Skip to main content

ইসলামে নর ও নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক

আল্লাহপাকের অপূর্ব সৃষ্টি! প্রতিটি জীবকে তিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, কণ্ঠস্বর, রুচি, মন-মানসিকতা ও ঝোঁক-প্রবণতা ইত্যাদি বিষয়ে পৃথকভাবে সৃষ্টি করা হলেও উভয়ের মধ্যে স্রষ্টা দিয়ে রেখেছেন এক তীব্র আকর্ষণ। নর ও নারী পরস্পরের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দি নয় বরং পরিপূরক। দুই-এ মিলেই পূর্ণতা। বিবাহের মাধ্যমে নর-নারীর মধ্যে সৃষ্টি হয় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। আদিকাল থেকেই নর-নারীর এই বৈবাহিক সম্পর্ক অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এবং এর বাইরে একত্র জীবন-যাপন (লিভ টুগেদার) অত্যন্ত নোংরা, ঘৃণ্য ও অপরাধ হিসেবে সকল ধর্মে স্বীকৃত। নর ও নারীর সৃষ্টিগত দৈহিক গঠন ও চিন্তা-চেতনায় পার্থক্যের কারণে তাদের কর্মক্ষেত্রও পৃথক হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রাকৃতিক নিয়মে একজন পুরুষকে শক্তিশালী এবং কঠোর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার উপযোগী করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে কমল প্রকৃতিতে এবং তার মাঝে দয়া-মায়া ঢেলে দেয়া হয়েছে। সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য যা যা প্রয়োজন একজন নারীর মাঝে তা পূর্ণমাত্রায় দান করা হয়েছে। মানবসভ্যতার টিকে থাকা নির্ভর করে নারীর সন্তান ধারণ, জন্মদান ও লালন-পালনের ওপর এবং মাতৃত্বের দায়িত্বের কারণেই তাকে মহা সম্মানিত ও উচ্চতর আসন দান করা হয়েছে। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত এবং পিতা অপেক্ষা মাতার সম্মান তিনগুণ বেশি। যদি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করার হুকুম দেয়া হতো তাহলে সন্তানকে হুকুম দেয়া হতো মাকে সেজদা করার। সন্তান প্রসবকালে কোনো মা’র মৃত্যু হলে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করে। এ-সবই প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর পবিত্র জবান থেকে উচ্চারিত। বর্তমানে ভোগবাদী ও বস্তুগত সভ্যতায় নারীর শ্রমের মূল্যায়ন করা হয় না। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যে শ্রমের বিনিময় মূল্য নেই সেটি আসলে শ্রম নয়। তাই বলা হয় অর্ধেক জনশক্তিকে বেকার ও কর্মহীন রেখে কোনো জাতি অগ্রসর হতে পারে না। এ কথাটি ধোঁকা ও নারী জাতিকে শোষণ করার হাতিয়ার বৈ আর কিছু নয়। অথচ একটি সংসারে নারী যে শ্রম দেয় তা পুরুষ কল্পনাও করতে পারে না। আমার মাকে দেখেছি, তিনি সবার আগে ঘুম থেকে জাগতেন আবার সবার শেষে ঘুমাতেন। তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই, সর্বক্ষণ তাঁর ব্যস্ততা। আসলে ব্যাখ্যাটা এই হওয়া উচিৎ, মা বা স্ত্রীর কাজ টাকার অংকে পরিমাপযোগ্য নয়। তাঁদের শ্রম ও সেবা অমূল্য। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমরা সম্পদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানি। তন্মধ্যে হস্তান্তর যোগ্যতা। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল মৃত্যুর সাথে সাথে তঁদের কবি প্রতিভাও নিয়ে গেছেন, এটি কারো কাছে হস্তান্তর করে যেতে পারেননি। তাই তাঁরা জাতির জন্য সম্পদ নয়; এ কথা আমরা বলতে পারি না। আসলে অর্থনীতিরও একটি সীমাবদ্ধতা আছে। তাই সবকিছু আমরা অর্থনীতি দিয়ে বিবেচনা করতে পারি না। ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, দয়া-মায়া, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা সবই জীবনের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু এ-সব সম্পর্কে অর্থশাস্ত্র নীরব। এটি এই শাস্ত্রেরই সীমাবদ্ধতা। সাধারণভাবে আল্লাহপাক পুরুষকে বহির্মূখী ও নারীকে অন্তর্মূখী করেছেন। নারী গৃহে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে কারণ তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে সেভাবে। নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, এমনটি নয়। বের হতে পারবে বলেই তো পর্দার বিধান। নারী ও পুরুষের জন্য পর্দা ফরজ। এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ নেই। পর্দা মানার ক্ষেত্রে অবহেলা কবীরা গুনাহ এবং অস্বীকার করা কুফুরি। পর্দার পরিধি কতটুকু এ নিয়ে ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও মুখমন্ডল ছাড়া সমগ্র শরীর আবৃত করে রাখা নারীর জন্য ফরজ-এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই। রসূলুল্লাহ (সা) মি’রাজের রাতে জাহান্নামে একদল নারীকে চুল বেঁধে লটকিয়ে শাস্তি দেয়া প্রত্যক্ষ করেন এবং এমন শাস্তির কারণ জিজ্ঞাসা করলে ফেরেশতারা জানায়, তারা দুনিয়ায় মাথা খোলা রাখতো। কর্মক্ষেত্রে পর্দা মেনে চলার মতো পরিবেশ পাওয়া নারীর অধিকার। একজন নর ও নারীকে নিভৃতে একত্রিত হওয়াকে ইসলামে বড় আপত্তি করা হয়েছে এবং হাদিসে বলা হয়েছে শয়তান সেখানে তৃতীয় জন হিসেবে উপস্থিত থাকে। বেপর্দা নারীর স্বামী এবং বেপর্দা নারীর অভিভাবককে দায়ূস বলা হয়েছে এবং দায়ূস কখনই জান্নাতে যাবে না। লিঙ্গভেদে শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহপাক পুরুষকে দেননি। শুধুই কি তাই? ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বংশ, দেশ কোনোভাবেই মানুষে মানুষে বৈষম্য বা আশরাফ-আতরাফ ইসলামে নেই। সবাই আদমের (আ) সন্তান আর আদম (আ) মাটির তৈরী। আল্লাহর কাছে সেই উত্তম যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে (সূরা হুজুরাত ১৩)। পীর সাহেবের ছেলে যদি নীতিবান (আল্লাহভীরু) না হয় তাহলে তার বংশমর্যাদা বা পিতৃ পরিচয় একেবারেই মূল্যহীন। পক্ষান্তরে একজনের জন্ম যতো নিম্নবংশ বা দারিদ্রের মাঝে হোক না কেন সে যদি নীতিবান হয় আল্লাহর কাছে তার মূল্য অনেক উচ্চে। আবার দেশের প্রেসিডেন্ট যদি নীতিভ্রষ্ট হন পক্ষান্তরে তাঁর পিয়ন যদি নীতিবান (তাকওয়ার অধিকারী) হয় তাহলে প্রেসিডেন্টের চেয়ে তাঁর পিয়নের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অসামান্য। ইসলাম সকল আভিজাত্য বা কৌলিন্য উৎখাত করে মানুষে মানুষে সমতা নিয়ে এসেছে। শুধু কথায় নয়, কাজে-কর্মে ও আচরণে সত্যিকার সাম্য রসূলুল্লাহ (সা) বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন। তৎকালে নারী জাতি ও দাসরা ছিল সবচেয়ে নিগৃহিত। মুহাম্মদ (সা)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজে মানুষে মানুষে সব ভেদাভেদ দূর করে সমতা নিয়ে এসেছেন। মর্যাদাগতভাবে ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমতা প্রদান করেছে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী’-সূরা তাওবা ৭১। হাদীসের ভাষায়-‘তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার তোমাদের উপরও তাদের সম অধিকার’। এখানে মনিব ও গোলামের সম্পর্ক নয় বরং সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। ইসলামে ডিক্টেটর হওয়ার সুযোগ নেই। পারিবারিক বিষয়ে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সকল কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এটা শুধু নির্দেশ নয় বরং মুমিনদের প্রকৃতিই এমন। কুরআনের ভাষায়-‘তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’-সূরা শূরা ৩৮। পরামর্শের ভিত্তিতে যদি পরিবারে সকল সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তাহলে সেই পরিবারে আর অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে না। পারিবারিক অশান্তির অন্যতম কারণ স্ত্রীকে যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর নয় সেই পরিবারের সন্তানরাও বখাটে হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহর রসূল (সা) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম এবং কিয়ামতের দিন স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে’। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য আনুগত্য অপরিহার্য। জীবনে সর্বত্রই আনুগত্য ও শৃঙ্খলা এবং যেখানে আনুগত্য নেই সেখানেই বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি। চার বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করলেও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একজনকে কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। তারা হয়তো যাকে কর্তৃত্বশীল করেছে তাকে বলছে এমডি এবং বাকিরা পরিচালক। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই রয়েছে আনুগত্য ও শৃঙ্খলা। পশু-পাখির রাজ্যেও দেখা যায় কাউকে না কাউকে লিডার মেনে অনুসরণ করতে। পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কাউকে না কাউকে কর্তৃত্বশীল মানতে হয়। এখানে আল্লাহপাক নিজেই পুরুষকে নারীর ওপর কর্তৃত্বশীল করেছেন এবং ঈমানদার নারীর বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে সে তার স্বামীর আনুগত্য করে (সূরা নিসা ৩৪)। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা)-এর আনুগত্যের বাইরে সকল আনুগত্যই শর্তাধীন। স্রষ্টার নাফরমানি করে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই। আল্লাহর নাফরমানির পর্যায়ে না পড়লে সন্তান তার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, স্ত্রী তার স্বামীর আনুগত্য করবে এবং অধীনস্থ তার বস বা নেতার আনুগত্য করবে। এখানে আনুগত্যহীনতার কোনো সুযোগ নেই যতক্ষণ আল্লাহর বিধানের পরিপন্থি না হয়। আনুগত্য হবে স্বতস্ফুর্ত এবং সেটি হয় তখন ইবাদত। সাথে সাথে কর্তৃত্বশীলকে হতে হবে অবশ্যই দরদী এবং সকল কাজ সে পরামর্শক্রমে সম্পন্ন করবে। এটিই আল্লাহর বিধান। পরামর্শে ঐকমত্য না হলে অবশ্যই সন্তান তার পিতা-মাতার, স্ত্রী তার স্বামীর এবং অধীনস্থ তার নেতা/বসের হুকুম মেনে চলবে। স্বামীর সন্তুষ্টি বিধানের ওপর স্ত্রীর জান্নাত নির্ভর করে। স্বামীর মর্যাদা এতোটাই যে, স্ত্রী স্বামীর সম্মতি ছাড়া নফল নামায-রোযার মতো ইবাদত পালন করতে পারে না। যে স্ত্রী স্বামী থেকে বিছানা আলাদা করে তার প্রতি অভিশাপ প্রদান করা হয়েছে। নামায-রোযার মতো মৌলিক ইবাদত পালনের সাথে যে স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করে চলে জান্নাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো বাধা নেই। হাদিসে বলা হয়েছে, যে দরজা দিয়ে খুশি সে জান্নাতে প্রবেশ করুক। আবার রসূল (সা) হুশিয়ারও করে দিয়েছেন, মি’রাজের রাতে তাঁকে জাহান্নাম প্রদর্শন করা হলে তিনি দেখেন তাদের অধিকাংশই নারী এবং এর অন্যতম কারণ স্বামীর অবাধ্যচরণ। আত্মীয়তার হক আদায়ের ব্যাপারে ইসলামের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না’। আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রতিবেশিসহ সকল শ্রেণির মানুষই সদাচরণের দাবীদার। ইসলামে আত্মীয়তার দু’টি দিক-এক. রক্তসম্পর্কীয়, দুই. বৈবাহিক। সম্পূর্ণ অপরিচিত দু’জন নর ও নারীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠে বিবাহ নামক চুক্তির মাধ্যমে। বিবাহের মাধ্যমে আরো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়; যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা, দেবর-ননদ ইত্যাদি। সদাচরণ সবারই প্রাপ্য। কতটুকু পাবে সেটি নির্ভর করে প্রয়োজনের ওপর। আমাদের সমাজে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী অনেক মহিলার ধারণা কুরআন-হাদিসে পিতা-মাতার খেদমতের কথা যেভাবে বলা হয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির কথা সেভাবে বলা হয়নি। ফলে তাদের খেদমত করা বা বাসায় রাখা পুত্রবধূর দায়িত্ব নয় বরং শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য উপযুক্ত স্থান বৃদ্ধাশ্রম। আমি বলি, ফিতরাতের ধর্মে আলাদা উল্লেখের কোনো প্রয়োজন নেই। পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যে মর্যাদা আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। একটি জন্মগত, অন্যটি আইনগত; যেমন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও আইনগত। উভয় সম্পর্ক প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে, অতঃপর তিনি তার বংশগত সম্পর্ক ও বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। আপনার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান’-ফুরকান ৫৪। রসূলুল্লাহর (সা)-এর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আবু বকর (রা) ও ওমর (রা) তাঁদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহপাক পুরুষের দায়িত্ব সীমিত করেননি। স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা-ফুফু, মামা-খালা আরো অনেকের দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন হতে পারে। এটি নির্ভর করে আত্মীয়-স্বজনের অসহায়ত্ব ও তার সামর্থের ওপর। নারীর দায়িত্ব খুবই সীমিত। পিতার সংসারে, স্বামীর সংসারে, সন্তান ও ভাইয়ের সংসারে সর্বত্রই তার নিরাপত্তা রয়েছে। স্ত্রী তার উপার্জন ও মহরানার মালিক নিজে এবং সংসারে খরচ করা তার জন্য ফরজ নয়। সংসারে খরচ করলে স্বামীর প্রতি ইহসান করা হয় এবং তাতে সে বিপুল পরিমাণ ছওয়াবের ভাগিদার হয়। একাধিক সন্তান-সন্ততি থাকলে পিতা-মাতা কোথায় অবস্থান করবে সেটি নির্ভর করবে তাঁদের মর্জির ওপর। পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজেদের কাছে রাখার জন্য সন্তানদের মাঝে কাড়াকাড়ি হওয়াটাই স্বাভাবিক। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব মূলত ছেলের এবং ছেলে না থাকলে মেয়ে ও জামাই-এর। পিতা-মাতা যদি তাদের নিজ ভিটেই থাকতে চায় সে ব্যবস্থা করাও সন্তানের দায়িত্ব। সবই নির্ভর করে প্রয়োজন ও সমঝোতার ওপর। আবহমান কাল থেকে সেবার দায়িত্ব মূলত নারীই পালন করে আসছে এবং আল্লাহপাক তাকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। উপার্জনের দায়িত্ব একান্তভাবে পুরুষের। দু’জন মিলেই রচিত হয় একটি সুখের সংসার। পরস্পরের মন জুগিয়ে চলার মধ্যেই রয়েছে সংসারে স্বস্তি ও আনন্দ। কোনো সন্তানই তার পিতা-মাতাকে উপেক্ষা করতে পারে না। পিতা-মাতা, স্ত্রী ও পরিবারের সবাইকে ম্যানেজ করে চলতে হয়। তারপরও যদি অগ্রাধিকারের প্রশ্ন দেখা দেয় তাহলে আমি বলবো সন্তানের জন্য পিতা-মাতাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। পিতা-মাতা সব সময়ই সন্তানের কল্যাণ কামনা করে থাকে। পিতা-মাতা সন্তানের কাছে বেশি কিছু চায় না। একটু খোঁজ-খবর নেয়া ও সদাচরণই যথেষ্ট। আমি ইতোপূর্বে যৌথ পরিবার শিরোনামে লিখেছিলাম, ইসলামে জায়েজ কাজের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ হলো স্ত্রীকে তালাক দেয়া। স্ত্রী যদি স্বামীর পিতা-মাতাকে সহ্য করতে না পারে তাহলে এমন স্ত্রীকে তালাক দেয়া সন্তানের জন্য বৈধ। এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই। হযরত মুয়াজ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূল (সা) আমাকে দশটি বিষয়ে ওসিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে তিনি বলেছেন, তুমি যদি নিহত বা দগ্ধও হয়ে যাও তবু আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। যদি পিতা-মাতা তোমার পরিবার ও সম্পদ ছেড়ে দিতে আদেশ দেন তবুও তাদের অবাধ্য হয়ো না। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ২২৭৫ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার একজন স্ত্রী ছিল। যাকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা (হযরত ওমর বিন খাত্তাব রা.) তাকে পছন্দ করতেন না। তিনি আমার স্ত্রীকে তালাক দিতে বললেন। কিন্তু আমি তালাক প্রদানে আপত্তি জানালাম। তখন আমার পিতা রসূল (সা)-এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলে রসূল (সা) তাকে তালাক দিতে বললেন। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করি। মুসনাদে আবু দাউদ- ১৯৩১, মুসনাদে আহমাদ- ৪৭১২, সুনানে আবু দাউদ- ৫১৩৮। হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর স্ত্রী হাজেরা (আ)সহ ইসমাঈল (আ)-কে মক্কার নির্জন এলাকায় এক মশক পানি ও খেজুরসহ রেখে আসা, সন্তানের জন্য মা হাজেরার (আ) সাফা-মারওয়া দৌড়াদৌড়ি, জমজমের সৃষ্টি, সেখানে জুরহাম গোত্রের বসবাস, পিতা-পুত্র মিলে কাবা পুননির্মাণ ইত্যাদি বিষয়াবলী নিয়ে বুখারী শরীফে দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। জুরহাম গোত্রের মেয়ের সাথে ইসমাঈল (আ)-এর বিয়ে হয় এবং দীর্ঘদিন পরে ইব্রাহিম (আ) মক্কায় ফিরে এসে তাঁর ছেলের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাঁদের খোঁজ-খবর নেন। ইসমাঈল (আ)-এর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী অনেক দুঃখ-কষ্টের কথা জানায়। পুত্রবধূর জবাব শুনে তিনি সন্তুষ্ট হতে না পেরে বলেন, ‘ ইসমাঈল (আ) বাড়ি আসলে আমার সালাম বলবে ও ঘরের চৌকাঠ পাল্টাতে বলবে’। ইসমাঈল (আ) বাড়ি আসার পর স্ত্রী সব ঘটনা বললে তিনি স্ত্রীকে তার বাবার বাড়ি চলে যেতে বলেন এবং তালাক দেন। পরবর্তীতে একই বংশে আর একটি মেয়েকে তিনি বিয়ে করেন। কিছুদিন পরে ইব্রাহিম (আ) আবার তাঁর ছেলের বাড়ি আসেন এবং পুত্রবধূকে তাদের সংসারের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, তাঁরা খুব ভালো আছেন এবং সুখে-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করছেন। ইবরাহিম (আ) খুব সন্তুষ্ট হয়ে জানান, ইসমাঈল (আ) বাড়ি আসলে আমার সালাম বলবে এবং ঘরের চৌকাঠ বহাল রাখতে বলবে। ইসমাঈল (আ) ফিরে আসলে সব ঘটনা শুনে বলেন, তিনি আমার বৃদ্ধ পিতা এবং স্ত্রী হিসেবে তোমাকে রাখার কথা বলেছেন। একটি পরিবারে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানীয় ব্যক্তি হলেন পিতা-মাতা ও উর্ধে যাঁরা রয়েছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও নানা-নানী পরিবারের জন্য বোঝা নয় বরং সম্পদ- সহজ জান্নাত লাভের উপায়। মিম্বরে আরোহনকালে একদিন রসূল (সা) বলেন, ‘এইমাত্র জিবরাইল (আ) আমাকে বলে গেলেন- যে ব্যক্তি রমযান মাস পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম আমিন, যার সম্মুখে আমার নাম উচ্চারিত হলো অথচ দরুদ পড়লো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম আমিন এবং যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম-আমিন’। এ হাদীস থেকে বোঝা যায় সন্তানের জন্য পিতা-মাতা হলো জান্নাতে যাওয়ার সহজতম মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের পিতা-মাতা উভয়ই বা কোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে তোমরা উহ্ শব্দটি উচ্চারণ করবে না। তাদের সম্মুখে সবসময় নত হয়ে থাকবে’-বনি ইসরাঈল ২৩। কথা, কাজ ও আচরণে পিতা-মাতা সামান্যতম কষ্ট পান এমন কিছু করা সন্তানের জন্য কবিরা গুনাহ এবং যার শাস্তি আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়ায়ও আল্লাহ দিয়ে থাকেন। পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের পাশাপাশি তাঁদের অবর্তমানে পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও ভালো আচরণের তাগিদ রয়েছে এবং সকল সময় তাঁদের জন্য দোয়া করার ভাষাও আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন (রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা)। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বর্তমান অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে পিতা-মাতার সে অবস্থান আর নেই। সন্তানের কাছে পিতা-মাতা আজ আর নিরাপদ নয়। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় মাদকাসক্ত ও বখাটে ছেলে-মেয়েদের হাতে পিতা-মাতা শারীরিকভাবে নিগৃহিত হচ্ছে। ইসলাম থেকে বিচ্যুতিই মূলত এই অবস্থার জন্য দায়ী। একটি পরিবার যৌথ না একক সেটি নির্ভর করে প্রয়োজনের ওপর। ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর একত্র জীবন-যাপনকে পছন্দ করে। বাবা-মার খেদমতের লক্ষ্যে স্ত্রীকে গ্রামে রেখে স্বামীর মেসে থাকাটা সমর্থনযোগ্য নয়। স্ত্রীকে রেখে প্রবাসজীবনও কাম্য নয়। পর্দা মেনে চলার কারণে একক পরিবারই ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম। বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবার প্রয়োজন দেখা দিলে ছেলে ও পুত্রবধূকে অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এ-ব্যাপারে পুত্রবধূকেই অগ্রণী হতে হবে। এমন কোনো নাদান ছেলে পাওয়া যাবে না যার পিতা-মাতাকে তার স্ত্রী অনাদর অবহেলা করে আর সে তার স্ত্রীকে আদর সোহাগ করবে। এটি মানবপ্রকৃতির বাইরে। আজকে যে বধূ আগামীতেই সেই শাশুড়ি। হাদিসের কথা, যে দয়া করে না সে দয়া পায় না। দেখা যায়, যে মহিলা তার শাশুড়ির সাথে উত্তম ব্যবহার করতে কার্পণ্য করছে সেই বাড়িতে তার পিতা-মাতার সেবার ব্যাপারে ভাবীদের নিন্দাবাদ করছে। রসূল (সা)-এর একটি হাদিস স্মরণ করে দিতে চাই, কেউ যদি রুজির প্রশস্ততা ও হায়াত বাড়াতে চায় সে যেন তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করে। শ্বশুর-শাশুড়ির চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে? আত্মীয়তার হক এমন নয় যে তার সাথে ভালো ব্যবহার করলে সেও করবে। বরং হক তাই, কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও সে উত্তম ব্যবহার করবে। পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়িসহ সকলের সাথে সদারচণের মধ্য দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতে সুখি জীবন যাপনের তাওফিক আল্লাহপাক আমাদেরকে দান করুন। ১২.০২.২০২১

Comments