প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখছি। গতরাতে নারায়নগঞ্জ শহরে এক মসজিদে এশার নামায শেষে এসি বিস্ফোরণে ৩৮ জন অগ্নিদগ্ধকে হাসপাতালে নেয়ার পর আজ মাগরিব পর্যন্ত মসজিদের মুয়াজ্জিনসহ ১৬ জন ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন)। মসজিদ আল্লাহর ঘর, একটি নিরাপদ জায়গা। আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে মুসল্লিগণ মসজিদে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের মৃত্যু হবে, না তারা আর না তাদের পরিবার-পরিজন কেউ কল্পনাও করেনি। বড় হৃদয়বিদারক এ মৃত্যু। আল্লাহপাক তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করে আখিরাতের নিশ্চিত জীবনে উচ্চ মর্যাদা দান করুন, যেখানে মৃত্যু কখনো স্পর্শ করবে না এবং মানুষ মৃত্যুভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি নানাবিধ রোগ-ব্যাধি, হঠাৎ করে হার্টএ্যাটাক বা ব্রেনস্ট্রোক, বিমান-বাস ও ট্রেন দুর্ঘটনাসহ নানাবিধ দুর্ঘটনায় মানুষ প্রতিদিন এ দুনিয়ার জীবন ছেড়ে আখিরাতের জীবনে পাড়ি জমাচ্ছে। না চাইলেও যেতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো উপায় নেই। এসব মৃত্যুকে তকদিরের ওপর ছেড়ে দিয়ে মানুষ সান্ত্বনা খুঁজে। এর বাইরেও রয়েছে মৃত্যু, হঠাৎ করে গুম-খুন হয়ে যাওয়া। এটি বড় পীড়াদায়ক, অসহনীয় এবং মানুষ তা মেনে নিতে পারে না ও মানা যায় না।
আল্লাহপাক মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র ঘোষণা করেছেন। এটি ক্ষুণ্ণ করার অধিকার কারো নেই। জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মানুষ কায়েম করেছে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা।
সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো তার নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা। কোনো দুর্বৃত্ত যাতে নিরাপত্তা ব্যাহত করতে না পারে সেজন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে না, এক. আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে, দুই. জনগণের নিরাপত্তা বিধানে যে চোখ বিনীদ্র রজনী যাপন করে।
জনগণের সেবার লক্ষ্যে যে রাজনীতি আমাদের দেশে সেটির বড় অভাব। দেশের রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, আমানতদারিতা ও বিশ্বাসপরায়ণতার বড় ঘাটতি। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যের কোটায়। সীমাহীন দুর্নীতি ও গুম-খুনের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা মানুষ কল্পনা করে, জাতি হিসেবে যেটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হিংসা-বিদ্বেষ এবং অপরের ক্ষতি করার চিন্তা আমাদের পেয়ে বসেছে। অথচ আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য (আল্লাহর ভাষায়)।
সীমাহীন লোভ-লালসা আমাদেরকে পাগলপ্রাণ করে ফেলেছে। লোভ-লালসা চরিতার্থে কাউকে বাধা মনে করলে তাদেরকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে আমরা পিছপা নই। সম্প্রতি এক ইউএনও দুর্বত্তদের লোভ-লালসার প্রতিবন্ধক হওয়ায় এখন তিনি হাসপাতালের ICU-তে, অপকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়বে এই ভয়ে সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে নিহত হতে হলো, অতীতে দেখা গেছে স্রেফ অর্থলোভে একসাথে সাত খুন করতেও তারা পিছপা হয়নি। দেখা যায়, অধিকাংশ হত্যাকান্ড ও বড় বড় দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে আছে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত কোনো না কোনো নেতা-কর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ।
প্রশ্ন হচ্ছে, অঢেল ধন-সম্পদ, ক্ষমতা আমরা কতটুকু ভোগ-ব্যবহার করতে পারি, আমাদের আয়ষ্কুল বা কতটুকু বা আমাদের কি সেটা জানা আছে? বড় অনিশ্চিত আমাদের এ জীবন। আমাদের জীবন যে অনিশ্চিত তাও আমরা বুঝতে চাই না। আমাদের আচার-আচরণ ও সম্পদের প্রতি মোহ দেখে মনে হয় আমরা অনন্তকালের যাত্রী।
অপরের মৃত্যু আমাদের অনুভূতিতে লাগে না। মৃত্যুর কথা সর্বক্ষণ স্মরণে রাখার জন্য আল্লাহর রসূল (সা) জানাযা ও দাফন-কাফনে শরীক হওয়া এবং কবর জিয়ারতের জন্য তাঁর উম্মতদেরকে বলেছেন। করোনা এসে জানাযা ও দাফন-কাফনে শরীক হওয়া বন্ধ করে ফেসবুকে দুআ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছি। ফেসবুকে দুআ আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ করে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধও করে না, সবই গতানুগতিক।
একজন মু’মিন দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ চায়। তবে আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে কখনো অগ্রাধিকার দিতে পারে না। অথচ নব্বই ভাগ বিশ্বাসনির্ভর একটি জাতির কর্মকান্ড প্রমাণ করে না যে আমরা আখিরাতে বিশ্বাসী মুসলিম জাতি। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছেন, কোনো মানুষ যখন অন্যায় করে তখন আর তার মধ্যে ঈমান অবশিষ্ট থাকে না। কোনো বিশ্বাসী ব্যক্তি সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি এবং গুম-খুনে জড়িত হবে, এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রসূলুল্লাহ (সা)-এর উক্তিটি আমরা স্মরণ করি, ‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, মু’মিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’। কোনো মানুষ অন্যায় ও পাপাচারে জড়িত এবং মানুষ যার ভয়ে তটস্থ তার নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত-মসজিদ নির্মাণ সবই পন্ডশ্রম ও মূল্যহীন এবং এই পাপীষ্ঠ ব্যক্তির কাজকে স্বীকৃতি দেয়া হলে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-কে ওপরই মিথ্যা আরোপ করা হয় (নাউজু বিল্লাহ)।
প্রতিনিয়তই মৃত্যু আমাদের ডাকছে। মৃত্যু থেকে আমরা মোটেই দূরে নই। দুনিয়ার এ জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি অনিশ্চিত। যদি আমার জানা থাকতো ৫০ বছর বয়সে মৃত্যু হবে, তাহলে অন্তত এক বছর পূর্বে আল্লাহর কাছে তাওবা করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ পেতাম ও দান-সদকা বেশি বেশি করে নেকির পাল্লাকে ভারি করে নিতে পারতাম। কিন্তু না, তা আমার জানা নেই। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে দুনিয়ার জীবনকে নয় আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সকল কর্মকান্ড পরিহার করে আল্লাহর একান্ত অনুগত বান্দাহ হিসেবে চলার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে সফল হওয়া সম্ভব। যারা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয় আল্লাহপাক তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় ক্ষেত্রে সাফল্য দান করেন।
দুনিয়া ও আখিরাত দু’টিই আল্লাহর হাতে। তাই উভয়বিধ কল্যাণ আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্যই। দুনিয়াজয়ী ব্যক্তিবর্গকে আমরা বুদ্ধিমান ও সফল হিসেবে জানি। এমন একজন বুদ্ধিমানকে আমরা জানি, রসূলুল্লাহ (সা)-এর জামানায় যার নাম ছিল আবুল হাকাম (জ্ঞানীর পিতা); কিন্তু আখিরাত অবিশ্বাস ও আল্লাহর বান্দাদের ওপর জুলুম করার কারণে সেই ব্যক্তিটি ইতিহাসে জালেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং রসূল (সা) যাকে আবু জেহেল (মুর্খের পিতা) উপাধী দান করেছেন। সেই জালেম রসূল (সা)-এর দেয়া নামেই পরিচিতি লাভ করেছে এবং তার সন্তানরা আর নিজেদেরকে তার বংশধারা বলে পরিচয় দান করেনি।
তাই আসুন, ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত জীবন নয়, স্থায়ী ও নিশ্চিত (আখিরাত) জীবনের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে নেই। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন। ০৫.০৯.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment