Skip to main content

করোনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ

আমি কোনো বিজ্ঞানী নই। সামাজিক মানুষ এবং সমাজ নিয়ে ভাবি। কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেটি উপেক্ষা না করে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সমাজের মানুষের ভাবনা-চিন্তাগুলো জানার চেষ্টা করি এবং নিজের উপলব্ধিটা শেয়ার করি। শুরু থেকেই করোনা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছি এবং বিশ্বাসের জায়গা থেকেই লেখার চেষ্টা করেছি। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে একেবারে ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম এবং ঘরকেই মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিলাম। সেই অবস্থা থেকে সরে এসেছি। এখন প্রয়োজনে বাজারে যাচ্ছি এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করছি। ২০ রাকাত পুরো তারাবিহ পড়ার মতো সুস্থতা আল্লাহপাক এখনো বহাল রেখেছেন। তাঁর দরবারে শুকরিয়া, আলহামদু লিল্লাহ। আমার বিশ্বাস, মসজিদে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়ার মধ্যে করোনা থেকে সুরক্ষাও রয়েছে। আমেরিকাপ্রবাসী ছেলের সাথে কথা বলার সময় রসিকতা করে বললাম, ২০ রাকাত তারাবিহ পড়া মানে ৫/৬ কিলো হাঁটার মতো শারীরিক শ্রম (করোনা নিয়ে আমার ছেলের কিছু গবেষণা আছে এবং সে শারীরিক শ্রমের ওপর খুব গুরুত্ব দেয়, সেই প্রেক্ষিতেই বলা এবং আমার কথা শুনে সে একটু হেসে দিল)। আসলে আল্লাহর বিধান তাঁর বান্দাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের জন্য সমভাবে কল্যাণকর। মোমিন আখেরাতের ছওয়াবের আশায় কাজ করে, আর মহান আল্লাহ আখেরাতে তো দেবেন, দুনিয়াতেও দেন। আখেরাতের উদ্দেশ্যে করা হলেও নামাজ, রোজাসহ সব ইবাদতে দুনিয়াবী কল্যাণও রয়েছে। করোনার টিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অনেকেই (ইংল্যান্ড, ইসরাইলসহ ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশ) ভালো অবস্থানে চলে আসলেও আবার ভারতসহ অনেক দেশে করোনা সংক্রমণ বিপদজনক হয়ে পড়েছে। গতকাল ভারতে ২৪ ঘন্টায় করোনা শনাক্ত ৩,৪৬,৭৮৬ জন এবং মৃত্যু ২,৬২৪ জন। ভারতে মোট মৃতের সংখ্যা ১,৯০,২১০ (বিশ্বে তৃতীয়) এবং মোট শনাক্ত ১,৬৭,৪৩,৯৫৫ জন (বিশ্বে দ্বিতীয়)। বিশ্বে মোট আক্রান্ত ১৪,৬৫,২০,০২৭ জন এবং মৃত্যু ৩১,০৩,৩৩৪ জন। গত ২৪ ঘন্টায় বিশ্বে করোনায় মারা গেছেন প্রায় ১৫ হাজার। বাংলাদেশে গত ২৪ ঘন্টায় করোনা শনাক্ত ২,৬৯৭ এবং মৃত্যু ৮৩ জন। মোট শনাক্ত ৭,৪২,৪০০ এবং মৃত্যু ১০,৯৫২ জন। বাংলাদেশে গড় করোনা শনাক্তের হার ১৩.৯৫। গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউনের পর আজ ২৫ এপ্রিল দোকানপাট খুলছে এবং ২৯ এপ্রিল থেকে গণ পরিবহন খুলে দেয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে লকডাউন দীর্ঘদিন চলা সম্ভব নয়। কর্মহীন দরিদ্র মানুষগুলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। মুষ্টিমেয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাড়া সবাই করোনায় বিপর্যস্ত। বেসরকারি খাত ২/১টা ছাড়া সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যবসায়ীরা আদৌ ব্যবসা-বাণিজ্য না করতে পেরে ঋণগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। শহর এলাকায় অনলাইনে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার কিছু সুযোগ পেলেও গ্রামে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এটি জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। গ্রামে করোনার উপস্থিতি লক্ষণীয় নয় এবং তাদের মাঝে কোনো ভীতিও নেই, তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। গ্রামে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায় এবং নিয়মিত এসেম্বলি ও প্যারেড-পিটি বাধ্যতামূলক করলে সহজেই করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে পারে। আমি আমার কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে পেশ করছি। আমার এক মামাতো ভাইসহ তার অফিসে (হেড অফিস) একসাথে ৯০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে তিনজন বাদে সবাই নিজ বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করে সবাই এখন সুস্থ। বাসায় স্ত্রী ও দু’টি শিশু সবসময় মাস্ক পরে ছিল এবং তারা আক্রান্ত হয়নি। আমার বেয়াই-বেয়াইনের পরিবার তাঁদের তিন নাতি-নাতনি (সবাই শিশু) ছাড়া সবাই আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমার প্রতিবেশি ভায়রা করোনা পজিটিভ হয়ে ৫/৬ দিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় চিকিৎসা শেষে এখন করোনা নেগেটিভ। তাঁর স্ত্রী সুস্থ মানুষ, স্বামীর সেবাযত্নের লক্ষ্যে একই কেবিনে ছিল এবং বাসায় স্ত্রী ও মেয়ে সর্বক্ষণ মাস্ক পরে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আল্লাহর মেহেরবানিতে সুস্থ আছেন। আমার কিছু প্রিয় মানুষ বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবারের সাথেই অবস্থান করছেন এবং যতদূর জানি তাঁরা ভালো আছেন।একান্ত বাধ্য না হলে করোনার কারণে হাসপাতালে না যাওয়ায় ভালো। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে আমি মানুষের সাথে কথা বলি। টিকার ২য় ডোজ গ্রহণে লকডাউনে রিক্সায় যাতায়াতের সময়ে কথা বলে তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমাদের জানামতে করোনায় কোনো রিক্সাচালক মারা গেছে বা আক্রান্ত হয়েছে? তাদের জবাব, একজনও না। লকডাউনের আগে বাসে চলতে গিয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শুনি গণপরিবহন থেকে করোনা ছড়ায়, তোমাদের ড্রাইভার, হেল্পার কেউ কি করোনায় মারা গেছে? জবাব দিল, না। ২/৩ দিন আগে বাসার সামনে ভ্যানের ওপর থেকে কলা কিনলাম। মাস্কটা থুতনির সাথে ঝুলছে। বললাম, মাস্কটা ঠিক করে নেও। তার জবাব, আমাদের করোনা হবে না। কতবড় আত্মবিশ্বাস! একটু বাড়ায়ে বললো, স্যার আপনারও হবে না। শ্রমজীবী মানুষ আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহ তাঁর বন্ধুর দোয়া কবুল করুন। বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখলাম, মাস্ক ছাড়াই ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের আগের দিন বাজারে গিয়েছিলাম। পা রাখার জায়গা ছিল না। আমি তো কিছুক্ষণ ছিলাম এবং দ্রুত বাসায় ফিরে গোসল না করলেও ভালো করে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ যারা বাজারে বেচাকেনা করছে, বাসে কাজ করছে, রিক্সা চালাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যবিধি অতো মানেও না- তাদের সুরক্ষা কে দেন। বাসায় অনেকে কাজ করে এবং তারা থাকে বস্তিতে। আমরা একসময় তাদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিলাম (অবশ্য তাদের বেতন ঠিকমত দিয়েছি), এখন তারা আসছে এবং কাজ করছে। করোনায় সেখানেও কেউ মারা যায়নি। এসব বিষয়ে আমাদের গবেষকদের ভাবতে হবে। আমার উপলব্ধি, আল্লাহপাক সমগ্র বিশ্বে একযোগে করোনা দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে সতর্ক করার জন্য। এত ক্ষুদ্র একটি জীবাণু যা খালি চোখে দেখা যায় না তার আক্রমণে বিশ্বের পরাশক্তি সব ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। তাদের মজুদকৃত আনবিক বোমা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষ্ময়কর উন্নতি কোনো কাজে আসলো না। স্রষ্টার কাছে মানুষের অসহায়ত্ব নগ্নভাবে ধরা পড়লো। পৃথিবীর সেরাশক্তি আমেরিকা সবচেয়ে বেশি পর্যদস্তু। আল্লাহপাক কুরআনে আদ, সামুদ ও ফেরাউনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তাদেরকে পরাশক্তি হিসেবেই চিত্রিত করেছেন এবং আল্লাহর ক্ষমতার কাছে অতীতে কোনো শক্তি টিকতে পারেনি। বালা-মুসিবত যা আপতিত হয় তা আমাদের হাতের কামাই বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। কুরআন মজিদে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তার কারণও বলা হয়েছে। সমাজে জুলুম ও অশ্লীলতার ব্যাপক প্রচলন হলে আল্লাহপাক গজব হিসেবে সমাজে মহামারি বা প্রকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে থাকেন। যেমন, লুত (আ)-এর জাতির সমকামিতা, শোয়াইব (আ)-এর জাতির মাপে-ওজনে কম দিয়ে ঠকানো ও ফেরাউনের জুলুম। আমরা এমন এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি, যিনি সৃষ্টি করে চুপটি মেরে বসে থাকার মতো কোনো সত্তা নন বরং যিনি সবকিছুর নিয়ন্তক, মহাপরাক্রমশালী এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, যা ইচ্ছা করেন সেটিই হয়। করোনা নিয়ে যা ঘটছে তা তাঁর দৃষ্টির বাইরে নয়। সাধারণত শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং চিকিৎসাসুবিধা বঞ্চিত বস্তিতে বসবাসকারী হতদরিদ্র মানুষগুলো মহামারিতে বেশি আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশ নিয়ে সেটিই বলা হয়েছিল। এখানে আট কোটি লোক আক্রান্ত হবে ও বিশ লক্ষ মারা যাবে। আল্লাহপাক আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে ফিরে এসে তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া দরকার। করোনা থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বেশি বেশি করে তাওবা-এস্তেগফার করা ও জীবনকে পরিশুদ্ধ করে নেয়া। এবারে বান্দা হিসেবে আমাদের কিছু করণীয় বলতে চাই। আমাদের কাছে করোনা এসেছে একটি সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে। ফলে আমাদেরকে সতর্ক থাকতেই হবে। বিশ্বব্যাপী গৃহিত পন্থা মাস্ক পরিধান, ঘন ঘন হাত ধোয়া ও দূরত্ব বজায় রেখে চলা আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। কোনো মাস্কই ভাইরাস প্রতিরোধী নয়। অনেক গবেষক বিশেষ করে আমার ছেলের মতে মাস্ক নাককে গরম করে রাখে এবং ভাইরাসের বংশবিস্তারে বাধা দেয়। তার বিশ্বাস, বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর বড় কারণ এসিতে বসবাস। ফলে বিত্তবানদের মৃত্যু বেশি। এসিতে থাকলে অবশ্যই মাস্ক পরে থাকতে হবে। তাকে দেখি ল্যাবরেটরিতে একাকী মাস্ক পরে বসে থাকতে। তার মতে বাহিরে শুধু নয় ঘরেও একটি সময় মাস্ক পরে থাকা করোনা প্রতিরোধে সহায়ক। তার একটি গবেষণাপত্র আমেরিকায় একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তার মতে ভাইরাস এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় বরং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্দিজ্বরের মতো এর কোনো চিকিৎসা নেই। এই ভাইরাসটি ভয়ঙ্কর। তাই সতর্ক হতেই হবে। সতর্ক হওয়া বলতে সে বারবার বলতে চায়- ‘এসি পরিহার করুন ও মাস্ক ব্যবহার করুন।’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যা যা দরকার- পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পরিমিত পানি পান, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরে রৌদ্র লাগানো, শারীরিক শ্রম/ব্যায়ামসহ পরিচিত যেসব নিয়ম রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করতে হবে। তার ধারণা, বাংলাদেশে মহিলাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেক কম হওয়ার পেছনে কারণ রানা-বান্নায় তাদের অংশগ্রহণ করা। আমেরিকায় মহিলাদের মৃত্যুহার যেখানে ৫২ সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৩ জন। তার মতে গরম খাওয়া ও গরম পানিতে গোসল উত্তম। করোনা নিয়ে অন্যান্যদের মতো তার মতও চূড়ান্ত নয়। সারা বিশ্বের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান মাত্র। আমি নিজে অনুসরণের চেষ্টা করি। এই গ্রীষ্মকালে আমি গরম পানিতে গোসল করি। করোনা আল্লাহর সৃষ্ট এক ক্ষুদ্র জীবাণু। তাঁর শেখানো ভাষায় (সুরা ফালাক) আমরা বলি, পরোয়ারদেগার! তোমার সৃষ্ট সকল কিছুর অনিষ্ট থেকে তোমারই কাছে আশ্রয় চাই। তুমি আমাদের হেফাজত করো। পবিত্র রমজান মাস। সকল গুনাহ থেকে আমরা তাওবা করছি। তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো এবং ইসলামের ওপর অবিচল রেখ। আমিন। ২৫.০৪.২০২১

Comments