হজরত উছমান বিন আফ্ফান জামে মসজিদ, মাধবপুর
তারিখ : ২৩.০৯.২০২২
নামাজ মুসলমান হওয়ার দলিল ও প্রমাণ
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে তিনি তাঁর অগণিত বান্দার মধ্য থেকে দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে হাজির হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। বলা যায়, আমরা আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দা। আলহামদু লিল্লাহ।
আমি আপনাদের মসজিদ সম্পর্কে অবহিত। ইতোপূর্বে এই মসজিদে এসেছি। আপনাদের মসজিদের বয়স কম হলো না। প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে আসলো। বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ইতিহাসভিত্তিক স্মরণিকায় এই মসজিদের উল্লেখ রয়েছে। মসজিদ প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তন্মধ্যে মরহুম আফজাল হোসেন (প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইমাম), মরহুম মজের উদ্দিন শেখ (প্রথম মুয়াজ্জিন), আমার স্যার মরহুম নুর মোহাম্মদকে (পরবর্তী সভাপতি ও ইমাম) গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ ও তাঁদের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তৎসঙ্গে শারীরিক সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি জনাব মো. আব্দুল করিম মোল্লা (প্রথম মুয়াজ্জিন) ও মো. আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার (প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি)। সেসময়ে তাঁরা স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে আল্লাহর ঘরের আবাদ করেছেন। জনাব আব্দুল করিম মোল্লার বৈঠকখানায় শুরু হয়ে পরবর্তীতে ছাপরা ঘরের সেই মসজিদে আজ টাইলস ও এসি হয়েছে। কাতার দাতা সংস্থা ২০০৪ সনে মসজিদকে বর্তমান রূপ দান করে। মসজিদের উন্নয়নে কাতার দাতা সংস্থাসহ সকলের কল্যাণ কামনা করি।
জুমার দিন আমাদের ইদের দিন। আজকের দিনের প্রধান কাজ জুমার সালাত আদায়। তাই আমাদের সবারই সেজন্য প্রস্তুতি থাকা দরকার। জুমার দিনে খুতবা শ্রবণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুতবা মনোযোগের সাথে শুনতে হয়। খুতবা শোনার জন্য আজানের সাথে সাথে মসজিদে উপস্থিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। মসজিদে সকাল সকাল আসার জন্য রসুলুল্লাহ সা. নানাভাবে তাগিদ দিয়েছেন। বলুন দেখি, আমাদের পক্ষে একটি উট কুরবানি করা কি আদৌ সম্ভব? অথচ রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মসজিদে প্রথম আগমনকারী ব্যক্তি একটি উট কুরবানির সওয়াব লাভ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে গরু, ছাগল কুরবানির সুসংবাদ দিয়েছেন। আবার প্রথম কাতারে আসন গ্রহণের ফজিলত প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষ যদি বুঝতো প্রথম কাতারে বসায় কতো সওয়াব তাহলে লটারি করার প্রয়োজন হতো। সামনের কাতার ফাঁকা রেখে পেছনে বসলে মানুষকে ডিঙিয়ে যেতে হয় যেটা আদবের খেলাপ এবং হাদিসে নিষেধ রয়েছে। ফেরেশতারা মুসল্লিদের আগমনের ভিত্তিতে সওয়াব লিখতে থাকেন। খতিব মহোদয় খুতবা দান শুরু করলে ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনা শুরু করুন। বিলম্বে আসলে আপনি জুমার নামাজের ফায়দা থেকে বঞ্চিত হবেন।
জুমার নামাজ যেমন আমাদের প্রতি ফরজ তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করাও ফরজ। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আজান শুনে কেউ মসজিদে না আসলে আমার ইচ্ছা হয় আমার স্থলে কেউ ইমামতি করুক আর আমি গিয়ে তাদের ঘরগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই। দেই না এ কারণে যে, সেখানে নারী ও শিশু রয়েছে। রহমাতুল্লিল আলামিন আগুন দিয়ে বাড়িঘর জ্বালাতে চান, তাহলে বুঝতে হবে মসজিদে না যাওয়া কতো ভয়াবহ গুনাহ। উম্মে মাকতুম রা. একজন অন্ধ সাহাবি। রসুলুল্লাহ সা. তাঁকেও একাকী নামাজ পড়ার অনুমতি দেননি। বলেছেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও? বলেছেন, হ্যাঁ। রসুলুল্লাহ সা. তখন বলেছেন, আজান শুনতে পেলে তোমাকে মসজিদে আসতে হবে। আলী রা. বলেছেন, মসজিদের যারা প্রতিবেশী তাদেরকে মসজিদে গিয়েই নামাজ আদায় করতে হবে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, মসজিদের প্রতিবেশী কারা? তিনি বলেছেন, যারা আজান শুনতে পায়। রসুলুল্লাহ সা. ঐ মুসল্লিদের সুসংবাদ শুনিয়েছেন যারা এশা ও ফজর জামায়াতের সাথে আদায় করে এবং বলেছেন তাদের সমগ্র রাত ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হয়। তিনি আরো বলেছেন, আমাদের ও মুনাফিকদের মাঝে পার্থক্য হলো এশা ও ফজরের সালাতে শরীক হওয়া। মুনাফিকরা ফজর ও এশার সালাতে শরীক হতে পারে না। এসব হাদিসের বর্ণনা থেকে আমরা সহজেই নামাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। রসুলুল্লাহ সা. স্পষ্ট বলেছেন, নামাজ হলো ইমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য। যে ইচ্ছাকৃত নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফরি করলো। তাই আমরা যে মুসলমান তার দলিল ও প্রমাণ হলো নামাজ। নামাজ বেহেশতের চাবি। নামাজ ছাড়া আখেরাতে নিজেকে মুসলমান দাবি করার কোনো প্রমাণ থাকবে না। কাফেরদের সাথেই অবস্থান হবে। নিজেকে মুসলমান প্রমাণ করার জন্য মুনাফিকদের মসজিদে হাজির হতে হতো। কুরআনে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা বড়ো শৈথিল্য সহকারে ও লোকদেখানো নামাজ পড়ে।
আপনাদের মসজিদে একটি ভালো দিক হলো, এখানে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি খুবই সন্তোষজনক। আপনারা শিশু-কিশোরদের পেছনে ঠেলে দেবেন না। ওরা যদি একটু ঠেলাঠেলি করে বা হাসাহাসি করে তাহলে নামাজের কোনো ক্ষতি হয় না। আপনারা তো জানেন, রসুলুল্লাহ সা. সেজদা গেলে তাঁর নাতিরা ঘোড়া বানিয়ে ঘাড়ে চড়তো। ফলে আপনারা বাচ্চাদের প্রতি সদয় হবেন এবং বাড়ি থেকে বাচ্চাদের সাথে করে আনবেন। আপনারা শুধু নিজেরা নামাজ পড়লে হবে না, আপনাদের বাড়িতে যারা রয়েছে তাদেরকে এবং আশেপাশের লোকজনকেও দাওয়াত দিতে হবে। সুরা আসরে আল্লাহপাক কসম খেয়ে বলেছেন চারটি গুণ না থাকলে মানুষ নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। সেই গুণগুলো হলো- ইমান ও নেক আমল এবং মানুষকে হকের দাওয়াত দান ও ধৈর্য ধারণের জন্য উৎসাহ যোগানো। মানুষকে সবসময় ভালোর দিকে ডাকতে হবে।
নামাজ আদায়ের পাশাপাশি আল্লাহপাক তাঁর পথে খরচের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহর পথে খরচ অত্যন্ত বিস্তৃত। নিজের পরিবারের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজন, গরীব-দুঃখী ও মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য ব্যয় সবই আল্লাহর পথে ব্যয়। সুরা বাকারার শুরুতেই মুত্তাকিদের পরিচয় প্রসঙ্গে সালাত আদায়ের সাথে সাথে বলেছেন, ‘আমরা যা রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে’। তাই আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে উদার হতে হবে। হাদিসে বলা হয়েছে, দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে, লোকদের নিকটে ও জান্নাতের নিকটে, পক্ষান্তরে কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে ও জাহান্নামের নিকটে। আমাদের মসজিদগুলো পরিচিালিত হয় আপনাদের দানে। একটু উদার হাতে দিতে না পারলে মসজিদের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সম্মানি প্রদান সম্ভব হয়ে উঠে না। গ্রাম এলাকায় মসজিদগুলোয় কালেকশন খুবই নগণ্য। ঢাকা শহরের একটি মসজিদ সম্পর্কে জানি, এক জুমায় তাদের কালেকশন এক লক্ষ সাতানব্বই হাজার পাঁচ টাকা।
আমাদের সমাজে আর নবি-রসুল আসবেন না। কিন্তু তাদের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকার হলেন আলেম সমাজ। তাঁদের প্রতি-ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ মূলত নবি-রসুলদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ। মসজিদে যারা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন তাদের আলাদা আয়-উপার্জনের সুযোগ প্রায়ই হয় না। তাদের যথোপযুক্ত সম্মানি দানের চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহর বাণী, ‘এটা প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- সুরা বাকারা ২৭৩। আলেমদের মাঝে-মধ্যে উপঢৌকন প্রদান করবেন।
আমি আমার শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে কিছু কথা বলতে চাই। এই বয়সে মসজিদে আসা তোমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার রহমত। লেখাপড়া ও খেলাধুলার মাঝে ব্যস্ত থাকলেও আজান শুনে তাৎক্ষণিক মসজিদে চলে আসবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে ওজু তোমাদেরকে পবিত্র করবে ও সজিব করবে এবং নামাজ তোমাদের জীবনে শৃঙ্খলা নিয়ে আসবে। আর একটি বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অনুরোধই করবো, তোমরা অপ্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার করবে না। মাদকের মতো এটাও একটি নেশা এবং এই নেশায় পড়ে অনেকে তাদের জীবনটাই ধ্বংস করে ফেলেছে। মোবাইল ছেড়ে বিকল্প শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন খেলাধুলা করবে।
সন্তানের জন্য জান্নাতে যাওয়ার জন্য সহজ মাধ্যম তাদের পিতামাতা। পিতামাতার সাথে সর্বদা বিনয়সূচক আচরণ করবে। আল্লাহপাক তাঁর ইবাদত করার পাশাপাশি পিতামাতার আনুগত্য করার কথা বলেছেন। পিতামাতা উভয়ে বা কোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে কখনই কোনো কাজে বা আচরণে ‘উহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করবে না। আর যাদের বাবা-মা মারা গেছেন তারা তাদের পিতামাতার জন্য সর্বদা দোয়া করবেন। দোয়া করার ভাষাটিও আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন (রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা)। পিতামাতার জন্য সন্তানের দোয়া কখনই ব্যর্থ হতে পারে না। আল্লাহপাক আমাদের সকলকেই দীনের ওপর অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন। (পরিমার্জিত)।
Comments
Post a Comment