ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যেটা দাবী করে ইসলাম সেটি অস্বীকার করে না। মানুষের যৌন চাহিদা প্রকৃতিগত এবং এই চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহপাক বিবাহের বিধান দান করেছেন। বিবাহ বহির্ভূত যৌন চাহিদা পূরণের সকল প্রক্রিয়াকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। বয়োপ্রাপ্তির সাথে সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলাম নারী-পুরুষকে উৎসাহ দান করেছে এবং বিবাহকে সহজ করেছে। এমন কি অসচ্ছল হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সচ্ছলতা দানেরও ওয়াদা রয়েছে। বিবাহের মৌলিক উদ্দেশ্য চারিত্রিক হেফাজত এবং স্বামী-স্ত্রীর পরিতৃপ্তি লাভ। আল্লাহর বাণী, ‘তাঁর নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে জুড়ি (বিপরিত লিঙ্গের) সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা তাদের কাছে সুখ শান্তি লাভ করতে পারো, তিনি তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও সৌহার্দ সৃষ্টি করে দিয়েছেন, অবশ্যই এর মাঝে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে অনেক নিদর্শন রয়েছে’-সূরা রূম ২১।
বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর ওপর কিছু ফরজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়। তন্মধ্যে পরস্পরের যৌন চাহিদা পূরণ মৌলিক দায়িত্ব। পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস ও স্বতস্ফুর্ত সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এই চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তৃপ্তি ও সুখ লাভ হয়। পরস্পরের প্রতি সদাচরণও দায়িত্বের অংশ। স্বামী থেকে ভরণপোষণ ও উত্তম ব্যবহার পাওয়া স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রীর অনুগত হয়ে চলা স্বামীর হক। আল্লাহপাকই পুরুষকে এই অধিকার দান করেছেন (পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্বশীল----- পুণ্যবতী নারীগণ অনুগত এবং আল্লাহ যে সকল জিনিসকে রক্ষণীয় গণ্য করেছেন, সেগুলোকে স্বামীদের অনুপস্থিতিতেও সংরক্ষণ করে’-নিসা ৩৪)। এ-সব বিষয়ে হাদিসে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
বিবাহের মাধ্যমে পরস্পরের যে সব অধিকার ও কর্তব্য অর্পিত হয় তা পালন একান্ত সম্ভব না হলে, সেক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্ক অবসানকে বলা হয় তালাক। আল্লাহ চান, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য বন্ধন টেকসই, স্থিতিশীল, অটুট ও জীবনব্যাপী হোক। তাদের গৃহ হোক নিরাপদ আশ্রয়স্থল, দু’জনে শান্তিতে বসবাস করুক এবং তাদের সন্তানদেরকে সুযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলুক। স্বামী-স্ত্রীর চুক্তিকে আল্লাহপাক ‘মজবুত অঙ্গীকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, ‘(তোমাদের স্ত্রীরা) তোমাদের নিকট থেকে মজবুত অঙ্গীকার আদায় করেছে’-নিসা ২১। আল্লাহর এই ঘোষণার মাধ্যমে দাম্পত্য বন্ধনটা পবিত্রতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ বলে বিবেচিত।
স্বামী-স্ত্রীর এই মজবুত ও পবিত্র সম্পর্ক কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক আল্লাহপাক তা পছন্দ করেন না। কারো পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করা অত্যন্ত ঘৃণিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিনষ্ট করার জন্য শয়তান সব সময় সক্রিয় থাকে এবং অভিশপ্ত শয়তানই প্ররোচনা দিয়ে থাকে। ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘বৈধ কাজের মধ্যে তালাকই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত’-আবু দাউদ। রসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে, সে আমার দলভুক্ত নয়’-আবু দাউদ, নাসায়ী। পক্ষান্তরে স্বামী-স্ত্রীর ভেঙ্গে পড়া সম্পর্ক জুড়ে দেয়া অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখের সাথে সাথে এ ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাকেও জায়েজ করা হয়েছে। ছাওবান (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে নারী বিনা কারণে স্বামীর কাছে তালাক চায়, তার ওপর বেহেশতের ঘ্রাণও হারাম’-আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ।
স্বামী-স্ত্রীর সবকিছু যে পছন্দনীয় হবে বা চাওয়া-পাওয়া পূরণ হবে এমনটি নয়। দুনিয়া ও আখিরাত নিয়েই মানুষের জীবন। কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হলে ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে আখিরাতে পূরণ করে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর। আবার এ দুনিয়াতেও নানাভাবে আল্লাহ পূরণ করে থাকেন। আল্লাহর বাণী, ‘স্ত্রীদের সাথে প্রচলিত নিয়মে ভালো ব্যবহার করো। যদি তারা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় হয়, তাহলে হতে পারে, তোমরা কোনো জিনিসকে অপছন্দ করো অথচ আল্লাহ তার মধ্যে প্রচুর কল্যাণ রেখেছেন’-নিসা ১৯। কল্যাণ-অকল্যাণ সবই আল্লাহর হাতে। ইমাম মালেক (রহ)-এর মা’র ঘটনা আমাদের জানা। মহিলা সুশ্রী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন বড় গুণবতী। প্রথম রাতেই স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পর তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে পড়েন। ধৈর্যশীলা সেই নারীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন জগতবিখ্যাত ফকীহ ইমাম মালেক (রহ)। তকদিরের ওপর বিশ্বাস করে ধৈর্যাবলম্বন বান্দার দায়িত্ব। আল্লাহর ওয়াদা, তিনি ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
ইসলামে তালাকের অধিকার দেয়া হয়েছে স্বামীকে। এ অধিকার আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহপাক অত্যন্ত বিজ্ঞ ও সুক্ষ্ণদর্শী এবং তিনিই জানেন তাঁর বান্দার কিসে কল্যাণ ও অকল্যাণ। নারী সাধারণত অস্থিরমতি। তাকে অধিকার দেয়া হলে তালাকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। যেমনটি ইউরোপ-আমেরিকা দেখা যায়। আমাদের দেশেও পাশ্চাত্যঘেষা নারীদের মাঝে তালাকপ্রবণতা বেশি। অনেকেই আছেন এক স্বামীতে পরিতৃপ্ত নন। ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীর মাঝে তালাকের পরিমাণ খুবই কম। কারণ ইসলামে তালাক চাওয়া ও প্রদানকে ঘৃণা করা হয়েছে। তালাকের মাধ্যমে দাম্পত্য বন্ধন ভেঙ্গে দিলে নারী ও পুরুষ উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে বেশি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে নারী। নারীকে তালাক চাওয়ার সুযোগ দেয়া হলেও তালাক প্রদানের অধিকার দেয়া হয়েছে পুরুষকে এবং তা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায়।
স্ত্রীর চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা, স্বামী ও তার পিতা-মাতার সাথে অসদাচরণ এবং নানাবিধ গুরুতর কারণে সংশোধনের সকল পথ রুদ্ধ হলেই কেবল তালাকের প্রশ্ন আসে। প্রথমে স্বামী চেষ্টা করবে তাকে বোঝানোর, প্রয়োজনে বিছানা আলাদা করে দিবে, তাতেও সংশোধন না হলে হালকা মারপিট করবে (সূরা নিসা ৩৪)। এ-সবই কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত। তাতে কাজ না হলে অভিভাবক পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাবে। আল্লাহর বাণী, ‘যদি তোমরা তাদের সম্পর্কচ্ছেদের আশঙ্কা করো, তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ পাঠাও। স্বামী ও স্ত্রী যদি সংশোধন চায় তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে আপোষ করিয়ে দিবেন;-নিসা ৩৫। স্বামী-স্ত্রী সংশোধন চাইলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াদা রয়েছে আপোষ করিয়ে দেয়ার।
সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর অনোন্যপায় হয়ে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিবে। একসঙ্গে তিন তালাক নয়। একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া বা একই পবিত্রতার মেয়াদে তিনবার তালাক দেয়া স্বামীর পক্ষে হারাম। হায়েজ থেকে মুক্ত অবস্থায় স্বামী স্ত্রীকে প্রথম তালাক দিবে। এ অবস্থায় স্ত্রীকে ঘরে রাখবে এবং স্ত্রীও ঘর থেকে চলে যাবে না। যদি তাদের মধ্যে মনোমালিণ্য দূর হয়ে একত্রে চলতে চায় সে সুযোগ রয়েছে। যদি সংশোধন না হয় তাহলে হয়েজ থেকে দ্বিতীয় বার পবিত্র হওয়ার পর আবার তালাক দিবে এবং হয়েজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রীকে স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে নিতে পারবে। এতেও যদি সংশোধন না হয় তাহলে একই নিয়মে তৃতীয়বার তালাক দিবে। এতে মিলমিশ ঘটলে স্বামী পুনরায় স্ত্রীকে মহরানা দিয়ে নতুন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এটি শেষ সুযোগ। সময় শেষে স্ত্রীর হায়েজ শুরু হলে স্বামীর জন্য স্ত্রী হারাম হয়ে যায় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘তালাক দু’বার। এরপর হয় ন্যায়সংগতভাবে বহাল রাখতে হবে, নচেত সদাচারের সাথে বিদায় দিতে হবে’-বাকারা ২২৯। এ ক্ষেত্রে ঐ স্ত্রীর পক্ষে অন্যত্র বিবাহে কোনো বাধা নেই। ইসলামে হিলা বিবাহের কোনো সুযোগ নেই (সুস্পষ্ট হারাম)। স্বামী মারা গেলে বা কোনো কারণে স্বামী যদি তালাক দেয় তবে অন্যান্য পুরুষের মত পূর্ববর্তী স্বামীর সাথেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কুরআন ও হাদিসে তালাক বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
খুলা তালাক।
শব্দটি খালায়া থেকে গৃহিত, দেহ থেকে পোশাক খুলে ফেলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। কুরআনে নারী-পুরুষকে পরস্পরের পোশাক (‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক’-বাকারা ১৮৭) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্ত্রীর পক্ষ থেকে বৈবাহিক বন্ধন ছিন্ন করাকে খুলা বলা হয়। এর আর এক নাম মুক্তিপণ। কারণ স্ত্রী তার স্বামীকে অর্থ বা সামগ্রী প্রদান করে নিজেকে মুক্ত করে। অধিকাংশ ফকিহর মতে স্বামী ইতোপূর্বে স্ত্রীকে যা কিছু দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি আদায় করা তার জন্য বৈধ। এর ভিত্তি হলো কুরআনের বাণী, ‘স্ত্রী মুক্তিপণ হিসেবে যা কিছুই দেয়, তার ভিত্তিতে খুলা করা দম্পতির জন্য বৈধ’-বাকারা ২২৯। হাদিসে দেখা যায়, কোনো মহিলা রসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, তোমাকে মহরানা হিসেবে যে বাগানটা (আবুয যুবাইর রা.-এর ঘটনা) দেয়া হয়েছিল সেটি কি তুমি ফেরৎ দিবে? রাজি হয়ে বলেন, আমি আরো বেশি দেবো। রসূল (সা) বলেন, বেশি দিতে হবে না। এ-সব নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন, দু’পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে স্থির হবে। অনেকের মতে স্ত্রীকে মহরানা হিসেবে যা দেয়া হয়েছে তা ফেরৎ দেয়া এবং এটিই বিশুদ্ধ মত বলে মনে হয়।
খুলা শুধু তখনই জায়েজ যখন কোনো সংগত কারণ থাকে। স্বামীর দৈহিক খুঁত, চারিত্রিক দোষ, স্ত্রীর হক আদায় না করা, স্বামীর সাথে সদাচারের সাথে বসবাস না করার আশঙ্কা যদি থাকে তাহলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে তালাক চাইতে পারে। আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘কৃত্রিমভাবে খুলা গ্রহণকারী মহিলারা মুনাফিক’- আহমদ ও নাসায়ী। আলেমগণ বিনা কারণে খুলা গ্রহণ করাকে মাকরূহ বলেছেন। স্ত্রী যদি স্বামীকে আদৌ মেনে নিতে না পারে বা বনিবনা না হয় স্ত্রীর পক্ষে খুলা চাওয়া একটি সুযোগ (যদিও নিন্দনীয়)। আল্লাহ বলেন, ‘যদি কোনো মহিলা তার স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ বা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তবে তারা উভয়ে নিজেদের মধ্যে একটা আপোস করে নিলে তাতে কোনো পাপ নেই। বরঞ্চ আপোসই ভালো’-নিসা ১২৮। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে খুলা হওয়া উচিত। স্বামী সম্মত না হলে আদালত তাকে বাধ্য করতে পারে। খুলার ক্ষেত্রে স্ত্রীর ইদ্দত এক হায়েজ।
সবধরনের সংকীর্ণতা ও শয়তানের প্ররোচনা উপেক্ষা করে দাম্পত্য জীবনকে মধুর ও টেকসই করার সুযোগ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দান করুন। আমিন। ০৩.১২.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment