দরিদ্র বলতেই আমরা বুঝি যার টাকা-পয়সা নেই, ধন-সম্পদ নেই, স্বর্ণ-রৌপ্য বা ব্যাংক-ব্যালেন্স বলতে কিছুই নেই। আবার ঠিকমত খেতে পারে না, পরতে পারে না, মাথা গুঁজার নেই কোনো ঠাঁই। রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রশ্নের জবাবে সাহাবায়ে কেরাম (রা) এমনই জবাব দিয়েছিলেন এবং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু রসূল (সা)-এর জবাবটা ছিল ভিন্ন।
এই পৃথিবীতে ধনী ও দরিদ্র আপেক্ষিক। বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটিও পৃথিবীর সেরাদের তুলনায় নিজেকে বড় অসহায় ভাবতে পারে। আবার দরিদ্র মানুষটিও ভাবতে পারে বিল্ডিং না থাকলেও তার তো একটি কুঁড়েঘর আছে; দুটি চোখ, হাত-পা আছে ও কথা বলতে পারে। সে অন্ধ, খোঁড়া ও বোবার তুলনায় নিজেকে সুখী ভেবে আল্লাহর কৃতজ্ঞ হতে পারে। ধনী-দরিদ্রের সঠিক সংজ্ঞা দেয়া কঠিন, বলা যায় অনেকটা মানসিক। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছেন, ‘মনের ঐশ্চর্যই প্রকৃত ঐশ্চর্য’।
সম্পদের প্রতি মোহ, লোভ-লালসা স্বাভাবিক এবং এই মোহ মানুষকে পরিশ্রমী ও বড় হওয়ার জন্য প্রেরণা যোগায়। জীবনে ধনী হওয়া দোষের কিছু নয়। বরং দরিদ্র হয়ে থাকা ও কর্মবিমুখ থাকাকে ঘৃণা করা হয়েছে। আল্লাহর রসূল (সা)-এর একটি উক্তি, ‘দারিদ্র মানুষকে কুফুরিতে পরিণত করে’। তৎকালে অর্থবৃত্ত, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্বের কারণে রসূলুল্লাহ (সা) ওমর (রা) ও আবুল হাকাম (আবু জেহেল)-এই দু’জনের মধ্যে একজনকে ইসলাম কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন। সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্বের জন্য অর্থবৃত্ত বড় ভূমিকা রাখে। আল্লাহর রসূল (সা)-এর উক্তি, ‘জাহিলিয়াতের যারা নেতা তারা ইসলামেরও নেতা’।
দারিদ্র সম্পর্কে ইতিবাচক যা বলা হয়েছে তা হলো সে যেন হীনমন্যতায় না ভোগে বা সামাজিকভাবে তাকে হেয় না করা হয়। এই পৃথিবীতে রয়েছে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এবং আল্লাহ নিজেই বলেছেন, কাউকে তিনি রিজিকের প্রাচুর্যতা দান করেছেন, আবার কাউকে রিজিক দিয়েছেন সংকীর্ণ করে।
সমাজের মানুষ পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। ধনী ও দরিদ্র পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যও রয়েছে। ধনীর সম্পদে দরিদ্রের হক রয়েছে। এখানে কেউ আছে মালিক আবার কেউ আছে অধীনস্থ। মালিক ও অধীনস্থ মর্যাদায় কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহর কাছে মর্যাদা নিরূপিত হয় তাকওয়ার ভিত্তিতে। অধীনস্থের কর্তব্য মালিকের দেয়া কাজ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করা এবং মালিকের কর্তব্য হলো অধীনস্থের প্রতি সদয় হওয়া ও প্রাপ্য মজুরি ইনসাফের সাথে প্রদান করা। আল্লাহর রসূল (সা) বলেছেন, যে মজুর/শ্রমিক/কর্মচারি আল্লাহর হক ও মালিকের হক যথাযথভাবে আদায় করে সে মালিক অপেক্ষা সত্তর বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে।
দুনিয়া ও আখিরাত মিলেই মানুষের জীবন। দুনিয়ার জীবনে ধনী-দরিদ্র বড় কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। এ জীবনটা বড় ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত। ধনী ও দরিদ্র উভয়ই দুনিয়ার জীবনটি অতিক্রম করে আখিরাতের অনন্ত জীবনে পদার্পণ করবে। আখিরাতের জীবনের সাফল্যই হলো যথার্থ সাফল্য। এ দুনিয়ায় আরাম-আয়েস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ প্রয়োজন। কিন্তু পরকালিন জীবনের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন সৎ আমল ও নেকি। সেখানে টাকা-পয়সা, এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংকের চেক কোনো মূল্য বহন করবে না।
রসূলুল্লাহ (সা) সাহাবায়ে কেরামকে (রা) হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন অর্থ-সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বন এবং আল্লাহর বান্দাদের প্রতি জুলুম করা থেকে। আমাদের সমাজে ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ উপার্জন (ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানাবিধ অনৈতিক কাজ) এবং মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন বড় ভূমিকা পালন করে। হালাল উপার্জন করে ধনী হওয়া সম্ভব বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে। রসূল (সা) ব্যবসার ক্ষেত্রে তাঁর উম্মতদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, রুজির দশ ভাগের নয়ভাগ আছে ব্যবসায় এবং একজন সৎ ব্যবসায়ী ছিদ্দিকদের সমপর্যায়ভুক্ত। হযরত খাদিজা (রা) ও হযরত উছমান গণি (রা)সহ সাহাবায়ে কেরামদের (রা) মধ্যে অনেকেই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তাঁরা তাঁদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে অকাতরে খরচ করেছেন। ফলে ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই; বাধা রয়েছে অবৈধ পন্থায় ধনী হওয়া ও মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন করা।
রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, হতদরিদ্র সেই, নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের মতো নেক আমলের পাশাপাশি যে মানুষের প্রতি জুলুম করে (আর্থিক, শারীরিকসহ সব ধরনের), কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে ইনসাফপূর্ণ বিচার হবে এবং কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ জুলুম করা হবে না। এ দুনিয়ায় করা প্রত্যেকটি জুলুমের সেদিন বদলা গ্রহণ করা হবে। সেখানে বিনিময় হিসেবে কোনো টাকা-পয়সা বা স্বর্ণ-রৌপ্য থাকবে না। বদলা হিসেবে মজলুমকে জালেমের নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে। তাতে পরিশোধ না হলে মজলুমের গুনাহ জালেমকে দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাকে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে। সেদিন জালেম হবে একেবারে নিঃস্ব ও হতদরিদ্র।
জুলুম অর্থ অধিকার হরণ, সেটি আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক। আল্লাহর হক তাওবা (অনুতপ্ত হয়ে গুনাহ থেকে ফিরে আসা) করার মাধ্যমে ক্ষমার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বান্দার হক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির কাছ থেকে ক্ষমা ও আল্লাহর ক্ষমার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। কথা, কাজ ও আচরণের মাধ্যমে বান্দাকে কষ্ট দেয়া বা তার ক্ষতিসাধন করার নামই জুলুম। ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, ধোকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয়া, সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি, কাউকে গালি দেয়া, আঘাত করা, গুম-খুন করা, রিমান্ডে নেয়ে কষ্ট দেয়া ইত্যাদি যতো রকমের প্রক্রিয়া আছে তার কোনো না কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ক্ষতিসাধনের নামই জুলুম।
একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। হাদিসের ভাষায় একজন মু’মিনকে হত্যা করার চেয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভালো। মানুষকে হত্যা করা, গুম করা, ক্রসফায়ারে দেয়া আখিরাতে অবিশ্বাসী একজন নিরেট নাস্তিকের পক্ষেই সম্ভব। আর এ ধরনের নাস্তিক হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের চেয়েও অধম। নিহত ব্যক্তিকে হন্তা বা জালেমের পক্ষে আখিরাতে বদলা দেয়া কি আদৌ সম্ভব? সেখানে তার পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা, ব্যাংক-ব্যালেন্স কোনো কিছুই কাজে আসবে না। এমন শ্রেণির মানুষের আমলনামায় যতটুকু নেকি থাকবে সেটি দেয়ার পরও পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ হবে না, তখন পাওনাদারদের গুনাহ তাকে প্রদান করে বিশাল গুনাহর বোঝার ভারসহ তাকে গলাধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আজকে যে ক্ষমতার দাপট তা যদি অবৈধ পন্থায় হয় তাহলে এ দুনিয়ার শান-শওকত, মান-ইজ্জত-সম্মান, অর্থবৃত্ত তা বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এসব জালেমদেরকেই রসূলুল্লাহ (সা) হত-দরিদ্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। পৃথিবীতে ধনী হোক, দরিদ্র হোক সে যদি নেক আমলে সমৃদ্ধ হয় এবং তার বিরুদ্ধে কোনো জুলুমের অভিযোগ না আসে তাহলে সেই সবচেয়ে ধনী, বড় ভাগ্যবান; তার জন্যই রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাতের সুখ ও শান্তির অফুরন্ত সামগ্রী।
আল্লাহপাক মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র ঘোষণা করেছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রিয়তম নবী (সা) তাঁর উম্মতদের এ প্রসঙ্গে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। মানুষকে গালিগালাজ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হেয় করা, অপমান করা, খারাপ নামে ডাকা, তার কোনো দুর্বলতাকে ব্যবহার করে হাসি-তামাশা করা সবই কবিরা গুনাহ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে’। এদের জন্যই রয়েছে হুতামা (চূর্ণ-বিচূর্ণকারী স্থান) এবং তা আল্লাহর আগুন প্রচন্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত, অন্তর পর্যন্ত স্পর্শ করে। গালাগালির পরিণতি যদি এই হয় তাহলে চড়-থাপ্পড়, গুম-খুনের পরিণতি কী হবে?
উপরোক্ত আলোচনায় ভয় পাওয়ারই কথা। হ্যাঁ, তাই। ইসলাম সমাজজীবনকে খুব বড় করে দেখে। একজন মু’মিন সেই যার কাছ থেকে আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টিজগত নিরাপদ। তার থেকে কারো ভয় বা সামান্যতম ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, জীবনে কি এতো হিসাব করে চলা সম্ভব হয়েছে বা আমাদেরই কি সেই উপলব্ধি ছিল? এখন তো পেছন ফিরে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। আমি তো পরিশুদ্ধ হতে চাই। এখন উপায়? আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন। ঈমানদারদের কষ্ট দেয়া আল্লাহর কাছে বড় অসহনীয় এবং যারা কষ্ট দেয় তাদের পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয়, অতঃপর তাওবা করে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’।
‘অতঃপর তাওবা করে না’-এই বাক্যের মাঝে আশার বাণী রয়েছে। কোনো মানুষের মাঝে যদি তার অতীত গুনাহের কারণে উপলব্ধি আসে এবং সাধ্যমত প্রায়শ্চিত্ত করে অর্থাৎ যাদের প্রতি অতীতে জুলুম করেছে সম্ভবমত ক্ষমা চেয়ে নেয়া বা তাদের উদ্দেশ্যে সদকা করা এবং তাদের মাগফেরাত কামনা করে আল্লাহর কাছে কাতরভাবে দুআ করার মাধ্যমে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ সম্ভব হতেও পারে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ার্দ।
এ দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। আল্লাহতায়ালা জালেম ও মজলুম উভয়েরই পরীক্ষা গ্রহণ করছেন। মজলুম পরীক্ষা দিচ্ছে ঈমানের দাবীতে কতখানি সত্যবাদী তার, আর জালেমের সীমালঙ্ঘনও আল্লাহ দেখছেন। দুনিয়ার জীবনটা বড়ই ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের অবসান ঘটে। জালেম ও মজলুম উভয়ই আল্লাহর কাছে ফিরে যান এবং যান মজলুম ফরিয়াদী হয়ে এবং জালেম আসামী হয়ে। সেদিন জালেমের মতো নিঃস্ব ও হতভাগা আর কেউ থাকবে না। হে আল্লাহ! সব ধরনের জুলুম থেকে আমাদেরকে হেফাজত করো। ০৭.০৯.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment