মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা এক নয়
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ শুরুতে আল্লাহপাকের হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করেন। আজ বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ নানাভাবে লাঞ্ছনা-অপমান, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। কোথাও তারা সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নয়। আমাদের দেশেও ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠী ও উলামায়ে কেরাম নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। খতিব মহোদয় এর মূল কারণ হিসেবে উম্মাহর অনৈক্যকে দায়ী করেন। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার তাগিদ দিয়েছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’- সুরা আলে ইমরান ১০৩।
আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান। যারা অনৈক্য সৃষ্টি করে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন (সুরা আলে ইমরান ১০৫-১০৮)। আমাদের সমাজে অনেকের জিজ্ঞাসা, আমাদের আল্লাহ এক, রসুল এক, কুরআন এক, কিবলা এক- এতকিছু এক হওয়ার পরও মতপার্থক্য কেন? আবার অনেকে বলেন, আমরা কুরআন ও হাদিস সরাসরি মানলে আর মতপার্থক্য থাকে না। আসলে মতপার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতা এক নয়। মতপার্থক্য সাহাবায়ে কেরামদের মাঝেও ছিল। ইসলামের মৌলিক বিষয়ে অর্থাৎ ফরজ-ওয়াজিব পালনের ক্ষেত্রে কখনো কোনো মতপার্থক্য ছিল না এবং এখনো নেই। সুন্নাত-মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলেই ভিন্নতা ছিল। রসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত হিসেবে স্বীকৃত আমলের যে কোনো একটি অনুসরণের সুযোগ তাঁর উম্মতের রয়েছে। যেমন, আমিন আস্তে বা জোরে বলা, রফে ইয়াদাইন করা বা না করা, হাত নাভির উপরে বা নিচে বাঁধা (খতিব মহোদয় বলেন যে বুকের উপর হাত বাঁধার কোনো দলিল তিনি পাননি)- এসব মতপার্থক্য দ্বীনের কোনো ফরজ-ওয়াজিবের বিষয় নয়; ফলে সুন্নাত হিসেবে যে কোনো একটি অনুসরণ করার সুযোগ যে কোনো ব্যক্তির রয়েছে। একজন থেকে কেউ ভিন্ন করলে তাকে নিন্দা করার অধিকার কারোর নেই। অবশ্য রসুলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত নয় এমন কিছুকে দ্বীনের অংশ মনে করা সুস্পষ্ট গোমরাহি।
উম্মাহর অনৈক্য ও দলাদলিতে খতিব মহোদয় দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. কী চেয়েছেন আর আমরা কী করছি? আজ উম্মত বহুধা বিভক্ত, আর এই বিভক্তি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে। এসব মুস্তাহাব আমল কেউ ছেড়ে দিলে গুনাহ নেই কিন্তু সেসব আমল নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করা, গিবত করা, হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা, মসজিদ থেকে বের করে দেয়া এবং মসজিদ পৃথক করা কবিরা গুনাহ।কাদিয়ানিরা ঘোষিত অমুসলিম। তাদের উপাসনালয় (মসজিদ) পৃথক হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে শিয়া মসজিদ ও আহলে হাদিস মসজিদ কেন? ইসলাম কি তার অনুমোদন দেয়? মুসলিম উম্মাহ থেকে নিজেদেরকে আলাদা করা সুস্পষ্ট গোমরাহি। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য করার সুযোগ রয়েছে। মতানৈক্যের কারণেই তো চারটি মাজহাবের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তাদের কারো প্রতি কারো কোনো বিদ্বেষ নেই। যারা বলে কুরআন ও হাদিস আঁকড়ে ধরলে উম্মাহর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হবে। যদি তাই হতো তাহলে এক আহলে হাদিসের মধ্যে ঊনিশটি মতপার্থক্যগত গ্রুপ এবং দুই রাকাত নামাজের মধ্যে ৩৯টি ভিন্ন মত থাকতো না।
খতিব মহোদয় বলেন, সালাফি হিসেবে যারা নিজেদের পরিচয় দেন তাদের মাঝেও মতপার্থক্য রয়েছে। ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজ রহ. এবং নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ. বিশ্ববরেণ্য ফকিহ। তাঁরাও তো সকল বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেননি। মিশরীয় স্কোলার সাইয়েদ সাবেক রচিত ফিক্হুস্ সুন্নাহ তরুণ সমাজের কাছে খুবই সমাদৃত। তাঁর লেখা বইয়ের উপর নাসিরুদ্দিন আলবানির অনেক মন্তব্য রয়েছে এবং এক চতুর্থাংশের মতো তিনি মন্তব্য করেছেন। অথচ সবাই একই ঘরোনার ফকিহ। এই মতপার্থক্য খুবই স্বাভাবিক এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসছে। সাহাবায়ে কেরামদের মাঝে মতপার্থক্য থাকলেও কেউ কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না এবং পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ছিল। বর্তমানে এই মতানৈক্য উম্মাহকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং পরস্পরকে শত্রুতে পরিণত করেছে।
খতিব মহোদয় বলেন, উম্মাহর ঐক্য সময়ের দাবি এবং অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় উম্মাহ আজ বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ইসলামের দুশমনরা মুসলিম উম্মাহকে ঈমান ও আমল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভ্রান্তপথে চালাতে চায়। এসময়ে অনৈক্য সৃষ্টিকারী সকল কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড বন্ধ করা দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, উম্মাহর মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও দলাদলি ক্রমাগত বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে উম্মাহ আল্লাহর রোষানলে পড়েছে। আল্লাহর কুরআনের ঘোষণা মোতাবেক উম্মাহর মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করা কুফরি।
রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলে ভিন্নতা ও সাহাবায়ে কেরাম এবং বরেণ্য আলেমদের মাঝে মতানৈক্য চিন্তা ও গবেষণার পথকে প্রসারিত করেছে; এটাকে রহমত হিসেবে গ্রহণ করে নিজ পছন্দমতো সুন্নাতের আমল করে পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য খতিব মহোদয় সকলের প্রতি আহবান জানান। সংক্ষেপিত।
শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
Comments
Post a Comment