জুমা আলোচনা (কুচিয়ামোড়া জামে মসজিদ)
২১.০৫.২০২১
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর মোমিন বান্দা হিসেবে বাছাই করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তায়ালা তাঁর মোমিন বান্দা হিসেবে আমাদের ক্ষমা করবেন ও জান্নাতে স্থান দান করবেন। আমাদের এই প্রত্যাশার পেছনে কারণ, মহান আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি। তিনি কখনই তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। আমি আপনাদের সম্মুখে সুরা আল মোমিনুনের প্রথম ১১টি আয়াত উদ্ধৃত করতে চাই। এই আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পরপরই আল্লাহর রসুল (সা) বলেন, আমার ওপর এমন দশটি আয়াত নাজিল হয়েছে, যদি কেউ সেই মানদণ্ড পুরোপুরি উতরে যায় তাহলে সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে।
‘নিশ্চিত কল্যাণ লাভ করেছে ইমান গ্রহণকারী লোকেরা যারা নিজেদের নামাজে ভীতিমিশ্রিত বিনয় অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে দূরে থাকে, যারা জাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তবে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী এবং (পুরুষের বেলায়) নিজেদের মালিকানাধীন (দাসী)-দের ওপর (এ বিধান প্রযোজ্য) নয়। এ ক্ষেত্রে (হেফাজত না করা হলে) তারা কিছুতেই তিরষ্কৃত হবে না। অবশ্য এ ছাড়া অন্য কিছু চাইলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। যারা তাদের আমানত ও ওয়াদা-চুক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং নিজেদের নামাজসমূহের পূর্ণ হেফাজত করে। এ লোকগুলোই হচ্ছে (মূলত জমিনে আমার যথার্থ) উত্তরাধিকারী, জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী; সেখানে চিরকাল থাকবে’- সুরা আল মোমিনুন ১-১১।
সুরা আল মোমিনুন মক্কিযুগের মাঝামাঝি সময়ে অবতীর্ণ। সে সময়ে যারা ইমান এনেছিলেন বাহ্যত তারা নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সমাজের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, সজ্জন ও যুবক শ্রেণি রসুল (সা)-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলেন। তাদের এই সাড়া দেয়াকে অনেকে চরম বোকামী ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছিল এবং নির্বুদ্ধিতার কারণেই নাকি তারা বিপদের মুখে পড়েছিল। নিজেদের আত্মীয়-স্বজন-বংশ ও পাড়া-প্রতিবেশি সবার কাছ থেকে তারা উপেক্ষা ও নিন্দাবাদ এবং ইসলামের দুশমনদের কাছ থেকে নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়- ‘নিশ্চিত কল্যাণ লাভ করেছে ইমান গ্রহণকারী লোকেরা’। আল্লাহ তায়ালা যে ফালাহ বা কল্যাণের কথা বলেন তা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়বিধ কল্যাণকেই বুঝায়।
আল্লাহপাক এখানে কল্যাণ লাভকারী বান্দাদের ছয়টি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকার হতে হলে অবশ্যই তাদের এসব গুণে ভূষিত হতে হবে।
প্রথম ও প্রধান গুণ হলো নামাজে ভীতিমিশ্রিত বিনয় অবলম্বন। আমাদের বুঝতে হবে, দৈনিক পাঁচবার আমরা কোন্ সত্তার সম্মুখে দণ্ডায়মান হই। আল্লাহ তায়ালার গুণ, ক্ষমতা, এখতিয়ার উপলব্ধি করলে অবশ্যই আমাদের মধ্যে ভয় ও বিনয় চলে আসবে। সাধারণত সমাজের উচ্চপদস্থ কারো সাথে সাক্ষাতের সময় আমরা ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানের সাথে অত্যন্ত বিনয় অবলম্বন করে থাকি। তাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু। আর আল্লাহপাকের ক্ষমতা-এখতিয়ার অসীম। আমাদের রুজি, সুস্থতা, ভালো-মন্দ ও মৃত্যুর পরে জান্নাত-জাহান্নাম সবই আল্লাহর হাতে। আল্লাহর ভয় সর্বদা অন্তরে পোষণ করতে হবে। বিশেষ করে যখন নামাজে দাঁড়াবো তখন আল্লাহকে না দেখলেও তিনি দেখছেন, এই উপলব্ধি অন্তরে অনুভব করার জন্য আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন। নামাজে তাড়াহুড়া না করা, রুকু-সেজদাসহ সকল আহকাম ধীরস্থির ও সুন্দরভাবে করা বাহ্যিক খুশু-খুজু, আর অন্তরে ভয় এবং তার বহিপ্রকাশ আমলে প্রকাশ অন্তরের খুশু-খুজু। নামাজের কল্যাণকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কার্যক্রম থেকে বিরত রাখে।
দ্বিতীয় গুণের কথা বলা হয়েছে, মোমিন বেহুদা ও অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে। যে কাজে ব্যক্তি ও সমাজে কোনো কল্যাণ নেই বরং ক্ষতি হয় এমন সকল কথা, কাজ ও আচরণের সাথে মোমিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফেসবুকে অশালীন ছবি দেখা, ভিডিও গেম খেলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার মতো সময় মোমিনের কোথায়? জীবনের একটি বড় অংশ ঘুমিয়ে কাটানোর সুযোগও মোমিনের নেই। মোমিন একজন কর্মব্যস্ত মানুষ। প্রতিটি মুহূর্ত মোমিনের জন্য দামী।
তৃতীয়ত জাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর। জাকাতের দ্বিবিধ অর্থ। এক. প্রবৃদ্ধি দুই. পবিত্রতা সাধন। জাকাত আদায় করবে কেবল এমনটি নয়, তার জীবনটি হয় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন। কোনো ধরনের নোংরামির স্পর্শ তার জীবনে নেই। তার পোশাক-পরিচ্ছদ যেমন পবিত্র-পরিচ্ছন্ন, তেমনি তার চিন্তা-ভাবনা সবই পবিত্র।
চতুর্থত লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। অন্যত্র বলা হয়েছে, জিনা-ব্যাভিচারের ধারে-কাছেও যেও না। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা দুই ঠোঁট ও দুই রানের মাঝখানের হেফাজতের নিশ্চয়তা দিলে আমি তোমাদের জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে পারি। সব ধর্মেই জিনা-ব্যভিচারকে ঘৃণা করা হয়েছে। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা এতটুকু বলেই ছেড়ে দেননি। মানুষের যৌনচাহিদা পূরণের জন্য তিনি হারাম-হালালের একটি সীমারেখা দান করেছেন।
পঞ্চমত বলা হয়েছে আমানত সংরক্ষণ করে। আমানতের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার কাছে আমানত। তাদেরকে যথার্থভাবে লালন-পালনের সাথে নৈতিকতা শিক্ষাদান পিতা-মাতার দায়িত্ব আবার পিতা-মাতাও সন্তানের কাছে আমানত। বার্ধক্যে তাদের দেখাশোনা ও সন্তুষ্ট রাখা সন্তানের দায়িত্ব। আবার আমরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। পেশার প্রতি আন্তরিক ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন এটিও আমানতের সংরক্ষণ। সরকারি দায়িত্ব পালনকারীদের কাছে জনগণ আমানত। জনগণের প্রতি ইনসাফ করা তাদের দায়িত্ব। বিভিন্ন অফিস-আদালতে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের দায়িত্বটাও আমানত। রসুলুল্লাহ (সা) খুব শক্তভাবে বলেছেন, আমরা যাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করি তারা তাদের নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব যদি সেভাবে পালন না করে তাহলে উল্টা করে তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সরকারি অফিসে ঘুষ-দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না, যে কাজ দশ মিনিটে হওয়া সম্ভব তার জন্য আধা ঘন্টা লাগানোও জুলুম ও খেয়ানত। সরকারি তহবিল তছরূপ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কেউ যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে বিচারের দিন সে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে উত্থিত হবে।
ষষ্ঠত, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন। একজন যথার্থ মোমিন কখনই ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে না। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ। একজন মুনাফিকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। তন্মধ্যে আমানতে খেয়ানত করা ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন, ঐ ব্যক্তির ইমান নেই যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই এবং ঐ ব্যক্তির ধর্ম নেই যার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই। চারিত্রিক এই ত্রুটি আজ অধিকাংশ মানুষের মাঝে বিদ্যমান এবং তার ফলশ্রুতিতে সমাজে এত দুর্নীতি, অবিচার ও অশান্তি। বলা যায়, মোমিন নয় মুনাফিকে সমাজটা ভরে গেছে। ব্যাংকে ঋণখেলাপি শব্দটি ব্যাপকভাবে চালু। আসলে ঋণখেলাপি নয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ওরা নিরেট মুনাফিক। রাজনীতির অঙ্গনে ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ একটি সাধারণ ব্যাপার। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা তারা আদৌ অনুভব করে না। আর খেয়ানতের তো কথাই নেই, চুরি শুধু চুরি নয়, পুকুরচুরি, না তার চেয়েও বড় সাগরচুরি। এই যাদের অবস্থা তারা জান্নাতের প্রত্যাশা করবে কীভাবে?
আল্লাহপাক সফলকাম মোমিনের গুণ শুরু করেছেন নামাজ দিয়ে আবার শেষ করেছেন ‘নিজেদের নামাজসমূহের পূর্ণ হেফাজত করে’- এ কথা বলে। ইচ্ছামত নামাজ আদায় নয় বা কেবল জুমা আদায় নয় সকল নামাজ পূর্ণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে আদায় করে। নামাজে শৈথিল্য প্রদর্শনকারী হয় কাফির নয়তো মুনাফিক। জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য মোমিনের যেসব গুণাবলী এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের জীবনে লাভ করার তৌফিক আল্লাহপাক আমাদের দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment