আসিয়াবের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় 'ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রমে একজন কর্মীর দায়িত্ব ও কর্তব্য' শীর্ষক আলোচনা।
আমাদের প্রথম পরিচয়, আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা। আল্লাহপাক আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ভালো-মন্দ বোঝার শক্তি দান করেছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেয়া হয়নি। কোনো মানুষ অন্যায় কিছু করলে আমরা বলি লোকটি অমানুষ। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে এটি তার জন্য শোভনীয় নয়। সাথে সাথে মানুষের মাঝে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষও দেয়া হয়েছে। অন্যায়কারীকে আমরা বলি, লোকটি প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে পড়েছে।
অন্যায় কাজে প্ররোচনা দেয় শয়তান। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। তবে সে ওয়াস-ওয়াসা সৃষ্টি করে, বাধ্য করতে পারে না। এ দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। ভালো-মন্দ দুটি করারই সুযোগ রয়েছে। বিবেকের পরও আল্লাহপাক মানুষকে হেদায়াত দান করেছেন। নবী-রসূল পাঠিয়েছেন।
মানুষ ও আল্লাহর মাঝে আর কোনো সৃষ্টি নেই যে আমাদের চেয়ে বড়। আল্লাহপাক স্রষ্টা, সর্বশ্রেষ্ঠ, তুলনাহীন এবং বাকি সবাই তাঁর সৃষ্টি। মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি করে মর্যাদার উচ্চাসনে আসীন করেছেন। তাই মানুষের সঙ্গে সদাচরণ মূলত আল্লাহর সাথেই সদাচরণ এবং মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আল্লাহর সাথেই দুর্ব্যবহার।
আমরা কবিতা পড়েছি-'হাশরের দিন বিচারে বসিয়া সুধাবে জগত স্বামী --- ' এটি একটি হাদিসের বাণী। সেদিন আল্লাহপাক নিজে অভুক্ত থাকা, পিপাসার্ত থাকা ও অসুস্থ থাকার কথা বলবেন। মানুষ আশ্চর্য হয়ে যাবে। আল্লাহ বলবেন, দুনিয়ায় আমার অভুক্ত বান্দাকে খাওয়ালে আজ এখানে পেতে। ফলে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর অসহায় বান্দাদের প্রতি আমাদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে।
আমাদের আর একটি পরিচয়, আমরা মুসলিম। আমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে (সূরা আলে ইমরান ১১০)। সর্বদা কল্যাণ কামনা ও মানুষের উপকার করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের থেকে সকল মানুষ নিরাপদ। কারো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা)-এর অনেক সতর্কবাণী রয়েছে।
মানুষ বিভিন্ন পেশায় জড়িত। পেশা, ভাষা, লিঙ্গ, বর্ণ কোনোভাবেই মানুষের মধ্যে ছোট-বড় নেই। সবাই আদমের সন্তান এবং আদম মাটির তৈরী। শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে কেবল গুণের ভিত্তিতে অর্থাৎ যে নীতিবান (আল্লাহর ভয় যার আছে) আল্লাহর কাছে সেই উত্তম।
ভেদাভেদ না থাকলেও আল্লাহর রসূল (সা) রুটি-রুজির ক্ষেত্রে ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দান করেছেন। তিনি বলেছেন, রুজির দশ ভাগের নয় ভাগ রয়েছে ব্যবসায় এবং একজন সৎ ব্যবসায়ী সিদ্দিকদের সমপর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। এ ছাড়াও ব্যবসায়ে হালাল-হারাম রয়েছে এবং তা মেনে চলে মানুষ মর্যাদাবান হয়।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের (বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে) প্রথম ধারণা দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং এ ক্ষেত্রে পথিকৃত হয়ে সুনাম অর্জন করেছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাক (এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হোসেন আবেদ)। তাঁদের উদ্যোগ সবই সুদ নির্ভর। সম্প্রতি ড. ইউনুস সামাজিক ব্যবসার কথা বলেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পুঁজির মালিক পুঁজি সরবরাহ করবে এবং বিনিময়ে সে শুধু আসলটা ফেরৎ পাবেন। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।
সুদভিত্তিক এনজিওর শুধু সমালোচনা নয়, আমাদেরকে বিকল্প দাঁড় করাতে হবে। বিকল্প হতে পারে ইসলাম। ইসলামের মুদারাবা-মুশারাকা পদ্ধতিতে আমরা বিনিয়োগ করতে পারি। আসিয়াব তার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। ফলাফল আল্লাহর হাতে।
আসিয়াবের এই তৎপরতা তখনই সফল হবে যখন আসিয়াবের কর্মীরা আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন। এব্যাপারে কর্মীর কিছু গুণের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।
১. সময়ানুবর্তিতা : একজন কর্মীর বড় গুণ হলো সময়ের কাজ সময়ে করা। অফিসে উপস্থিতি, কেন্দ্রে গমনসহ সকল ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তী হতে হবে। নামায আমাদেরকে সময়ানুবর্তী হতে উদ্বুদ্ধ করে।
২. জবাবদিহিতা : আমাদের উর্ধতন দায়িত্বশীল আছে, সেখানে আমার কাজের জবাবদিহি করতে হবে, এ অনুভূতি জাগ্রত না থাকলে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ে। সর্বোপরি আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর কাছে।
৩. নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা : কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অপরিহার্য। দায়সারা কাজ সুন্দর হয় না। আল্লাহপাক নামাযে খুশু-খুজু চান।
৪. পরিশ্রমপ্রিয়তা: পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন তাদের পেছনে রয়েছে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও কঠোর সাধনা।
৫. আমানতদারিতা : অফিসের সিদ্ধান্তবলী, মালামাল, দায়িত্ব সবকিছু পবিত্র আমানত। মুনাফিকের অন্যতম লক্ষ্মণ আমানতে খেয়ানত।
৬. ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন: ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রে ওয়াদা পালন অবশ্যম্ভাবী। ব্যাংকে ঋণখেলাপীরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী মুনাফিক বৈ আর কেউ নন।
৭. আর্থিক স্বচ্ছতা : আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আর্থিক স্বচ্ছতার বড় অভাব। অথচ তাকওয়ার মূল দাবীই হলো আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছ থাকা।
৮. উত্তম আচরণ : উত্তম আচরণের অভাবে অনেকে গ্রাহক হারায়। উত্তম আচরণ ইসলামের মৌলিক বিষয়। সদাচরণের বিনিময়ে আল্লাহপাক তার সাথে সদাচরণ করেন।
৯. বিনয় : আল্লাহপাক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। বিনয়ী মানুষ বন্ধু হয় আর অহঙ্কারীকে সবাই ঘৃণা করে।
১০. গ্রাহকের সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানের চেষ্টা : কর্মীকে অবশ্যই গ্রাহকের সমস্যা ধৈর্য ধারণ করে শুনতে হবে ও বুঝতে হবে এবং সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
১১. বিনিয়োগ ক্ষেত্রে গ্রাহককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান : সাধারণত অধিকাংশ গ্রাহক নারী ও নিরক্ষর। অনেক সময় তারা ভুল করে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে পরামর্শ দিতে হবে।
১২. ঋণ প্রদান ও আদায়ে আন্তরিক হওয়া : কর্মীর অবহেলায় একটি সংগঠনের সব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। ঋণটা যাতে কাজে লাগাতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা এবং আদায়ের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া।
১৩. হিসাবপত্র যথাযথ সংরক্ষণ : এ ব্যাপারে ত্রুটি মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নিজে সৎ হলেই হবে না, সততা প্রমাণ করে দেখাতে হবে এবং সেটি সম্ভব যথাযথ হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে।
১৪. সকল ক্ষেত্রে অপচয় রোধ ও বাহুল্য পরিহার : আমি আমার নিজের কাজ যেভাবে করবো প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের দায়িত্ব দ্বিবিধ। এক. আসিয়াবের প্রতি। আসিয়াব টিকে থাকলে ও অগ্রগতি হলে রুটি-রুজির সাথে নিজের উন্নয়ন সম্ভব এবং দ্বিতীয়ত গ্রাহকের প্রতি। হতদরিদ্র মানুষগুলোর কল্যাণসাধনে আসিয়াব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে তাদের সেবাদানের ক্ষেত্রে গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।
বান্দার হককে ইবাদত মনে করে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও তার মালিকের হক যথাযথভাবে পালন করে, সে মালিক অপেক্ষা সত্তর বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে। যারা নেয়ার সময় পূর্ণ করে নেয় এবং দেয়ার সময় কম দেয়-আল্লাহপাক তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন ও তাদেরকে হীন ঠকবাজ বলেছেন। তাই কাজে ফাকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সাথে সাথে মালিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। অধীনস্থদের প্রতি দরদী হওয়া ও তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করা মালিকের দায়িত্ব। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার অধীনস্হদের কাছে উত্তম।
ইসলাম উভয়পক্ষের মাঝে বিদ্বেষ নয়, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও কল্যাণ কামনার শিক্ষা দেয়। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। সংক্ষেপিত।
Comments
Post a Comment