দুনিয়া ও আখিরাত নিয়ে একজন বিশ্বাসীর জীবন। দুনিয়া হলো কর্মক্ষেত্র এবং আখিরাত তার ফলভোগের জায়গা। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এবং আখিরাত স্থায়ী-অবিনশ্বর। দুনিয়ার কর্মের ভিত্তিতে মানুষ আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখ জান্নাত অথবা ভয়াবহ কষ্ট ও যাতনার স্থান জাহান্নাম লাভ করবে।
মানুষ আল্লাহপাকের বড় আদরের সৃষ্টি। তাকে খলিফার মর্যাদা দিয়ে সকল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। এজন্য ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্থাৎ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের পাশাপাশি সর্বোত্তম নেয়ামত হিসেবে আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করেছেন। সৃষ্টির প্রথম মানুষ হলেন প্রথম নবী। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রসূল হলেন মুহাম্মদ (সা)। জগতবাসীর জন্য আল্লাহ তাঁকে রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন (সূরা আম্বিয়া ১০৭)।
আদম (আ)-কে সৃষ্টি করে জান্নাতে সাময়িকভাবে রাখা হলেও মূলত দুনিয়াকে আবাদ করার লক্ষ্যেই আল্লাহ তাঁকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এখানে প্রেরণ করেছেন। দুনিয়ায় আসার জন্য আদম (আ)-কে বলা হলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে তাঁকে অভয়বাণী শোনানো হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই এবং তাদের আদি বাসস্থান জান্নাতই হবে তাদের সর্বশেষ ও স্থায়ী ঠিকানা।
জান্নাতে আদম (আ)-এর সাময়িক অবস্থান ছিল নিছক পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। প্রাথমিক অবস্থায় অকৃতকার্য হলেও নিজেকে সংশোধন করে নেন। অর্থাৎ নিজের ভুল স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহপাক তাঁর বান্দার অপরাধ শুধু ক্ষমা নয় বরং নাফরমানির কালিমা দূর করে তাঁকে নবুওয়াতের উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। আদম (আ) ও ইবলিস দু’জনেই ভুল করেছিল কিন্তু উভয়ের আচরণের মধ্যে ছিল বিশাল পার্থক্য। ইবলিস ভুল করে তা স্বীকার না করে দম্ভ ও অহঙ্কার প্রকাশ করে অভিশপ্ত হয়েছে। আর আদম (আ) ভুল স্বীকার ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়েছেন। এটিই মানবপ্রকৃতি।
দুনিয়াকে বাদ দিয়ে নয় বরং দুনিয়াকে আবাদ করে সকল সৃষ্টির জন্য নিরাপদ আবাস গড়ে তোলা নবী-রসূলদের দায়িত্ব এবং সেটি সম্ভব আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে। ইবাদতের প্রকৃত অর্থ আল্লাহর গোলামী করা অর্থাৎ তাঁর হুকুম মেনে চলা। আল্লাহর গোলামী করার নিয়ম-কানুন হাতে-কলমে শিখিয়ে দেয়া নবী (সা)-এর দায়িত্ব এবং এজন্য নবী (সা)-এর আনুগত্য অপরিহার্য। আল্লাহপাক রসূল হিসেবে মানুষকেই বাছাই করেছেন এবং সমসাময়িক কালে মানুষের সামনে তাঁকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁর জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব অতিবাহিত হয়েছে সমাজের মানুষের সম্মুখে। তিনি কখনো নিজেকে অতি মানব দাবী করেননি। বরং বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মতো মানুষ’।
সাধারণত মানবসমাজ জুলুম-নির্যাতন ও পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে গেলে সেই সমাজে মানুষের মুক্তির জন্য আল্লাহ নবী প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ (সা)-এর সময়কালটাও ছিল ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। সে সময়ে হেরাগুহায় নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি মানুষকে মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন; ঘোষণা করেছিলেন, ‘হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’। সাফল্য বলতে তিনি মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের কথা শুনিয়েছিলেন। দুনিয়ায় সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা এবং আখিরাতে চিরস্থায়ী জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন।
নবী-রসূলগণ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও পরিচালিত। আল্লাহপাক তাঁর সকল নবী-রসূলকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েই প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ (সা)-এর ক্ষেত্রেও ছিল একই নিয়ম। নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহপাক দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘তিনি তাঁর আপন রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীন বা ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারেন’। সূরা তাওবা, ফাতাহ ও ছফে একটু হেরফের করে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন। মুহাম্মদ (সা)-এর সমগ্র জীবন এই লক্ষ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। তিনি মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তাদেরকে সংগঠিত করেছেন ও পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সাথে সাথে তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াতে নিয়োজিত করেছেন।
রসূল (সা)-এর জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ কখনও মসৃণ ছিল না। একাজে বাধা-বিপত্তি, জুলুম-নির্যাতন মাড়িয়ে একপর্যায়ে মদীনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলে সেখানে দ্বীন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে তিনি সেখানে হিজরত করার পর নবগঠিত রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর হাতে চলে আসে। বদর, ওহুদ, খন্দকসহ কয়েকটি যুদ্ধের পর অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র আরবের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের তিনি অধিকারী হয়ে পড়েন। মসজিদে নামাযের ইমাম হওয়ার সাথে সাথে বিচার-ফায়সালা, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় সকল কর্ম নবী হিসেবেই তিনি সম্পন্ন করেছেন এবং ঈমানদার সকলের জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ বাধ্যতামূলক।
সমাজে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারের মূলে রয়েছে অসৎ নেতৃত্ব। দ্বীন প্রতিষ্ঠার অর্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অসৎ ও খোদাবিমুখ লোকদের হাত থেকে সৎ ও খোদাভীরু লোকদের কাছে অর্পণ করা। সকল যুগে নবী-রসূলদের সাথে সমসাময়িককালের স্বৈরশাসকদের প্রচন্ড বিরোধীতার কারণ নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে। তারা মনে করতো সমাজ ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্ব চলবে তাদের; আর নবীদের দাওয়াত ছিল তাগুতকে অস্বীকার করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য মেনে চলার দিকে। আল্লাহর আনুগত্য অর্থ নবী-রসূলদের আনুগত্য। তাই স্বৈরশাসকরা সবসময় নবী-রসূলদেরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের দাওয়াত প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
মুহাম্মদ (সা)-এর দাওয়াতের লক্ষ্য ছিল দুনিয়ার মানুষকে সব ধরনের গোলামী থেকে মুক্ত করে নির্ভেজাল আল্লাহর গোলামীতে নিয়োজিত করা যাতে মানুষ মুক্তির দিশা পায়। মুহাম্মদ (সা)-এর অনুসারীদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে আখ্যায়িত করে আল্লাহ বলেছেন তাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে (সূরা আলে ইমরান ১১০)। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ সাধন এবং ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে আখিরাতের স্থায়ী জীবনে মুক্তির ব্যবস্থা করাই ছিল রসূল (সা)-এর জীবনের সকল সাধনা ও কর্মপ্রচেষ্টা।
দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহপাক তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে সাথে রসূল (সা)-এর আনুগত্যও ফরজ করে দিয়েছেন। এখানে ধর্মীয়, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক কর্মকান্ডের কোনো বাছ-বিচার নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মু’মিন পুরুষ ও নারীর সেই ব্যাপার নিয়ে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়’- সূরা আহযাব ৩৬। এই আয়াতটি হযরত যায়িদ বিন হারিসা (রা) ও হযরত জয়নব (রা)-এর বিবাহ বিষয়ে অবতীর্ণ হলেও এটিই ইসলামী আইনের মূলনীতি। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা) প্রদত্ত আইনের বিপরিতে কোনো ফয়সালা দানের এখতিয়ার কোনো মুসলিম দেশের শাসক, পার্লামেন্ট বা বিচারালয়ের নেই। ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং সব ধরনের লেনদেন ও কাজেকর্মে রসূলুল্লাহ (সা)-কে অনুসরণের কথাই এখানে বলা হয়েছে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে যে জিল্লতি তার মূলে রয়েছে ইসলামের প্রতি উদাসীনতা বা দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে বিভক্তি আনায়ন। দ্বীনকে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগীর মাঝে সীমাবদ্ধ করে জীবনের বৃহত্তর অংশে রসূলুল্লাহ (সা)-কে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণে অস্বীকার করা। দ্বীনের এই আংশিক মানার ক্ষেত্রে আল্লাহপাক কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনো আর কিছু অংশের সাথে কুফুরি করো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কী হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে তারা লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখিরাতে তাদের কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড থেকে আল্লাহ বেখবর নন’-সূরা বাকারা ৮৫। আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা আল্লাহর ঘোষিত লাঞ্ছনারই মুখোমুখি হয়েছে।
মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের জামায়াত শ্রেষ্ঠতম জামায়াত এবং দ্বীন মানার ক্ষেত্রে তাঁদের মাঝে সামান্যতম শৈথিল্য ছিল না; আল্লাহর ঘোষণা ‘তোমরা পরিপূর্ণ ইসলামে দাখিল হও’-এই নির্দেশ শতভাগ পালন করে তাঁরা আমাদের সম্মুখে উদাহরণ হয়ে আছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই সমাজই ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সমাজ এবং মানুষ শোষণ-বঞ্চণা, জুলুম-নির্যাতন ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকার মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। সেই সাহাবায়ে কেরামও আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই দুনিয়া থেকে বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
একনিষ্ঠভাবে রসূলুল্লাহ (সা)-কে অনুসরণের ফলে সাহাবায়ে কেরামের জীবনে সংঘটিত হয়েছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেদিনের খুনি হয়েছিল মানুষের জীবন রক্ষাকারী, ডাকাত হয়েছিল মানুষের জীবন ও সম্পদের পাহারাদার, ধর্ষক হয়েছিল নারীর ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষাকারী, এককথায় সমাজ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি, পাপাচার দূর হয়ে শান্তি ও স্বস্তির সমাজ গড়ে উঠেছিল। মক্কায় সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনে সাহাবায়ে কেরাম জর্জরিত হয়ে পড়লে রসূলুল্লাহ (সা) তাঁদের সান্ত্বনা ও আশার বাণী শুনিয়েছিলেন এই বলে, ‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন একজন ষোড়শী সানা থেকে হাজরা মাউত একাকী হেঁটে যাবে তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয়কে করতে হবে না’।
আল্লাহর কিতাব ও রসূল (সা)-এর আদর্শ আমাদের কাছে অবিকৃত ও জীবন্ত রয়েছে। তাঁকে পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে আমরাও স্বপ্ন দেখতে পারি তেমনি একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ, দুর্নীতি ও পাপাচারমুক্ত সমাজের, যেখানে থাকবে না শোষণ-বঞ্চণা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা, থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ ও জুলুম-নির্যাতন; থাকবে কেবল পরস্পর কল্যাণ কমনা ও সুধারণা। তেমন একটি সমাজ বিনির্মাণে আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন। আমিন। ৩০.০৯.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment