্যন্ত হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেছেন। রসূল (সা)-এর ওপর সর্বশেষ ওহী সূরা মায়েদার ৩নং আয়াতে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতও পুরো করে দিলাম, তোমাদের জন্য জীবন বিধান হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করলাম’।
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর গোলামী করার জন্য। গোলামী (ইবাদত) করার সকল নিয়ম-কানুনের পূর্ণতা দানের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (সা) সামান্যতম ত্রুটি রেখে যাননি। বিদায় হজ্জের বিশাল জনসমূদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে তাঁদের কাছে পৌঁছেছেন কি না? সমস্বরে সবাই বলেছিলেন, হ্যাঁ। মুহাম্মদ (সা) রসূল হিসেবে যা করেছেন, বলেছেন ও অনুমোদন করেছেন এবং খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী সময়ে (তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন) যা আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন সেটিই সুন্নাহ এবং এর বাইরে যা কিছু অতিরিক্ত বা নূতনত্ব সেটি বিদয়াত। বিদয়াত সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরিত।
বিদয়াতের কোনো শ্রেণিবিভাগ নেই। হাদিসের ভাষায় সকল বিদয়াতই ভ্রষ্ট এবং পরিণতি জাহান্নাম। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে সামনে থেকে, পেছন থেকে, ডান থেকে, বাম থেকে আক্রমণ করে গোমরাহ করতে চায়। মানুষকে সেজদা না করে সে জান্নাত থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত হয়েছে; তাই সে মানুষকে তার সাথী করে জাহান্নামে যেতে চায়। বিদয়াতের মাধ্যমে মু’মিনদেরকে পথভ্রষ্ট করা অনেকখানি সহজ। কারণ ছওয়াবের নিয়তেই সে আমল (বিদয়াত) করে থাকে। অনেক সময় তাওবা (ফিরে আসা) করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।
বিদয়াত চকচকে জাল টাকা, দেখতে আসল টাকার মতই; কিন্তু সরকারের অনুমোদন না থাকায় যার কাছে জাল টাকা পাওয়া যায় তার স্থান হয় জেলখানায়। বিদয়াতও তেমনই, রসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমোদন না থাকার কারণে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। বিদয়াত মেনে নিলে রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি দায়িত্ব পালন অপূর্ণ রেখেছেন বা গাফিলতি করেছেন (নাউজু বিল্লাহ)। মু’মিন সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে থাকে। কোনো বিষয় সুন্নাহ না বিদয়াত, তা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে বা সন্দেহ সৃষ্টি হলে সেই আমল ছেড়ে দেয়াটাই উত্তম। কারণ এ জাতীয় সন্দেহপূর্ণ আমল (যা সুন্নাহ মনে করে করা হয়) ছেড়ে দেয়ার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই, বরং বিদয়াত মনে করে ছেড়ে দেয়াতে ছওয়াব রয়েছে।
বিদয়াতের ব্যাপারে রসূলুল্লাহ (সা) কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিদয়াতের পরিণতি সম্পর্কীয় কিছু হাদিস এখানে আমরা উল্লেখ করতে চাই।
হযরত হাসান বসরি (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো বিদয়াত চালু করেছে বা কোনো বিদয়াতীকে আশ্রয় দিয়েছে, তার ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সমস্ত মানুষের লানত বা অভিশাপ। তাছাড়া তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল হয় না। আবু দাউদ।
হযরত গুযাইফ ইবনুল হারিছ সুমালী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যখনই কোনো সম্প্রদায় একটা বিদয়াত সৃষ্টি করে, তখনই একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয়। সুতরাং একটি সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা একটি বিদয়াত সৃষ্টি করা থেকে উত্তম। আহমাদ।
হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীন সম্পর্কে কোনো নতুন কথা সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করেছে যা এতে নেই তার সে কথা বাতিল ও প্রত্যাখ্যান যোগ্য। বুখারি ও মুসলিম।
হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী এবং সর্বোত্তম তরীকা/পন্থা হচ্ছে মুহাম্মদ (সা)-এর তরীকা/পন্থা আর সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীন সম্পর্কে নতুন উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং দ্বীন সম্পর্কিত প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই গোমরাহী (মুসলিম)। আর নাসায়ী শরীফের বর্ণনায় এর পরে বলা হয়েছে প্রত্যেক গোমরাহীর ঠিকানা জাহান্নাম। (মিশকাত)।
কিয়ামতের দিন যখন রসূলুল্লাহ (সা) হাউযে কাউসারে আসবেন সে সময়ে যাদেরকে রসূল (সা) তাঁর উম্মত মনে করবেন, সে সময়ে ফেরেশতাগণ বলবেন, এরা হলো সে সকল ব্যক্তি যারা আপনার পরে বিদয়াত শুরু করে দিয়েছিল। রসূল (সা) তখন বলবেন, ‘সুহকান’ ‘সুহকান’ ‘দূর হয়ে যাও’ ‘দূর হয়ে যাও’ সে সকল যারা আমার পরে দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ। বুখারি ও মুসলিম।
উপরের হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, বিদয়াত বড় গুনাহ এবং এর পরিণতিও ভয়াবহ। বর্তমানে বিদয়াত অনেক লোপ পেয়েছে। মানুষ এখন অন্ধভক্তি নয়, দ্বীনকে নিজ থেকেই জানতে চায় এবং জানার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। একটি সময়ে আমরা দেখেছি, শবেবরাতের দিনে হালুয়া-রুটি খাওয়া ও মিলাদের ধুম পড়ে যেত। সবকাজেই মিলাদ- মারা যাওয়ার পর ফাতেহাখানি, বাবা-মার মৃত্যুদিবস, ছেলে-মেয়ের ভালো ফলাফল, ছেলে বিদেশ যাবে, দোকান ঘর তৈরী, ঈদে মিলাদুন্নবী এবং তৎসহ বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুদিবস ইত্যাদি সকল কাজে মিলাদ মাহফিল। মিলাদ একদম বন্ধ না হলেও অনেকাংশে লোপ পেয়েছে।
বিদয়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিকদের ভূমিকা কম নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে নামায, রোযা, যাকাতের মতো ফরজ ইবাদত কায়েমের প্রচেষ্টা না থাকলেও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা), শবেবরাত, আশুরা, ফাতেহা ইয়াজদাহামে (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ছুটিসহ বাণী প্রদান ও সাড়ম্বরে পালনের কোনো ঘাটতি কখনই ছিল না এবং এখনো নেই।
ঈদের দিন, নতুন বৌ ঘরে আসা, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, বৃত্তি পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে স্কুল থেকে বিদায়লগ্নে পিতা-মাতা, শিক্ষক ও গুরুজনকে কদমবুচি করা ছিল অত্যাবশ্যক। কদমবুচি না করা ছিল যেন বেআদবী। আমরা অবশ্য কখনই এই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আজ থেকে ৫০/৫২ বছর পূর্বে স্কুলজীবনে আব্বার কাছে পড়েছিলাম মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম (রহ) লিখিত ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ বইটি। ফলে বিদয়াত সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা পারিবারিকভাবে শৈশবেই গড়ে উঠেছিল।
কবরপূজা বন্ধ না হলেও অশিক্ষিত ও মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ীদের মধ্যে এটি এখন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মাজার দেখলে বাসগুলো মনে হয় এখন আর থামে না। তারপর এই বিদয়াতটা এখনো রয়েছে। পীরের প্রতি অতিভক্তিও (পীরপূজা) অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। পিতা-মাতার চেয়েও তারা ছিলেন অতি সম্মানীয়, এমন কি প্রচার করা হতো পীর ধরা ফরজ এবং যার পীর নেই, তার পীর শয়তান। এসব কথাবার্তা এখন আর শুনি না। এখন পীর সাহেব অনেকের কাছে ধর্মীয় গুরু (আধ্যাত্মিক নেতা) হিসেবে বিবেচিত এবং রাজনীতির অঙ্গনেও তাদের বিচরণ লক্ষণীয়।
নামাযের মধ্যেও অনেক বিদয়াত দূর হতে চলেছে। জায়নামাযে দাঁড়ানোর দুআ, নাওউয়াতুন বলে মুখে নিয়ত উচ্চারণ ও নামায শেষে সামষ্টিক মোনাজাত অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি নিজেও করতাম। ২০১২ সালে হজ্জ থেকে ফিরে এসে ছেড়ে দিয়েছি। সেখানে দেড়টা মাস মক্কা-মদীনায় নামায লক্ষ্য করেছি ও ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজ (রহ) লেখা ‘রসূলুল্লাহ (সা)-এর নামায’ বইটি আমাকে বিদয়াত মুক্ত হতে সহায়তা করেছে। আমাদের দেশে বিদয়াত দূরীকরণে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ)সহ অনেক উলামায়ে কেরামের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। কাউকে আঘাত না করে কথা বলার অপূর্ব কৌশল ছিল ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ)-এর। আল্লাহপাক তাঁকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর নেক বান্দাদের মাঝে তাঁকে শামিল করুন।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা) বলেছেন-এ কথা জানার সাথে এ কথা উচ্চারণ করা- ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’। বিদয়াত ছাড়তে ও সুন্নাহ অনুসরণে আমার একটুও বিলম্ব হয় না। যদিও আমি হানাফী মাযহাবের অনুসারী তবে কোনো হাদিস পেলে তা গ্রহণে আমার একটুও আপত্তি নেই, কারণ ইমাম আবু হানিফা (রহ) এমনটিই বলে গেছেন, আর না বলে উপায়ও নেই। সব ইমামেরই একই কথা, তাঁর মতের বিপক্ষে কোনো হাদিস পেলে সেটি অনুসরণের কথা সবাই বলে গেছেন। প্রসিদ্ধ চার ইমাম কেউ কোনো বিদয়াত চালু করেননি। সব বিদয়াতের উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। আল্লাহপাক আমাদেরকে বিদয়াতমুক্ত ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন। ০৮.০৯.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment