ইসা আ.-এর অনুসারী হাওয়ারিদের প্রশংসা করে আল্লাহপাক বলেছেন, (ইসা আ. কর্তৃক তাঁর অনুসারীদের সম্বোধন করে বলা) ‘আল্লাহর দিকে কে আছ আমার সাহায্যকারী? জবাবে হাওয়ারিরা বলেছিল, 'আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী’- সুরা সফ ১৪। তেমনি দীন প্রতিষ্ঠার কাজে রসুলুল্লাহ সা.- এর সাহায্যকারী ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। দুনিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং আমাদের পর্যন্ত পৌঁছা ও মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ সবই সম্ভব হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের চরম আত্মত্যাগের বদৌলতে। পবিত্র মক্কার জমিন সাক্ষ্য দেবে রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের চরম আত্মত্যাগ ও কাফের- মুশরিকদের সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের। নবুয়ত লাভের পর কয়েকজন ব্যক্তি রসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর ইমান এনেছিলেন। তন্মধ্যে আবু বকর রা. অন্যতম। ইমান আনার পর তিনি ছায়ার মতো রসুল সা.-এর সাথে ছিলেন। তাঁর সকল অর্থসম্পদ দীনের প্রচার ও প্রসারে ব্যয় করেছেন এবং বিলাল রা.সহ দাস শ্রেণির লোকদের খরিদ করে স্বাধীন করে দিয়েছেন। বড়ো কঠিন ছিল সেই দিনগুলো।
মক্কায় অবস্থানকালে মা খাদিজা রা. ও আবু বকর রা.-এর সহযোগিতা ছিল সর্বোচ্চ। মি’রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কাফির-মুশরিকদের সাথে অনেক মুসলিমের ইমানও নড়ে উঠেছিল কিন্তু আবু বকর রা. দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠেন, মুহাম্মদ সা. যা বলেন, আমি সব বিশ্বাস করি। রসুলুল্লাহ সা. তাঁর এই প্রিয় সাহাবিকে উপাধি দিলেন ‘সিদ্দিক’। দীনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এক পাল্লায় এবং বাকি সবাইকে এক পাল্লায় রাখলে হয়তো আবু বকরের পাল্লায় ভারি হবে। ক্রমে মক্কার পরিবেশ আর রসুল সা.-এর জন্য মোটেই টিকে থাকার মতো ছিল না এবং তাঁর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেসময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের কথা বলা হলে তিনি তাঁর একান্ত সাথি আবু বকর রা.-কে বলে রাখেন। আবু বকর রা.-এর প্রতি তাঁর কতো বড়ো আস্থা ও নির্ভরতা!
নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে আসলে আর এক সাথি আলী রা.-কে তাঁর বিছানায় রেখে তিনি চলে যান আবু বকর রা.-এর গৃহে এবং তাঁকে রেডি অবস্থায় পান। দু’জন ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে রওনা দেন মদিনার পথে। কতো বিপদসংকুল সেই পথ। শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হায়েনারা নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ছুটছে মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করতে এবং একটি গুহায় আশ্রয় নেয়ার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’- সুরা তওবা ৪০। অপরদিকে রসুলুল্লাহ সা.-এর হিজরতের পর মক্কার সকল সাহাবি এক দুর্বিসহ জীবনের মধ্য দিয়ে বাড়িঘর আত্মীয়স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ছেড়ে চলে আসেন মদিনায়। এই ছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবন এবং দীনের জন্য সর্বস্ব ত্যাগের নমুনা। মদিনায় পৌঁছার পর একে একে বদর, ওহুদ, খন্দকের যুদ্ধে আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী রা.সহ মুহাজির ও আনসার সকলে মিলে যুদ্ধ করলেন এবং একপর্যায়ে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে দীনের বিজয় ঘটলো। সাহাবিদের মর্যাদা প্রসঙ্গে আব্দুল কাদের জিলানী রহ. দ্রুত ধাবমান অশ্বারোহীর সঙ্গে বহু পশ্চাতে বাতাসে ভেসে বেড়ানো একটি অতি ক্ষুদ্র ধূলিরেণুর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন (অধ্যাপক আবু জাফর রচিত ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান বই থেকে)। সাহাবিদের এই অত্যুচ্চ মর্যাদার পেছনে একটিই কারণ- সেটি হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁদের অতুলনীয় ত্যাগ ও কুরবানি।
চরম ত্যাগ ও কুরবানির কারণে সাহাবিদের প্রতি আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর কিতাবে নানাভাবে প্রশংসা করেছেন এবং জান্নাত দানের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর বাণী-
‘মুহাজির ও আনসারদের প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটাই মহাসাফল্য’- সুরা তওবা ১০০।
এর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহকে পেয়ে সন্তুষ্ট। তাঁদের জান্নাত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। আল্লাহপাক সাহাবাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট বর্ণনা করেছেন এভাবে-
‘মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে সেজদার চিহ্ন পরিস্ফুট থাকবে। তওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা হলো- যেমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীকে আনন্দে অবিভূত করে- যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন’- সুরা ফাতহ্ ২৯।
আল্লাহ তায়ালা সাহাবাদের যে চরিত্র অংকন করেছেন তাঁর অনুসারী হিসেবে আমাদের মাঝেও তা থাকতে হবে। আমরা নিজেদেরকে একটু যাচাই করে দেখি।কাফের-মুশরিক ও ইসলামের দুশমনদের প্রতি গভীর সখ্যতা এবং নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ নিয়ে কীভাবে আমরা রসুল সা.-এর সম্মুখে দাঁড়াবো?
সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের দুঃসময়ে সবকিছু নিয়ে রসুলুল্লাহ সা.-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের সাথে কখনো কি তুলনা হয়? আল্লাহর বাণী-
‘কী ব্যাপার যে, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করছো না, অথচ জমিন ও আসমানের উত্তরাধিকার তাঁরই?তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় করবে ও জিহাদ করবে তারা কখনো তাদের সমকক্ষ হতে পারে না যারা বিজেেয়র পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। বিজয়ের পরে ব্যয়কারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। যদিও আল্লাহ উভয়কে ভালো প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’- সুরা হাদিদ ১০।
আল্লাহপাক স্বয়ং রসুল সা.-এর সাহাবি মুহাজির ও আনসারদের প্রশংসা করেছেন। স্বয়ং আল্লাহ যাঁদের প্রশংসা করেছেন, তাঁদের প্রশংসা করতে আমাদের এতো কার্পণ্য কেন? প্রশংসা করার মতো উদারতা না থাকলে চুপ থাকি। আল্লাহপাকের বাণী-
‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে সাহায্য করে। তারা সত্যবাদী। আর এ সম্পদ তাদের জন্যও, যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করেছে ও ইমান এনেছে। তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে, তার জন্য তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ - সুরা হাশর ৮-৯।
তিরস্কার নয়, নিন্দাবাদ নয় বরং আল্লাহ শিখিয়েছেন পূর্ববর্তীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তাঁর বাণী-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের এবং আমাদের আগে যেসব ভাইয়েরা ইমান এনেছে তাদের ক্ষমা করুন। আর ইমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়’- সুরা হাশর ১০।
আল্লাহর শেখানো এই দোয়ার বদৌলতে আল্লাহপাক আমাদের পূর্ববর্তীদের সব দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন এবং তাঁদের প্রতি অন্তরে কোনো বিদ্বেষও রাখবেন না।
মানুষ দোষত্রুটির ঊর্ধে নয়। সাহাবায়ে কেরামও মানুষ এবং তাঁদেরও ভুল-ত্রুটি হয়েছে। তাঁদের দ্বারা অনেক বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো ঘটনাও ঘটেছে। ছদ্মবেশি মুসলমান বিশেষ করে ইহুদি আব্দুল্লাহ বিন সাবা ও তার কিছু সঙ্গী-সাথি এসব ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে এবং তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান রা.-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছে। এরা আলী রা.-এর পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের উস্কানি দিতো ও বিভ্রান্তি ছড়াতো। আলী রা. তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এবং আব্দুল্লাহ বিন সাবাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলে শয়তানটা পালিয়ে বাঁচে। সর্বযুগেই মুনাফিকরা মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও ফাসাদ সৃষ্টির কাজে তৎপর ছিল এবং এখনো রয়েছে।
সাহাবায়ে কেরামের মাঝে যা কিছু ঘটেছে তা সবই ইজতেহাদি ভুল। ইজতেহাদ করতে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে দ্বিগুণ সওয়াব এবং ভুল করলেও একটি সওয়াব। মানবিক দুর্বলতার কারণে ভুল করলে তওবা ও নেক কাজের বিনিময়ে তার ক্ষমা রয়েছে। মা আয়েশা রা. উষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে চরমভাবে অনুতপ্ত হয়েছেন ও তওবা করেছেন। আর সাহাবায়ে কেরামের নেকির পাল্লা এতো ভারি যে আল্লাহপাক তার বিনিময়ে তাঁদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী-
‘যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো মুত্তাকি। তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে তাই রয়েছে, যা তারা চাইবে। এটা সৎকর্মশীলদের পুরস্কার, যাতে এরা যেসব মন্দ কাজ করেছিল আল্লাহ তা মার্জনা করে দেন এবং তাদের উত্তম কর্মের পুরস্কার তাদের দান করেন’- সুরা যুমার ৩৩-৩৫।
‘পুন্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়’- সুরা হুদ ১১৪
সাহাবাদের মর্যাদা প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর কিছু উক্তি আমরা এখানে উল্লেখ করতে চাই-
‘আমার সাহাবাদের তোমরা গালিগালাজ করো না। যার হাতে আমার প্রাণ- তার কসম করে বলছি- যদি তোমাদের কেউ ওহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণও ব্যয় করে, তবে তাদের ব্যয় করা এক অঞ্জলি বা অর্ধেকের সমান পর্যন্ত পৌঁছবে না’- বুখারি ও মুসলিম।
‘আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম’- বুখারি ও মুসলিম।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রা. বলেন, রসুল সা. বলেন- ‘ইসরায়েল সন্তানগণ ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে সকলেই জাহান্নামি, একটি মাত্র দল বাদে। সাহাবিগণ প্রশ্ন করেন : হে আল্লাহর রসুল সা. এ মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি কারা? তিনি বলেন- আমি এবং আমার সহাবিগণ এখন যার উপর আছি’- তিরমিযী।
‘হেদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রসুল সা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে নিক্ষেপ করবো। আর তা অতি নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তন স্থল’- সুরা নেসা ১১৫।
আল্লাহপাক মুহাজির ও আনসার সকল সাহাবিকে ক্ষমা করার কথা বলেছেন। সর্বাগ্যে ইসলাম গ্রহণ ও ত্যাগ-কুরবানির কারণে মুহাজিরদের বেশি মর্যাদা দান করা হয়েছে। আবার বদরের যুদ্ধ ও বাইয়াতে রেদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের এবং মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণকারীদের তুলনায় বেশি মর্যাদা দান করা হয়েছে। আবার সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারী হলেন চার খলিফা (আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী রা.) এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবি (তালহা, জুবাইর, আব্দুর রহমান বিন আওফ, আবু ওবাইদা ইবনুল জাররাহ, সাদ ইবনে আবু আক্কাস, সাইদ বিন যায়েদ রা.)।
সাহাবায়ে কেরামের মাঝে রসুলুল্লাহ সা.-এর পরিবারের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাঁরা সর্বক্ষণ রসুল সা.-এর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং তাঁদের ঘরে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাঁরা যতখানি প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন, অন্যদের ভাগ্যে তা জুটেনি। আল্লাহর বাণী-
আল্লাহ তো চান, তোমাদের নবি পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করতে। আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা যা তোমাদের ঘরে পঠিত হয় তা তোমরা স্মরণে রাখবে’- সুরা আহজাব ৩৩-৩৪।
পর্দার বিধান সাধারণভাবে নাজিল হলেও রসুল সা.-এর স্ত্রীদের জন্য বিশেষ তাগিদ ছিল এবং নৈতিক প্রশিক্ষণ ও পবিত্রতার অনুশীলন নবির সা. ঘর থেকেই আল্লাহপাক শুরু করেছেন। তাঁদের ঘরে কুরআন নাজিলের প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেছেন। আহলে বাইত অর্থাৎ রসুল সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি, বিশেষ করে হাসান রা. ও হোসাইন রা.-এর বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাসান ও হোসাইন রা.-কে জান্নাতে যুবকদের সর্দার বলা হয়েছে। আমরা সকলের প্রতি মুহাব্বত পোষণ করি।
সাহাবিদের সাথে সাথে আয়িম্মায়ে কেরামের প্রতিও ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। আল্লাপাকের বাণী-
‘মুহাজির ও আনসারদের প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার নিন্মদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটাই মহাসাফল্য’- সুরা তওবা ১০০।
মুহাজির ও আনসারদের অগ্রবর্তী দলকে যারা অনুসরণ করবে আল্লাহপাক তাদের প্রতিও সন্তুষ্ট। সাহাবিদের পরেই রয়েছে তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িন এবং তাদের পরে আগত আয়িম্মায়ে কেরামকে আমরা মনে করতে পারি যারা রসুল সা. ও তাঁর সাহাবাদের অনুসরণ করবে। সুধারণা ও শ্রদ্ধাবোধ লোপ পেয়ে আমাদের মাঝে গিবত ও দোষ অন্বেষণ অনেক গুণ বেড়ে গেছে যা সুস্পষ্ট হারাম। গিবতকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে অথচ আমরা এই ঘৃণ্য কাজে খুব আনন্দ পাই। ফিকাহ শাস্ত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন চার ইমামসহ অসংখ্য ইমাম এবং হাদিস শাস্ত্রের ইমামগণ দীর্ঘ চেষ্টা-প্রচেষ্টায় রসুল সা.-এর বাণীসমূহ গ্রন্থাবদ্ধ করেছেন। আহলে হাদিসসহ চার ইমাম এবং আয়িম্মায়ে কেরাম সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। দীনের মৌলিক বিধানের ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই। আমরা যা মতপার্থক্য দেখি তা রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলের মধ্যেই ছিল। এই ভিন্নতা দীন পালনকে সহজ করেছে। মতপার্থক্য উম্মাহকে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করার জন্য নয়। যারা অনৈক্য সৃষ্টি করে তারা মূলত কুফরি করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার বাণী-
‘তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। সেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। যাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে তাদেরকে বলা হবে, ইমানের নেয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নেয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো। আর যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় লাভ করবে এবং চিরকাল তারা এই অবস্থায় থাকবে। এগুলো আল্লাহর বাণী, তোমাকে যথাযথভাবে শুনিয়ে যাচ্ছি। কারণ দুনিয়াবাসীর প্রতি জুলুম করার কোনো এরাদা আল্লাহর নেই’- সুরা আলে ইমরান ১০৫-১০৮।
আল্লাহতায়ালা আরো বলেন-
‘এবং তোমাদের এ জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব আমাকে ভয় করো। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে, প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত’- সুরা মুমিনুন ৫২-৫৩।
আল্লাহর বাণী-
‘যারা দীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করাবেন’- সুরা আনআম ১৫৯।
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস বা আকিদা এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ আল্লাহ, রসুল, কিতাব, আখেরাত, ফেরেশতা ও তকদিরের প্রতি বিশ্বাস এনেই একজন ব্যক্তিকে মুমিন হতে হয়। বিশ্বাসের সাথে সাথে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসুল সা. যেসব বিষয় অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) করেছেন সেসব পালনের মাধ্যমে সে হয় মুসলিম (অনুগত)। উম্মাহর মধ্যে এ নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য রয়েছে মুস্তাহাব আমল নিয়ে যেটা সম্পর্কে আখেরাতে প্রশ্নই করা হবে না। এগুলো সবই পরিপূরক (৪র্থ পত্র) এবং এসব আমল বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবে।
আমরা যতক্ষণ মানুষ আছি ততক্ষণ ভুল-ভ্রান্তি হবে। নবি-রসুল ছাড়া কেউ মাসুম নন (নবি-রসুল আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক সুরক্ষাপ্রাপ্ত)। আল্লাহপাক তাঁর বান্দার গুনাহ মাফ করবেন তওবার মাধ্যমে এবং নেকির বদৌলেও অনেকের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। কারো দোষচর্চার মধ্যে কোনো নেকি নেই বরং রয়েছে গুনাহ। বিশেষ করে যারা আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন তাদের দোষচর্চা করতে রসুলুল্লাহ সা. স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। তাই আমরা আমাদের অন্তর থেকে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে আল্লাহর রসুল সা. ও তাঁর সকল সাহাবি এবং পরবর্তীতে আয়িম্মায়ে কেরামকে অন্তর থেকে মুহাব্বত করবো এবং উম্মাহর ঐক্যের লক্ষ্যে সচেষ্ট হবো। আল্লাহপাক আমাদের কবুল করুন। ১৯.০৯.২০২২।
Comments
Post a Comment