জুমা
আলোচনা (কুচিয়ামোড়া জামে মসজিদ)
২৮.০৫.২০২১
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে উপস্থিত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ। দরুদ ও সালাম প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর।
আল্লাহপাক আমাদেরকে মোমিন ও মুসলিম হয়ে জীবন যাপনের সুযোগ দান করেছেন বিধায় আমরা আবারও তাঁর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদু লিল্লাহ। আমরা জানি, মোমিন ও মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহ তায়ালার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন এবং তাঁর এই প্রিয় বান্দাদের জন্যই আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন অসংখ্য নেয়াভতেভরা জান্নাত। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় বান্দাদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত এবং মুসলমান না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করোনা না’- সুরা আলে ইমরান ১০২।
আল্লাহর এই উক্তির মধ্যে বড় ভয় এবং সাবধান বাণী আছে। সাহাবায়ে কেরামও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য আল্লাহ এটাও বলেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যতখানি সাধ্যে কূলায়। অর্থাৎ যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাকো। আবার তিনি বলেছেন, আল্লাহ কাউকে তাঁর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাননি। আমরা এবারে একটু চিন্তা করি, আল্লাহকে আমরা কীভাবে ভয় করবো। সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভয় করে, স্ত্রী তার স্বামীকে আবার স্বামী তার স্ত্রীকে ভয় করে, অফিসে কর্মচারী তার বসকে ভয় করে, কর্মী তার নেতা-নেত্রীকে ভয় করে, দেশের নাগরিক সরকারকে ভয় করে। আবার মানুষ মস্তান ও চোর-ডাকাতকেও ভয় করে। ভয় করা অর্থ মেনে চলা, মর্জি বুঝে চলা এবং এই ভয় করার পেছনে কারণ ক্ষতির সম্ভাবনা। অফিসের কর্মচারী তার বসকে ভয় বা না মেনে চললে চাকুরী হারাবার সম্ভাবনা থাকে, স্ত্রী তার স্বামীকে ভয় না করলে সংসারে অশান্তি এমনকি ডিভোর্স পর্যন্ত ঘটতে পারে। কর্মী নেতা-নেত্রীকে ভয় না করলে বা না মানলে রাজনীতিতে তার উন্নতি ব্যাহত হতে পারে। সরকারের হাতে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আছে আদালত ও কারাগার। সরকারকে অমান্য করলে জেল-জুলুমের ভয় রয়েছে।
আমরা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও ভয় করার পেছনে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করলাম। সরকারের নিয়ম, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। গ্রামে আপনারা কেউ মাস্ক পরেন না। কিন্তু আপনারা যখন ঢাকা যাবেন তখন সবাই মাস্ক পরেই রওনা হবেন। কারণ, আপনাদের ভয় আছে যে পুলিশে ধরলে হেনস্থা হওয়ার ভয় রয়েছে। জেল-জরিমানাও হতে পারে। এখন আল্লাহর ক্ষমতাটা একটু বিবেচনা করুন। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ বেঁচে থাকা, আয়-উপার্জন, সুস্থতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরিতে উন্নতি সবকিছু নির্ভর করে একান্তভাবে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর। সার্বভৌম ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, চরম ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় সবই আল্লাহর। কোনো কিছু করা বা হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি শুধু বলেন ‘হও’- তাৎক্ষণিক সেটি হয়ে যায়। আপনারা কি আল্লাহর ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারছেন? সবাই হাঁ সূচক জবাব দেন। শুধু কি দুনিয়ার জীবন? মৃত্যুর পরে জান্নাত বা জাহান্নাম- সেটিও নির্ভর করছে আল্লাহর মর্জির ওপর। যে আল্লাহর এত ক্ষমতা ও এখতিয়ার সেই আল্লাহকে কী পরিমাণ ভয় করতে হবে, এবারে একটু চিন্তা করুন।
আল্লাহ সতর্ক করেছেন, মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। এটি একটি সতর্ক বার্তা। আল্লাহপাক মুসলমানের জন্য রেখেছেন চিরসুখের স্থান জান্নাত এবং কাফেরের জন্য রেখেছেন ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক জাহান্নাম। আল্লাহপাক এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মুসলমান অর্থ অনুগত অর্থাৎ আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। নামাজের প্রসঙ্গেই বলি, ইমান আনার পরে একজন মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। একজন ব্যক্তি ইমানের দাবীতে যে সত্যবাদী তার প্রমাণ নামাজ। আল্লাহপাক সুরা মুদ্দাসসিরে বলেছেন, কোন্ জিনিস তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে আসলো? তাদের প্রথম জবাব হবে, আমরা নামাজীদের মধ্যে শামিল ছিলাম না। যে ব্যক্তি দাবী করে যে সে আল্লাহকে ভয় করে সে কি কখনো মসজিদে হাজির না হয়ে পারে?
আল্লাহর ভয় মানুষকে সবধরনের অন্যায়-অপকর্ম থেকে দূরে রাখে এবং দূরে থাকতে সে বাধ্য। আজ সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। আল্লাহর রসুল (সা)-এর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘ঘুষের দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামী।’ দুর্নীতি দমন কমিশনের গেটে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই হাদিসটি প্রচার করা হয়। যার মধ্যে সামান্যতম আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা ভয় রয়েছে, সে কি কখনই ঘুষের লেনদেন করতে পারে? অসম্ভব, যারা ঘুষ খায় বুঝবেন, নিরেট নাস্তিক ছাড়া সে আর কেউ নন। শুধু ঘুষ নয়, মানুষের জন্য ক্ষতিকর সবধরনের আচরণ, লেনদেন ও কার্যক্রম সবই কবিরা গুনাহ। হতে পারে সেটি ভেজাল দেয়া, ধোকা-প্রতারণা করা, ওজনে কম দেয়া, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, আমানতে খেয়ানত করা বা গীবত, যিনা-ব্যাভিচার, পর্দাহীনতা যা সমাজকে কলুষিত করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে সবই বড় বড় গুনাহ (কবিরা গুনাহ)। এগুলো বদির পাল্লায় এক একটি টনের ওজন (বোঝানোর স্বার্থে বলা), বিপরিতে শবেবরাত, শবেকদর বা বিভিন্ন মুহূর্তে নফল ইবাদত-বন্দেগির ওজন কবিরা গুনাহের মোকাবেলায় নেকির পাল্লায় কাচ্চার ওজন বা ওজনই হবে না। এসব নফল ইবাদত-বন্দেগির ওজন তখনই হবে যখন আপনি কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকবেন এবং আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ-ওয়াজিব পালন করবেন।
আমরা যাদের কাফের-মুশরিক হিসেবে জানি সেই ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের ব্যবহারিক জীবন আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত- মিথা-শঠতা, ধোকা-প্রতারণা এবং আমরা যা কবিরা গুনাহ হিসেবে জানি সেসব থেকে তারা মুক্ত। হয়তো সেজন্যই তারা বিশ্ব শাসন করছে। আমাদের উপলব্ধি নেই যে একটি বিশ্বাসী জাতি হিসেবে কোনো অবস্থাতেই এসব কবিরা গুনাহের সাথে আমরা সংশ্লিষ্ট হতে পারি না। আমাদের আর একটি বড় সমস্যা হিংসা-বিদ্বেষ যা আমাদের অগ্রসর হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। হিংসা-বিদ্বেষ শুধু কবিরা গুনাহ নয় বরং অতীতের সকল নেক আমল ধ্বংসকারী। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। আমাদেরকে ক্ষমার গুণে গুণান্বিত হতে হবে। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। অপরকে ক্ষমার মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে জান্নাতে যাওয়ার অপূর্ব সুযোগ। যে ব্যক্তি ক্ষমা করতে পারে সে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
আল্লাহ
আমাদেরকে তাঁকে যথাযথভাবে ভয় করে একান্ত অনুগত বান্দা হয়ে চলার তৌফিক আমাদের দান
করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment