আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালার দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে তাঁর অগণিত বান্দাদের মধ্য থেকে তাঁর ঘরে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমাদেরকে বাছাই করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ। দরুদ ও সালাম প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সো)-এর ওপর।
বলা যায়, আজ আমাদের দু’টি ইদ। সকালে ইদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছি এবং এখন আদায় করছি সালাতুল জুমা। জুমাও আমাদের ইদের দিন। গোসল সেরে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকাল সকাল মসজিদে উপস্থিত হওয়ার মধ্যে রয়েছে প্রভূত ছওয়াব। হাদিসে বলা হয়েছে, আগে আগে আসার প্রেক্ষিতে উট, গরু, ছাগল কুরবানি করার ছওয়াব মুছল্লির আমলনামায় লেখা হয় এবং খতিব মহোদয় যখনই মিম্বরে আরোহণ করেন তখনই ফেরেশতারা ছওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনায় নিয়োজিত হন। মানুষ যাতে খতিবের বক্তৃতা শোনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ও শোনেন সেজন্য ঢাকায় কোনো কোনো মসজিদে পরে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার সময় দেয়া হয় না। ঢাকায় আমি যেসব মসজিদে জুমা পড়ি সেসব মসজিদে সাড়ে বারোটায় গিয়ে খতিব মহোদয় যে ফ্লোরে দাঁড়িয়ে খুতবা দেন সেখানে জায়গা পাওয়া যায় না, দোতলা বা তিনতলায় যেতে হয়। দুর্ভাগ্য, গ্রামের অধিকাংশ মসজিদে মুছল্লিরা খুতবা শোনার গুরুত্ব অনুভব করেন না। জুমার ছওয়াব পাওয়ার লক্ষ্যে সকাল সকাল মসজিদে আসার জন্য আমি আপনাদের অনুরোধ করছি।
এক মাস সিয়াম সাধনার পর আজ আমাদের ইদ ও জুমার দিন। আমরা বিশ্বাস করি, মহান আল্লাহপাক রমজানের অছিলায় আমাদের অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এটি মনে না করার কোনো কারণ নেই। কারণ রসুলুল্লাহ (সা) নিজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই সুসংবাদ শুনিয়েছেন। সত্যিই আমরা ভাগ্যবান। এই সুসংবাদ প্রাপ্তির ফলই আমাদের ইদ আনন্দ। সফলভাবে সিয়াম পালন শেষে রোজা ভাঙ্গা ও গুনাহ মাফের ফলস্বরূপ ইদুল ফিতর। ইদের দিন দুরাকাত নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
রমজানের যে সিয়াম তাতো এ লক্ষ্যেই যে, আমাদের মাঝে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হবে। একদিন দু’রাকাত নয়, টানা একটি মাস আমাদের তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। আমরা যেমন আল্লাহর সাময়িক নিষেধের কারণে দিনের বেলায় হালাল জিনিস গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, তেমনিভাবে বাকি এগারোটা মাস আল্লাহর সকল নাফরমানি থেকে দূরে থাকবো এটিই স্বাভাবিক এবং রমজানের শিক্ষাও তাই। আমরা যদি তা পারি তাহলে রমজানের রোজা রাখা সার্থক হবে এবং রসুলুল্লাহ (সা)-এর ঘোষণা মোতাবেক যে দরজা দিয়ে খুশি আমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো।
রমজানের সিয়াম পালনের মাধ্যমে জীবনের সকল পাপ থেকে আমরা মার্জনা লাভ করেছি। এটি আল্লাহ তায়ালার বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করতে চান এবং ক্ষমা করার নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন। এর মধ্যে রমজানের সিয়াম অন্যতম। আমাদের জীবনের বাকি দিনগুলো যদি গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে পারি এবং আল্লাহর বিধানসমূহ মেনে চলতে পারি তাহলে আশা করা যায় তিনি আমাদের ক্ষমা করবেন ও জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ দিবেন। আমাদের জীবন বড় অনিশ্চিত। হয়তো শয়তান প্ররোচনা দেয়, বয়স কেবল ৪০, এখনই তো দুনিয়াটা ভোগ করার সময়। ৭০ বছর বয়সে তাওবা করে ভালো হয়ে যাওয়া যাবে। এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে, এক ৭০ বছর বাঁচার গ্যারান্টি ও দুই. সে সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবা করার তৌফিক লাভ। আমরা প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যু দেখছি এবং এই মৃত্যুতে কোনো সিরিয়াল নেই। যুবক বয়সের অনেকেই হার্টএ্যাটাক, ব্রেনস্ট্রোক, এক্সিডেন্ট নানাভাবে মৃত্যুবরণ করছে। তাই উপলব্ধি আসার সাথে সাথে আর অপেক্ষা না করে আমাদের উচিৎ আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। বান্দার ফিরে আসার জন্য আল্লাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।
বিশেষ বিশেষ দিন ও ক্ষণে আল্লাহ তাঁর অগণিত বান্দাকে মাফ করেন। তন্মধ্যে যারা শিরক করে ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে তারা আল্লাহর এই ক্ষমার বাইরে। আমাদের সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ অত্যন্ত ব্যাপক। রাজনীতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ, আলেম-উলামা কেউ আর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত নয়। এছাড়া ভাই-ভাই, পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, অফিসে বস ও অধীনস্থ সকল ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি রয়েছে হিংসা ও বিদ্বেষ। অথচ এই হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কে কত কঠোরভাবে প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা) আমাদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠ জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণকারী আল্লাহর দরবারে আমলশুন্য অবস্থায় হাজির হবে। আমাদের সমাজে গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতনের মূল কারণ হিংসা ও বিদ্বেষ।
এ প্রসঙ্গে আমি একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই, জনৈক সাহাবির মসজিদে প্রবেশের সময় রসুলুল্লাহ (সা) তার দিকে ইংগিত করে বলেন, মসজিদে প্রবেশকারী ব্যক্তি জান্নাতি। সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি দ্বিতীয় দিন একই উক্তি করেন। একজন সাহাবির জানার আগ্রহ হলো, এমন কী আমলের কারণে আল্লাহর রসুল (সা) তাঁকে জান্নাতি ঘোষণা করলেন। তিনি সেই সাহাবির মেহমান হয়ে তিনদিন অবস্থান করলেন এবং তাঁর মধ্যে এমন কোনো বাড়তি আমল লক্ষ্য করলেন না। শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ আমলের কারণে রসুলুল্লাহ (সা) তাঁকে জান্নাতি ঘোষণা করলেন। জবাবে তিনি বললেন, এমন কোনো আমল তাঁর নেই, তবে প্রতিদিন ঘুমানোর পূর্বে তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দেন এবং কারো প্রতি তাঁর কোনো বিদ্বেষ নেই। তিনি বুঝলেন, জান্নাতে যাওয়ার জন্য এই একটি আমলই যথেষ্ট। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। হিংসুটে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে বড় ঘৃণ্য এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাঁর কাছে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন (সুরা ফালাক)।
ইমাম-মুয়াজ্জিন আমাদের নেতা ও সম্মানের পাত্র। সম্মানজনকভাবে জীবন যাপনের লক্ষ্যে ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের মতো সম্মানি আমরা তাঁদের দিতে পারি না। অথচ তাঁদের পেছনে খরচের জন্য আল্লাহ তাগিদ দিয়েছেন। আত্মসম্মানবোধের কারণে তাঁরা মানুষের কাছে হাত পাততে পারে না। আল্লাহ বলেছেন, তারা সর্বক্ষণ আল্লাহর দীনের কাজে নিয়োজিত। তাই মসজিদে খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সম্মানি দানের লক্ষ্যে আমরা বেশি বেশি করে দান করি। কত দান করবো আমরা যেন তা হিসাব না করি, বিনিময়ে আল্লাহও আমাদের বেহিসেবি দেবেন।
রোজার শিক্ষা ধারণ করে আমরা যেন আল্লাহর সকল নাফরমানি থেকে দূরে থাকতে পারি এবং বেশি বেশি করে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে পারি সেই তৌফিক আল্লাহপাক আমাদের দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment