Skip to main content

আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম যেমন ছিলেন : সাইয়্যেদুনা শোয়াইব (আ)

আদম (আ)-কে দুনিয়ায় আসার কথা বলা হলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে আশ্বস্ত করে বলা হয়, আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তার অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আল্লাহপাক যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রসূল প্রেরণ করেন। আদম (আ) প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী এবং সর্বশেষ নবী ও রসূল হলেন মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহপাক প্রতিটি জনপদে রসূল পাঠিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘প্রতিটি জাতির জন্য পথ-প্রদর্শনকারী রয়েছে’- সূরা আর রাদ ১৩। তিনি আরো বলেন, ‘আমি রসূল প্রেরণ না করে কাউকে শাস্তি দেই না’- বনি ইসরাইল ১৬৫। 'আমরা আপনার আগে এমন অনেক রসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমন অনেক রসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি'- সূরা নিসা ১৬৪। সঠিক সংখ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। জনশ্রুতি রয়েছি, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। এর মধ্যে ২৫ জনের নাম কুরআন মজিদে পাওয়া যায়। সূরা আন’আমের ৮৩-৮৬ আয়াতে ১৮ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। ‘ইবরাহীমকে তাঁর জাতির মোকাবিলায় আমি এ যুক্তি-প্রমাণ প্রদান করেছিলাম। আমি যাকে চাই উন্নত মর্যাদা দান করি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তোমার রব প্রজ্ঞাময় ও জ্ঞানী। তারপর আমি ইবরাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মত সন্তান দিয়েছি এবং সবাইকে সত্য পথ দেখিয়েছি, (সে সত্য পথ যা) ইতোপূর্বে নূহকে দেখিয়েছিলাম। আর তাঁরই বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সোলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মুসা ও হারুনকে (হেদায়াত দান করেছি)। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে তাদের সৎ কাজের বদলা দিয়ে থাকি। (তাঁরই সন্তানদের থেকে) যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকে (সত্য পথের পথিক বানিয়েছি)। তাদের প্রত্যেকে ছিল সৎ। (তাঁরই বংশ থেকে) ইসমাঈল, আল ইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে (পথ দেখিয়েছি)। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেককে আমি সমস্ত দুনিয়াবাসীর ওপর মর্যাদাসম্পন্ন করেছি’ ৮৩-৮৬। নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইব্রাহিম ও আলে ইমরানকে নির্বাচিত করেছেন, যারা একে অপরের বংশধর ছিল-আলে ইমরান ৩৩-৩৪। আলে ইব্রাহিম বলতে ইসমাইল ও ইসহাক এবং আলে ইমরান বলতে মুসা (আ) ও তাঁর বংশধর। ২৬ জনের নাম নিচে প্রদত্ত হলো। তাঁদের ধারাবহিকতা কুরআন-হাদিস নির্ভর না হয়ে অনেকটা ইতিহাস-আশ্রিত। ১. আদম (আ)। প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। মানবজাতির শুরু তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আ) থেকে। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ২৫ জায়গায় আলোচনা আছে। তাঁর পেশা ছিল কৃষি। ২. শিস (আ)। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ) বলেন, শিস (আ) আদম (আ)-এর পুত্র এবং তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁরও পেশ ছিল কৃষি। তাঁর নাম কুরআনে উল্লেখ পাওয়া যায় না। ৩. ইদ্রিস (আ)। সূরা মারিয়াম ৫৬-৫৭ ও সূরা আম্বিয়া ৮৫ আয়াতে ইদ্রিস (আ) সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা (দর্জি)। ৪. নূহ (আ)। তাঁর আয়ুস্কাল ছিল ৯৫০ বছর। কুরআনে ৪০ বার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং মাত্র ৮০ জন নারী-পুরুষ দাওয়াত কবুল করেন। ‘আমি নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই এবং সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর। শেষ পর্যন্ত তুফান তাদেরকে ঘিরে ফেলে এমন অবস্থায় যখন তারা জালেম ছিল’- আনকাবুত ১৪। তিনি ছিলেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। আল্লাহর বাণী, ‘তুমি আমার তত্তাবধানে ও আমার ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো’-সূরা হুদ ৩৭। তিনি ৩০০ হাত দীর্ঘ, ৫০ হাত প্রস্থ, ৩০ হাত উচ্চতাসম্পন্ন নৌকা তৈরী করেন। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ৫. হূদ (আ)। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আদ জাতির কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয় হূদ (আ)-কে। কুরআনে সাতটি আয়াতে এ নবীর আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ৬. সালেহ (আ)। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সামুদ জাতির কাছে নবী হিসেবে প্রেরিত হন হযরত সালেহ (আ)। ৯ জায়গায় এই নবীর আলোচনা হয়েছে। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ৭. ইবরাহীম (আ)। সামুদ সম্প্রদায়ের পর সাবিয়া সম্প্রদায়ের কাছে নবী হিসেবে প্রেরিত হন হযরত ইব্রাহিম (আ)। এই নবীর নাম কুরআনে ৬৯ বার উল্লেখ হয়েছে। তারা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র পূজা করতো। সেই সময়ের শাসক নমরুদ চন্দ্র দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে খোদা দাবী করতো। ইবরাহীম (আ) মূর্তি ভেঙ্গে নমরুদের রোষানলে পড়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন এবং জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করতে চাইলে আল্লাহপাক তাঁকে হেফাজত করেন। ইবরাহীম (আ) নানাভাবে পরীক্ষার মুখোমুখি হন। কুরআন মজিদে তাঁর ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানাভাবে বর্ণনা এসেছে। হজ্জ ও কুরবানির মাধ্যমে তাঁর ও তাঁর পরিবারের স্মরণ কিয়ামত পর্যন্ত জারি রয়েছে। আল্লাহপাক তাঁকে মুসলিম উম্মাহর পিতা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ব্যবসা ও পশু পালন ছিল তাঁর পেশা। ৮. লুত (আ)। ইবরাহিম (আ)-এর পরেই তাঁর ভাইপো লুত (আ) নবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কুরআনে ২৭ বার তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর সময়ে তাঁর জাতি সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ায় সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাঁর স্ত্রী স্বামীকে নবী হিসেবে না মেনে বিরোধীদের কাতারে থাকায় ধ্বংসপ্রাপ্তদের দলে তাঁর স্ত্রীও ছিল। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ৯. ইসমাঈল (আ)। ইবরাহীম (আ) ও হাজেরা (আ)-এর ঘরে জন্ম হয় হযরত ইসমাঈল (আ)। কুরআনে মোট ১২টি আয়াতে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। শিশুকালে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ)-কে কুরবানি পেশ করার কথা বললে তিনি তাঁর কলিজার টুকরো ইসমাঈল (আ)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হন। আল্লাহপাক এক পশু যবেহর মধ্য দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে দেন। নবী মুহাম্মদ (সা) ছিলেন তাঁরই বংশধর। পশু শিকার করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১০. ইসহাক (আ)। ইবরাহীম (আ) ও সারাহ (আ)-এর ঘরে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আ)। ১৭ বার আলোচিত হয়েছে তাঁর নাম। তাঁর বংশধারা থেকে অনেক নবীর আগমন ঘটে। ১১. ইয়াকুব (আ)। তাঁর আর এক নাম ইসরাইল। ১৬টি আয়াতে তাঁর নাম আলোচিত হয়েছে। নিজে নবী হওয়ার সাথে তাঁর অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আ) ছিলেন আল্লাহর নবী। কৃষিকাজ, ব্যবসা ও পশু পালন ছিল তাঁর পেশা। ১২. ইউসুফ (আ)। কুরআনে ২৭ আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। পিতা ইয়াকুব, দাদা ইসহাক ও পরদাদা ইব্রাহিম (আ)। তাঁর সম্পর্কে একটি সূরা রয়েছে এবং সেখানে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহপাক তাঁকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আসনে আসীন করেছিলেন। ১৩. আইয়ুব (আ)। কুরআনে ৪ জায়গায় তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আইয়ুব (আ)-কে আল্লাহপাক রোগ-ব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং পরম ধৈর্য অবলম্বনের বিনিময়ে আল্লাহপাক তাঁকে সুস্থতাসহ সকল নেয়ামত আবার ফিরিয়ে দেন। তাঁর পেশা ছিল গবাদি পশু পালন। ১৪. ইউনুস (আ)। মোট ২টি আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। মাছের পেটে গিয়ে আল্লাহপাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার বিনিময়ে তিনি মুক্তি পান। তাঁর পেশা ছিল চাষাবাদ। ১৫. শোয়াইব (আ)। তাঁর সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। দশটি সূরায় ৫৩টি আয়াতে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আল আরাফ ৮৫-৯৩, হুদ ৮৪-৯৫, আল হেজর ৭৮-৭৯, আশ শোয়ারা ১৭৬-১৮৯, আল আনকাবুত ৩৬-৩৭। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি খাত্বীবুল আম্বিয়া (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে খ্যাত ছিলেন। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ১৬. মুসা (আ)। কুরআনে সবচেয়ে বেশিবার তাঁর নাম আসছে। মোট ১৩৭ বার। তাঁর সময়কালের শাসক ফিরাউন ছিল একজন অত্যাচারী, তার অত্যাচারের বর্ণনা কুরআনে বিস্তারিত রয়েছে এবং তাকে নীলনদে ডুবিয়ে মারা হয়। তিনি পশু চরাতেন এবং মাদায়েনে শ্বশুরালয়ে (হযরত শোয়াঈব আ.) ৮ বছর পশু চরিয়েছেন। তাঁর অনুসারীরা বর্তমানে ইহুদী নামে পরিচিত। গজবপ্রাপ্ত জাতি। ১৭. হারুন (আ)। মুসা (আ)-এর সহদোর ভাই। ২০টি আয়াতে তাঁর প্রসঙ্গে এসেছে। তাঁরও পেশা ছিল পশু পালন। ১৮. ইলিয়াস (আ)। মোট ৩ বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। সূরা আন’আম ৮৫ ও সূরা ছাফফাত ১২৩-১৩২ ইলিয়াস (আ)-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনে তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম চলে। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। ১৯. আল ইয়াসা (আ)। অন্যান্য নবীদের সাথে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়, মোট ২বার। সূরা আনয়াম ৮৬ ও ছোয়াদ ৪৮ নং আয়াতে। তুমি বর্ণনা করো ইসমাঈল, আল ইয়াসা ও যুল-কিফলের কথা। তারা সকলেই ছিল শ্রেষ্ঠগণের অন্তর্ভুক্ত-ছোয়াদ ৪৮। তিনি ইয়াকুব (আ)-এর বংশধর ও ইলিয়াস (আ)-এর চাচাতো ভাই। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। ২০. জুলকিফল (আ)। সূরা আম্বিয়া ৮৫-৮৬ ও ছোয়াদ ৪৮ নং আয়াতে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। তুমি বর্ণনা করো ইসমাঈল, আল ইয়াসা ও যুল-কিফলের কথা। তারা সকলেই ছিল শ্রেষ্ঠগণের অন্তর্ভুক্ত- ছোয়াদ ৪৮। তিনি পুরো পৃথিবীর বাদশাহ ছিলেন। পশু পালন ছিল তাঁর পেশা। ২১. দাউদ (আ)। ১৬টি আয়াতে উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। যবুর কিতাব অবতীর্ণ। মনোমুগ্ধকর সুরের অধিকারী ছিলেন। তিনি একদিন রোযা রাখতেন ও একদিন রাখতেন না। তিনি ছিলেন রাজা ও নবী। লৌহা দ্বারা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরী করতেন। ২২. সোলাইমান (আ)। দাউদ (আ)-এর ছেলে। মোট ১৭ বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শাসক। সমগ্র সৃষ্টির ভাষা জানতেন এবং তাদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল। ২৩. জাকারিয়া (আ)। মোট ৭বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। মরিয়ম (আ)-এর খালু এবং তিনি তাঁর লালনপালনকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। ২৪. ইয়াহইয়া (আ)। জাকারিয়া (আ)-এর ছেলে ইয়াহইয়া ছিলেন ঈসা (আ)-এর আপন খালাতো ভাই। ৫টি আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। তিনি জনহীন ও জঙ্গলে কাটিয়েছেন এবং বৃক্ষের ফল ও লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন। ২৫. ঈসা (আ)। কুরআন মজিদে মোট ২৫ বার আলোচনা হয়েছে। পিতা ছাড়া মরিয়মের গর্ভে তাঁর জন্ম। তাঁর অনুসারীরা খ্রীস্টান হিসেবে পরিচিত এবং সংখ্যায় সর্বোচ্চ পরিমাণ। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট পেশা ছিল না। ফিলিস্তিনে জন্ম এবং ফলমূল খেয়ে বড় হয়েছেন। তাঁর শত্রুরা তাঁকে ফাঁসি দিতে উদ্যত হলে আল্লাহপাক তাঁকে উঠিয়ে নেন। নবীদের বেশির ভাগই বনি ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়। ২৬. মুহাম্মদ (সা)। সর্বশেষ নবী ও রসূল। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে নবী প্রেরণের সিলসিলা শেষ হয়ে গেছে। সাইয়্যেদুনা শোয়াইব (আ) শোয়াইব নামের অর্থ আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহপ্রাপ্ত। তিনি ছিলেন ইবরাহীম (আ)-এর বংশশোদ্ভূত নবী। শোয়াইব (আ)-এর পিতা ফাহমিল, ফাহমিলের পিতা এছজার এবং তাঁর পিতা মাদইয়ান। ইবরাহীম (আ) এর পুত্র মাদইয়ানের নামে জনপদটি পরিচিত হয়েছে। হযরত শোয়াইব (আ) এই জনপদে প্রেরিত হয়েছিলেন। ইনি হযরত মুসা (আ)-এর শ্বশুর ছিলেন। কওমে লুত-এর ধ্বংসের অনতিকাল পরে তিনি কওমে মাদইয়ানের প্রতি প্রেরিত হন। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি খাত্বীবুল আম্বিয়া (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে খ্যাত ছিলেন। মাদইয়ানের ঘটনাকে কোথাও কোথাও ‘আছহাবুল আইকাহ’ বলা হয়েছে যার অর্থ জঙ্গলের বাসিন্দাগণ। মাদইয়ান ছিলেন হাজেরা ও সারাহর মৃত্যুর পর হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আরব বংশোদ্ভূত কেন’আনী স্ত্রী ইয়াক্কত্বিন-এর ৬টি পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র। উল্লেখ্য হযরত শোয়াইব (আ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫৩টি আয়াত রয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আল আরাফ ৮৫-৯৩, হুদ ৮৪-৯৫, আল হেজর ৭৮-৭৯, আশ শোয়ারা ১৭৬-১৮৯, আল আনকাবুত ৩৬-৩৭। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৬টি জাতির মধ্যে পঞ্চম হলো আহলে মাদইয়ান। মাদইয়ান লুত সাগরের নিকটবর্তী সিরিয়া ও হিজাযের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম। যা অদ্যাবধি পূর্ব জর্ডানের সামুদ্রিক বন্দর মো’আন এর অদূরে বিদ্যমান রয়েছে। কুফুরি ছাড়াও এই জনপদের লোকেরা ওযন ও মাপে কম দিত, রাহাজানি ও লুটপাট করতো। অন্যায় পথে জনগণের মাল-সম্পদ ভক্ষণ করতো। হযরত শোয়াইব (আ)-এর দাওয়াত ‘আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের বললো, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ করো। মানুষকে তাদের মালামাল কম দিয়ো না। ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধনের পর তোমরা সেখানে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’- সূরা আরাফ ৮৫। ‘তোমরা পথেঘাটে এ কারণে বসে থেকো না যে, ঈমানদারদের হুমকি দেবে, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করবে ও তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ করো যখন তোমরা সংখ্যায় অল্প ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে আধিক্য দান করেছেন এবং লক্ষ্য করো কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে অনর্থকারীদের’- সূরা আরাফ ৮৬। ‘আর যদি তোমাদের একদল ঐ বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যা নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি এবং আরেক দল বিশ্বাস স্থাপন না করে, তোমরা অপেক্ষা করো যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। কেননা তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী’-আরাফ ৮৭। কওমে শোয়াইব (আ)-এর ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা এবং দাওয়াতের সারমর্ম : প্রথমত : আল্লাহর হক তারা নষ্ট করেছিল। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে তারা কুফুরি, শিরক ও সৃষ্টিপূজায় লিপ্ত ছিল। দ্বিতীয়ত : মাপ ও ওযনে কম দিয়ে বান্দার হক নষ্ট করেছিল। মানুষের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। তৃতীয়ত : পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল। মারামারি, হানাহানি, লুটতরাজ ও নানা অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল। চতুর্থত : মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করেছিল। পথিমধ্যে বাণিজ্য কাফেলাকে কর দিতে বাধ্য করতো ও ঈমানদারদের নানাভাবে উত্যক্ত করতো। পঞ্চমত : তারা অকৃতজ্ঞ হয়েছিল। তারা সংখ্যায় কম ছিল ও দরিদ্র ছিল। আল্লাহ সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সচ্ছলতা দান করলেও তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো না। ষষ্ঠত : সন্দেহপ্রবণ হয়েছিল। ঈমানদার ও অস্বীকারকারী উভয়ের আর্থিক অবস্থার তেমন পার্থক্য না থাকায় তারা সন্দেহ করতো ঈমানদাররা কিভাবে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়? দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া : সকল নবীদের সাথে ইতোপূর্বে যেমন আচরণ করা হয়েছিল শোয়াইব (আ)-এর সাথে তার ব্যতিক্রম নয়। তোমার সালাত কি তোমাকে এ কথা শেখায় যে, আমরা আমাদের ঐসব উপাস্যের পূজা ছেড়ে দেই, আমাদের পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে যে সবের পূজা করে আসছে? আর আমাদের ধন-সম্পদে ইচ্ছামত আমরা যা কিছু করে থাকি, তা পরিত্যাগ করি? তুমি তো একজন সহনশীল ও সৎ ব্যক্তি’- হূদ ৮৭। দ্বিতীয়ত : তারা ইবাদত ও মু’আমালাতকে পরস্পর প্রভাবমুক্ত ভেবেছিল। ‘তার সম্প্রদায়ের কিছু নেতৃস্থানীয় লোক-যারা অহংকার করছিল-বললো, হে শোয়াইব! আমরা অবশ্যই তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব, অথবা তোমাদের অবশ্যই আমাদের জাতিতে ফিরে আসতে হবে; সে বললো, যদি আমরা (তোমাদের দ্বীনকে) পছন্দ নাও করি তাহলেও (কি তা মানতে হবে)- আরাফ ৮৮। ‘তার জাতির নেতৃস্থানীয় লোক-যারা কুফুরি করেছে, তারা (অন্য মানুষদের) বললো, তোমরা যদি শোয়াইবের অনুসরণ করো তাহলে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’- সূরা আরাফ ৯০। আহলে মাদইয়ানের ওপরে আপতিত গযবের বিবরণ ‘হে আমার জাতি! আমার বিরুদ্ধে জেদ যেন তোমাদের জন্য এমন এক আযাবজনিত বিষয়ের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় যে, তোমাদের ওপরও সে ধরনের কিছু আপতিত হবে, যেমনটি নূহ কিংবা হূদ বা সালেহর জাতির ওপর আপতিত হয়েছিল; আর লুতের সম্প্রদায়ের (আযাবের স্থানটি তো) তোমাদের থেকে খুব বেশি দূরেও নয়’- সূরা হুদ ৮৯। ‘হে আমাদের রব! আমাদের এবং আমাদের জাতির মাঝে তুমি সঠিক ফয়সালা করে দাও।, কারণ তুমিই হচ্ছো সর্বোত্তম ফয়সালাকারী’-সূরা আ’রাফ ৮৯। ‘এরপর শোয়াইব তাদের কাছ থেকে সরে গেল, যাবার সময় বললো, হে আমার জাতি, আমি তোমাদের কাছে আমার মালিকের বাণীসমূহ পৌঁছে দিয়েছিলাম, আমি আন্তরিকভাবেই তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছিলাম। আমি কিভাবে এমন সব মানুষের জন্য আফসোস করবো যারা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করে’- সূরা আরাফ ৯৩। ‘অতঃপর একটা প্রচন্ড ভূকম্পন এসে তাদের (এমনভাবে) আঘাত করলো, দেখতে দেখতে সবাই তাদের নিজ নিজ ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল’- সূরা আরাফ ৯১। ‘যারা শোয়াইবকে অমান্য করলো তারা যেমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেল দেখে মনে হয়েছে সেখানে কোনোদিন কেউ বসবাসই করেনি, বস্তুত যারা শোয়াইবকে অস্বীকার করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’- সূরা আরাফ ৯২। ‘অতপর তারা তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করলো, পরিণামে মেঘাচ্ছন্ন দিনের এক ভীষণ আযাব তাদের পাকড়াও করলো, এ ছিল সত্যিই এক কঠিন দিনের আযাব’- সূরা আশ শোয়ারা ১৮৯ শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ : ‘আমি কোনো জনপদে নবী পাঠিয়েছি-অথচ সেই জনপদের মানুষদের অভাব ও কষ্ট দিয়ে পাকড়াও (পরীক্ষা) করিনি, এমনটি কখনো হয়নি, আশা করা গিয়েছিল, তারা (আল্লাহতায়ালার কাছে) বিনয়াবনত হবে’- সূরা আরাফ ৯৪। ১. কওমের নেতারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাগ করে নিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে প্রস্তুত নয় এবং বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজমান। আল্লাহর সাথে শিরক ও নৈতিক অধপতনের কারণেই তারা আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছিল। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ২. আল্লাহকে স্বীকার করলেও তারা শিরক করতো। এমন চিত্র বর্তমান সমাজেও বিরাজমান। মানুষ আইন পালনে ও দুআয় আল্লাহর সাথে শিরক করছে। ৩. বাপ-দাদার আমলের রসমপূজা। বর্তমান সমাজও পশ্চাতমুখিতা থেকে বের হতে পারছে না। শিরক-বিদয়াত ও নানা ধরনের কুসংস্কারে জড়িয়ে আছে। নবীদের আহবান ছিল সবকিছু থেকে ফিরে আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেয়ার। ৪. দুনিয়া পূজা ও প্রবৃত্তি পূজা। অতীতের জাতিসমূহের মতো বর্তমানের মানুষও একই রোগে আক্রান্ত। সম্পদেও নেশায় হালাল-হারামের বাছ-বিচার করে না। ৫. সংস্কারক স্পষ্ট দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত। স্পষ্ট দলিল হিসেবে কুরআন আমাদের মাঝে বর্তমান। ৬. অবশ্যই ধৈর্যশীল ও সমাজদরদী হতে হবে। নবী-রসূলগণ ছিলেন ধৈর্যের প্রতীক। দ্বায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে যারা ভূমিকা রাখতে চান তাদেরকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। ৭. দুনিয়াবী প্রতিদানের আশাবাদী হওয়া চলবে না। নবী-রসূলগণ প্রতিদান চাইতেন আল্লাহর কাছে। দুনিয়ার লাভ-লোকসান উপেক্ষা করে আখিরাতমুখি দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৮. সকল ব্যাপারে আল্লাহর তাওফিক কামনা। সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা ও বিপদ-মুসিবত সব অবস্থায় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। ৯. শিরক-বিদয়াত ও যুলুম অধ্যুষিত তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমে সংস্কার কাজ ফাসাদ নয়। নবী-রসূলদের দাওয়াত ও পরিশুদ্ধির কাজকে সকল সময় কুফুরি শক্তি সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি বলে তাদের উপর চড়াও হয়। অথচ তারাই ফাসাদ সৃষ্টি করে। তাই কুফুরি শক্তির প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। ১০. চূড়ান্ত অবস্থায় আল্লাহরই কাছে ফায়সালা চাইতে হবে। বিপদ-মুসিবত সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। দ্বায়ী ইলাল্লাহ যে কাজটি করেন তা একান্ত আল্লাহর। তাই সব অবস্থায় আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতে হবে। ১৩.১২.২০২০ (অনলাইনে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রণীত)।

Comments