না, কথাটি আমার নয় বা কোনো বিশিষ্ট দার্শনিকেরও নয়; এই বাণীটি স্বয়ং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-এর। কথাটি দ্ব্যর্থহীন। ঘুষের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি যে জাহান্নামী, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই এবং সংশয় পোষণকারীর ঈমানদার হওয়ার ব্যাপারেই প্রশ্ন রয়েছে। ঘুষ গ্রহণকারী একজন জালেম এবং জাহান্নামই তার ঠিকানা (তবে তাওবা করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নিলে স্বতন্ত্র)। ঘুষ গ্রহণের পাশাপাশি সে যদি মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করে, বড় কুরবানি দেয় ও হজ্জ করে এবং মনে করে এসব নেক আমল তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে, তাহলে বুঝতে হবে সে আল্লাহর রসূল (সা)-এর ওপরই মিথ্যা আরোপ করলো; কারণ তিনি স্পষ্ট করেছেন যে ‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই দোযখী’।
অবশ্য কেউ তার বৈধ অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তি এড়াতে নিতান্ত ঠেকায় পড়ে কিছু দেয় তাহলে হয়তো ক্ষমা পেতে পারে। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, ‘তোমাদের জন্য প্রবাহিত রক্ত, শুকরের মাংস ও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ করা জন্তু হারাম করা হয়েছে। তবে কেউ যদি নিতান্ত ঠেকায় পড়ে গুনাহ করার প্রবণতা ছাড়াই কিছু খায় আল্লাহ গফুরুর রহীম’। অবৈধ সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার জন্য নয়, বরং বৈধ পাওনা লাভের জন্য কিছু দেয়ার বিষয়টিকে ফকিহরা একটু সহজভাবে গ্রহণ করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভারের ঘুষের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হওয়া এবং বিভিন্ন অফিসে কেনাকাটায় দুর্নীতির যে চিত্র তা বড় ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক। ড্রাইভারের শত কোটি টাকার মালিক হওয়া অর্থ সে সহস্র কোটি টাকা আদায় করেছে এবং অন্তত নয়শ কোটি টাকা তাকে দিতে হয়েছে। হয়তো সেসব দুর্নীতির খবর কখনই প্রকাশ পাবে না। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কাজেকর্মে সরকারি অফিসে যেতেই মানুষ ভয় পায়। দীর্ঘদিন মামলা-মোকদ্দমা শেষে বৃদ্ধকালে কিছু বকেয়া পাওয়ার সুযোগ আমাদের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত নিজ জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে আমরা আমাদের পাওনাদি পেয়ে থাকি। আমরা এবার জেনেছি, আমাদের বকেয়া গ্রহণ করতে হবে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। আশা করি আমরা হয়রানির শিকার হবো না।
বলা যায়,আমার জীবনে কখনই ঘুষ দেয়া হয়নি। পিএসসি থেকে নিয়োগপত্র পাওয়ার পর খেয়াল করলাম, নামের বানানে একটু ভুল। সংশোধনের জন্য বন্ধুরা পাঠালেন ডিজি অফিসে। সহকারী পরিচালকের সাথে সাক্ষাত করলে তিনি জানালেন, ‘ফিরে গিয়ে শীঘ্রই যোগদান করেন, ওটা কিছু না’। বের হতেই এক পিয়ন পেছনে পেছনে এসে জানালো, স্যার সকালে নাস্তা করে আসিনি, দশটা টাকা দিলে নাস্তা করতে পারি। ভিক্ষুকতুল্য মনে করে তাৎক্ষণিক দিয়ে দিলাম। সেই ১৯৮২ সালের কথা। আর একদিন কুষ্টিয়া জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে নাস্তা করতে চাইলে একজনকে দশ টাকা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে কখনই ঘুষ দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
কুষ্টিয়া কলেজে আমার বদলী, উপাধ্যক্ষ পদে পদায়ন কোথাও ঘুষ দিতে হয়নি। প্রফেসরের শূন্য পদ থাকা সত্ত্বে আমাকে যশোর এমএম কলেজ থেকে মৌলভী সরকারি কলেজে বদলী করা হয়েছিল। সে সময়ে আমি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি, এমএম কলেজ ইউনিটের সভাপতি ও স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি ছিলাম। কুষ্টিয়া কলেজে বদলী হয়ে আসা ও উপাধ্যক্ষ পদে পদায়নে সমিতি আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সে সময়ের নেতৃবৃন্দ প্রফেসর ফাহিমা খাতুন, প্রফেসর মো. মাসুমে রব্বানী খান, প্রফেসর আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার ও যশোরের জনাব মো. সিরাজুল ইসলামের প্রতি। এসব কাজে আমি কখনই ডিজি অফিস বা সচিবালয়ে দৌড়াদৌড়ি করিনি। সত্যি কথা বলতে কী, জীবনে কখনো আমি সচিবালয়ে প্রবেশ করিনি বা প্রয়োজন পড়েনি।
ঘুষ না দেয়ার কারণে মাঝে-মধ্যে কিছু বিড়ম্বনাও হয়েছে। আমার পেনশন পেতে বেশ বিলম্ব হয়েছিল। সাধারণত টাকা-পয়সা খরচ না করলে পেনশন সময়মত পাওয়া যায় না। শেষে সমিতিকে বলতে হয়েছিল। জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস বা কোনো অফিসে আমাকে কখনই ঘুষ দিতে হয়নি। আমার অভিজ্ঞতা, ঘুষ ছাড়াও কাজ হয়, তবে একটু বিলম্ব হয়।
আমার প্রথম কর্মস্থল সাতকানিয়া সরকারি কলেজ। সবেমাত্র বিয়ে করেছি এবং দূরত্ব ও যোগাযোগের ঝামেলা-ঝক্কির কারণে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বদলী হয়ে আসার জন্য চেষ্টা হিসেবে উপর্যুপরি দরখাস্ত পাঠাতাম। একবার পরিচালক শাফায়াত আহমদ সিদ্দিকী স্যারের সাথে সাক্ষাত করেছিলাম। স্যার বলেছিলাম, সরকারি চাকুরি হিসেবে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে চাকুরি করার জন্য প্রস্তুত থাকুন। একটু হতাশই হয়েছিলাম।
আমাদের দেশে সরকারি অফিসগুলোয় দুর্নীতি বহু পুরাতন। সহকর্মীরা বললেন, বদলী হতে টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়। সে সময়ে ডিজি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল ইসলাম (মরহুম)। স্যারকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলাম এবং তাতে উল্লেখ করেছিলাম-‘স্যার, আপনার অফিসে পয়সা ছাড়া নাকি কোনো কাজ হয় না। সহপাঠীরা বলেন, যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করলেও আমার পক্ষে বদলী হওয়া সম্ভব নয়’। খামের ওপরে লিখেছিলাম ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ এবং এ ধরনের চিঠি লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম। বন্ধুরা খুব ভয় দেখালেন। আমার জবাব ছিল, বাড়ি কুষ্টিয়ায়, আছি সাতকানিয়ায় আর দেবে কোথায়? অল্প কয়েক দিন পরেই কুষ্টিয়া কলেজে বদলীর আদেশ হাতে পেয়েছিলাম। আল্লাহপাক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল ইসলামকে ক্ষমা করুন ও জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করুন।
ঘুষসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে তাওবা করে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য আল্লাহপাক আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন। ২৮.০৯.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment