আল্লাহর বাণী :
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত এবং মুসলমান না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’- সূরা আলে ইমরান ১০২।
তাকওয়া শব্দের অর্থ বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা। অর্থাৎ আল্লাহর নাফরমানি বা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এর আর একটি অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ই মানুষকে গুনাহ বা তাঁর নাফরমানি থেকে দূরে রাখে। সব মানুষই আল্লাহকে কম-বেশি ভয় করে। এখানে বলা হয়েছে, ভয় করার মতো ভয় বা যেভাবে ভয় করা উচিত। অন্যত্র বলা হয়েছে, আল্লাহকে ভয় করো যতখানি সাধ্যে কূলায়। অর্থাৎ সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহকে ভয় করো। হ্যাঁ, সাধ্যের বাইরে আল্লাহর হুকুম মানা বা তাঁর নাফরমানি থেকে দূরে থাকতে না পারলে গুনাহ নেই।
আল্লাহর মর্যাদা, তাঁর বড়ত্ব, তাঁর ক্ষমতা-এখতিয়ার আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেভাবেই তাঁকে ভয় করতে হবে ও মানতে হবে। আমাদের সমাজে কর্মচারী তার বসকে ভয় করে, সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভয় করে এবং স্ত্রী তার স্বামীকে ভয় করে। এই ভয় করার পেছনে রয়েছে শ্রদ্ধাবোধ ও ক্ষমতা। কর্মচারী তার বসকে ভয় করে এ কারণে যে তাকে অমান্য করলে চাকুরি হারানোর ভয় আছে; সন্তান ভয় করে তার পিতা-মাতাকে, কারণ অমান্য করলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে বা স্ত্রী তার স্বামীকে ভয় করে এ কারণেই যে তার ভরণ-পোষণ বন্ধ করে দিতে পারে বা চরম পর্যায়ে পৌঁছলে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার জীবনে এই ভয় করার পেছনে কাজ করছে চাকুরি হারানোর, ঘর থেকে বের করে দেয়ার বা সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার।
আল্লাহর অবস্থানটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের সুস্থতা, বেঁচে থাকা, উপায়-উপার্জন, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি এবং পরিবার নিয়ে ভালো থাকা সবই নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর। সর্বোপরি মৃত্যুর পর আখিরাতের অনন্ত জীবনের জন্য জান্নাত বা জাহান্নামও নির্ভর করছে একান্তভাবে আল্লাহর ওপর। দুনিয়ার জীবনের কল্যাণের পাশাপাশি আখিরাতে চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ যে আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভর করে সেই আল্লাহকে কতখানি ভয় করা উচিত তা আমাদের উপলব্ধিতে আনা উচিত।
আল্লাহর ভয় মানুষের মধ্যে তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হয়। একজন মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু ব্যক্তি কখনই মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতারণা, শঠতা, ওযনে কম, ভেজাল প্রদান, ঘুষের আদান-প্রদান, মানুষকে কষ্ট দেয়া এককথায় আল্লাহর নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে এমন কোনো কাজের সাথে জড়িত হতে পারে না। এ-সবই তাকওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক। রসূলুল্লাহ (সা) মিথ্যাকে সবচেয়ে ঘৃণা করতেন। তিনি বলেন, মিথ্যা সকল পাপের মা। আমার উম্মতেরা সব পারে, মিথ্যা বলতে পারে না ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আজ মিথ্যা আমাদের সমাজে জেঁকে বসেছে। মিথ্যার মধ্য দিয়ে সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। রসূল (সা) বলেছেন, একজন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে সেটিই বলে বেড়ায়।
একটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার বৈধতা রয়েছে তা হলো, দু’জন বিবাদমান ব্যক্তি বা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। পরস্পর সমঝোতা বা বিবাদ মিমাংসা করে দেয়ার গুরুত্ব এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ মেটাতে কেউ যদি পুরুষকে গিয়ে বলে ভাই, আপা তো আপনার অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছে ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে শুকিয়ে গেছে; আবার আপাকে গিয়ে বলে, ভাই-এর তো আড্ডাবাজি ও আনন্দ-স্ফুর্তি সব শেষ, কিছু সময় তার সাথে ছিলাম শুধুই তোমার কথা। ফিতরাতের ধর্মে এমন কথা বলার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই। আবার কেউ যদি কোনো নারীকে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য প্ররোচনা দেয় তাকে আল্লাহর রসূল (সা) মুসলমানের দল থেকে খরিজ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আবার কোনো নারী অহেতুক স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে রসূল (সা) বলেছেন, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। তাকওয়া অত্যন্ত ব্যাপক। পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়া ও তাতে উস্কানি দেয়া সবই তাকওয়ার পরিপন্থি।
তাকওয়ার সাথে মুসলমান হওয়া অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাকওয়ার দাবী ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। জীবনে কোনো এক সময় কালিমা তাইয়্যেবাহ্ উচ্চারণ করা বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে সারাজীবন মুসলমান থাকা ফিকাহর কিতাবে বা সরকারি দপ্তরে ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহর দরবারে মুসলমান থাকা অর্থই হলো ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা বা আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ হুশিয়ার করে দিয়েছেন, মুসলমান না হয়ে মরো না অর্থাৎ মুসলমান থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করো। আল্লাহর নাফরমানি (হুকুম অমান্য করা) অর্থই হলো ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া, আবার তাওবার মাধ্যমে ইসলামে ফিরে আসা। এটি এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। ১৫ বছরের চাকুরি জীবনে একদিন বসের হুকুম অমান্য করলেই তার পেছনের সমস্ত অবদান নিঃশেষ হয়ে যায়। আবার স্বামী-স্ত্রীর ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে একদিন স্বামীকে অমান্য করলেই দাম্পত্যজীবন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।
আল্লাহর কাছে ব্যক্তির বংশ, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা, সৌন্দর্য কোনো কিছুই গুরুত্ব বহন করে না। গুরুত্ব রয়েছে ব্যক্তির তাকওয়ায়। সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন যে তাকওয়ার অধিকারী অর্থাৎ নীতিবান। এই তাকওয়া কেবল পোশাক ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় ব্যক্তির সকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। নিজের ঘর থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই তার প্রতিফলন তাকওয়ার দাবী। মুত্তাকী ব্যক্তি থেকে তার স্বামী/স্ত্রী, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, প্রতিবেশি, সমাজের অন্যান্য মানুষ এমনকি ইতর প্রাণি ও বৃক্ষলতাও কল্যাণ লাভ করবে।
আল্লাহপাক আমাদেরকে যথার্থ মুত্তাকী হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং আমাদের মৃত্যু যেন হয় মুসলমান অবস্থায়। আমিন। ১১.১২.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment