শ্বশুরবাড়ি (নওদা ক্ষেমিরদিয়াড়, ভেড়ামারা) এসে মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে কিছু নসিহত করার কথা বলা হলে সালাম বিনিময়ের পর নিম্নরূপ কথা- বার্তা বললাম।
দুই কাতার মুসল্লি প্রায় ৭০/৮০ জন হবে এবং সবাই বসে পড়লেন। আলহামদু লিল্লাহ।
ফজরের নামাজের মুসুল্লি প্রসঙ্গে বললাম, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : যারা এশা ও ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করে তারা যেন সারাটি রাত ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করে। তিনি আবার বড়ো শক্ত কথাও বলেছেন : আমাদের ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য হলো এশা ও ফজরের সালাতে হাজির হওয়া। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া যে, আপনাদের গোটা রাত ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে এবং আপনারা নির্ভেজাল মুসলমান। ফরজ নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতের সাথেই আদায় করতে হবে। রসুলুল্লাহ সা বলেছেন : আজান শুনে যারা মসজিদে হাজির হবে না আমার ইচ্ছা জাগে আমার স্থলে কেউ ইমামতি করুক আর আমি তাদের বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই। দেইনি এ কারণে যে, সেখানে নারী ও শিশু থাকে। কতো বড়ো কঠিন কথা রহমাতুল্লিল আলামিন বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে চান। আলী রা. বলেছেন : মসজিদের প্রতিবেশীদের নামাজ মসজিদে গিয়েই পড়তে হবে। জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, মসজিদের প্রতিবেশী কারা? জবাব দিয়েছেন : যারা আজান শুনতে পায়। মাইকে আজানের ফলে এখন আর আজান না শোনার অজুহাত দাঁড় করানো যাবে না।
জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ে একটি বড়ো সুবিধা হলো মুক্তাদির নামাজ সহীহ-শুদ্ধ হয়। একাকী নামাজ আদায় করতে গেলে নামাজে প্রায়ই ভুল হয়, আমার তো হয়, আপনাদেরও হয়। জামায়াতে নামাজ আদায় করলে মুক্তাদির কোনো ভুল নেই। মুক্তাদির তখনই ভুল হবে যখন ইমামের অনুসরণের ক্ষেত্রে ভুল হবে। ইমামের আগে কোনো কাজ করলে মুক্তাদির আর নামাজ হবে না। তাহলে আপনারা ইমামের অনুসরণ করবেন, না ইমাম আপনাদের অনুসরণ করবে। সবাই সমস্বরে বলে উঠেন, আমরাই ইমামের অনুসরণ করবো।
আপনারা জানেন, নামাজ শুরু হয় তাকবিরে তাহরিমা 'আল্লাহু আকবার' বলে আর শেষ হয় সালাম ফিরে। এরপর সুন্নাহ সমর্থিত কিছু আমল আছে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : প্রতি ফরজ নামাজ শেষে যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসি পাঠ করে মৃত্যু ছাড়া জান্নাতে গমনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। এছাড়া তিন তসবিহ সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর, সুরা এখলাস, ফালাক ও নাস পড়তে পারেন। তিন তসবিহ সম্পর্কে হাদিসে রয়েছে উচ্চারণে খুব হালকা কিন্তু ওজনে খুব ভারী। আমরা যে সমষ্টিগত মোনাজাত করি রসুলুল্লাহ সা. তা জীবনে কখনই করেননি। হজ করার পর আমি মোনাজাত ছেড়ে দিয়েছি। কাবা শরিফে চার ইমামের অনুসারী চার ইমাম নামাজে ইমামতি করেন, ইমাম হাম্বলির রহ.-এর অনুসারী দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়ান। আমাদের মতো মোনাজাত কেহই করেন না। চার মাজহাব ও আহলে হাদিস কেহই মোনাজাত স্বীকার করেন না। আজ থেকে ২০ বছর আগে হাটহাজারি থেকে প্রকাশিত মাসিক মঈনুল ইসলামে পড়েছিলাম, নামাজ শেষে সামষ্টিক মোনাজাত বিদয়াত। আমার জানামতে হাটহাজারি মসজিদে সামষ্টিক মোনাজাত হয় না। শুনেছি, দেওবন্দেও হয় না। ইমাম সাহেবরাও জানেন, মোনাজাত বিদয়াত, কিন্তু মুসল্লিদের কারণে ছাড়তে পারেন না। ২/৩ দিন আগে এক মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষে ইমাম সাহেব মোনাজাত করেননি। কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থানে টিকে থাকতে পারলেন না।
বিদয়াতের গুনাহ বড়ো ভয়াবহ। বিদয়াতের ভালোমন্দ নেই। হাদিসের ভাষায় সকল বিদয়াতই ভ্রষ্ট এবং তা জাহান্নামে নিয়ে যাবে। বিদয়াতিরা হাশরের ময়দানে হাউজে কাউসারের পানি পান থেকে বঞ্চিত হবে। ইমাম সাহেবদের অনুরোধ করবো, সমাজ থেকে কোনো বিদয়াত বা কুসংস্কার রাতারাতি দূর করতে না গিয়ে ক্রমান্বয়ে মুসল্লিদের শিক্ষা দান করুন এবং একসময় বন্ধ হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ। প্রযুক্তির কারণে মুসল্লিরা নিজেরাই শিক্ষিত হয়ে উঠছে।
কোনো ইমাম বিদয়াত চালু করেননি। মাজহাবগত যে মতপার্থক্য সেটি রসুলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত। ফরজ ও ওয়াজিব নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। সবই হয়েছে সুন্নাত ও মুস্তাহাব নিয়ে। উম্মাহর মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করা কুফরি। নামাজের মাধ্যমে আমরা সেই শিক্ষাই পেতে পারি। নামাজে ইমাম সাহেবের ফরজ ছুটে গেলে নামাজ ভেঙে যায়, ওয়াজিব ছুটে গেলে সহু সেজদা দিয়ে সংশোধন করে নিতে হয়। আর সুন্নাত-মুস্তাহাব ছুটে গেলে নামাজ হয়ে যায়, হয়তো একটু সওয়াব কম হতে পারে। আমরা ঝগড়া করি যেটা নিয়ে সেটাও সুন্নাত। আমি হয়তো ভিন্নটা পালন করি। তাই ঝগড়া- ঝাটি ও হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করতে হবে। কোনো হিংসুকের জন্য জান্নাত নেই।
মোনাজাত শব্দের অর্থ চুপে চুপে কথা বলা বা গোপনে কথা বলা। চুপে চুপে কথা মানে দু'জনের মাঝে কথা। মোনাজাত হবে আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে কথা। আপনার সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করুন। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত এবং তিনি বান্দাকে দিতে চান। সুরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্য করে নবিকে বলেছেন, আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে জানতে চায়, আপনি বলে দিন, আমি তাদের অতি নিকটে, যে ডাকে আমি তার ডাক শুনি। কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেয়া ও আমার প্রতি ঈমান আনা তাদের একান্ত কর্তব্য। তাই আল্লাহর কাছে চান সর্বাবস্থায় ও সবসময়। তিনি দেবেন-এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে চান। একাকী চান, দু'হাত প্রসারিত করে চান, নামাজের মধ্যে চান ও সেজদায় গিয়ে চান। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : বান্দা যখন সেজদায় যায় তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে যায়। গোপনে সকল কথা আল্লাহরই কাছে বলুন, আল্লাহ আপনার মোনাজাত শুনবেন। তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনি পেশ করেই খালাস। এরপর দায়িত্ব আল্লাহর। মনে রাখবেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার সাথে কখনই মিথ্যা বলেন না। কোনো কারণে যদি দুনিয়ায় দিতে বিলম্ব হয় বা না দিয়ে থাকেন তবে জানবেন আল্লাহপাক আপনার জন্য জমা করে রাখছেন এবং আখেরাতে তা পেয়ে মহাখুশি হয়ে যাবেন। তাই চাইতে থাকুন।
আল্লাহপাক আলেমদের অনেক সম্মান দান করেছেন। নামাজই তার প্রমাণ। এখন আর নবি-রসুল আসবে না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আলেমরা হলো নবি-রসুলদের উত্তরাধিকার (ওয়ারিশ)। উত্তরাধিকার শব্দটির দ্বারা ওজন বোঝা উচিত। কোথাও আপনার যাওয়ার কথা, যেতে পারলেন না, লোক পাঠালেন, সেই আপনার প্রতিনিধি। তাকে অসম্মান করা তো আপনাকেই করা। রসুলুল্লাহ সা.-এর উত্তরাধিকার হিসেবে ইমাম ও আলেমদের যথোপযুক্ত সম্মান করবেন। কথাবার্তা ও আচরণে তাঁদের প্রতি সামান্যতম যেন অবহেলা ও অনাদর না হয়। মসজিদ আপনারা ঝকঝকে করেছেন এবং লক্ষ করলাম, গ্রামের মসজিদেও এসি। আল্লাহ সুরা তওবায় মসজিদ আবাদকারীদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, তারা নামাজ আদায় করে ও জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। দুর্ভাগ্যই আমাদের, মসজিদ আবাদকারী হিসেবে আমরা ঐ মানের লোক পাই না।
যারা সার্বক্ষণিক মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত তাদেরও সংসার আছে, আয় উপার্জনের অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারেন না। মসজিদে টাইলস, এসি দেয়ার লোক পাওয়া যায় কিন্তু দৈনন্দিন প্রয়োজন আপনাদেরই মেটাতে হবে। জুমার দিনের আদায়ে একটু উদার হস্তে দিন। আমি ঢাকার একটি মসজিদের কথা বলি, এক জুমায় সেখানে আদায় এক লক্ষ সাতানব্বই হাজার পাঁচ টাকা।
আলেমদের উদ্দেশ্যে আপনারা যে খরচ করবেন সে খবর আল্লাহ রাখেন। সুরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াতটি পড়ুন। তারা সর্বক্ষণ আল্লাহর দীনের কাজে নিয়োজিত, তাদের আত্মসম্মানবোধ অভাবের কথা বলতে দেয় না, চেহারা দেখেই তুমি বুঝতে পারো। তাদের অভাবটা আপনারাও বুঝুন। গোপনে দান করুন, দাওয়াত দিন, গাছের লাউ, আম, কাঁঠাল গিফট করুন। উপঢৌকন আদান-প্রদান নবির সুন্নাত। প্রভূত সওয়াব পাবেন এবং সম্পর্ক উন্নত হবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। আমিন। ২৭.০৯.২০২২
Comments
Post a Comment