বিসমিল্লাহির
রাহমানির রহীম
যাকাত শব্দের
আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি এবং এর আর একটি অর্থ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা। নামাযের পরে যাকাত
ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং একটি আর্থিক ইবাদত। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের
মধ্যে শামিল হওয়ার জন্য নামাযের সাথে যাকাতও অপরিহার্য-‘যদি তারা তাওবা করে এবং নামায কায়েম করে
ও যাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই’। যাকাত আদায় না করা মূলত মুশরিকদের কাজ-‘ধ্বংস ঐ সব মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত
আদায় করে না’। ইসলামে নামায ও যাকাতের মধ্যে কোন পার্থক্য করার সুযোগ নেই। হযরত খালিদ
বিন ওয়ালিদ (রা) বলেছেন-‘নামায ও যাকাত একটি অপরটির সম্পূরক, একটি ছাড়া অন্যটি কবুল হয় না’। রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরে কিছু লোক
যাকাত দিতে অস্বীকার করলে আবু বকর (রা) অস্বীকারকারীদেরকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ঘোষণা
করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সমাজে নামায কায়েম ও যাকাত আদায় রাষ্ট্রসরকারের
দায়িত্ব হলেও মুসলমানরা স্ব-উদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ করে নামাযের ব্যবস্থা করলেও যাকাত
আদায়ের তেমন সামষ্টিক উদ্যোগ নেই। মানুষের ধারণা সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করলে তার সম্পদ
কমে যাবে। অথচ সম্পদের যিনি প্রকৃত মালিক (আমরা যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো)
সেই মহান আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা যে যাকাত দাও প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা যাকাত
দানকারী তার সম্পদ বর্ধিত করে’। সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মানুষ সুদে অর্থলাগায়। অথচ আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দান-সদকাকে
ক্রমবৃদ্ধি দান করেন’। আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে নানাভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহর পথে খরচকে তিনি নিজের জন্য ঋণ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং বলেন-তোমরা কর্জে হাসানা
দাও আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন’। ‘তোমরা খরচ করো, নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংস করো না’। আল্লাহ যেমন উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী,
তেমনি তিনি তাঁর বান্দাদেরকে সেভাবে দেখতে চান। তাঁর বাণী-‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা
করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’। রাসূল (সা) দানের ক্ষেত্রে নানাভাবে তাঁর উম্মতদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তিনি বলেছেন-দাতা জনগণের নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী ও আল্লাহর নিকটবর্তী; পক্ষান্তরে
কৃপণ জনগণ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে ও আল্লাহ থেকে দূরে’। কৃপণকে সবাই ঘৃণা। তিনি আরো বলেছেন-‘তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করো, কত খরচ করলে
তা হিসেব করো না; তাহলে আল্লাহও বেহিসেবী দান করবেন’। বৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনের সাথে হিসেব করে যাকাত আদায়ের মাধ্যমেই কেবল
সম্পদ পবিত্র হয়। কুরআনের বাণী-‘তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ করো এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে পবিত্র ও
পরিশুদ্ধ করো’। একজন মুসলমান এই বিশ্বাস নিয়েই যাকাত প্রদান করে যে, এর মাধ্যমে তার
সম্পদ পবিত্র হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সে অনেক গুণ বৃদ্ধিসহ ফেরৎ হবে।
আল্লাহ ও তাঁর
রাসূল (সা)-এর স্পষ্ট ওয়াদা যে, যাকাতের মাধ্যমে যাকাতদাতার সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং আখিরাতে
সে এর উত্তম বিনিময় লাভ করবে। এই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোন নিষ্ঠাবান মুসলমানের মাঝে
বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয় নেই। ফলে তারা স্বতস্ফুর্ত ও সানন্দে যাকাত আদায় করে ভারমুক্ত
হন। এখন আমরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যাকাতের প্রভাব (যাকাত
সম্পদ বৃদ্ধি করে) নিয়ে আলোচনা করবো। একটি অর্থনীতিতে ব্যাপক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন
ব্যাপক ভোগ। ক্ল্যাসিকেল অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য-‘যোগান তার নিজস্ব
চাহিদা সৃষ্টি করে’ (Supply creats its own demand) অর্থাৎ ব্যাপক উৎপাদন হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার চাহিদা সৃষ্টি হয়ে উৎপাদিত
জিনিস নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ক্ল্যাসিকেল অর্থনীতিবিদদের এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে
১৯৩০ দশকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে মহামন্দা দেখা দেয়। আমেরিকার জাতীয় আয় এক-তৃতীয়াংশে
চলে আসে এবং পুঁজি হারিয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে বসে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে
এক নতুন ধারণা নিয়ে আবির্ভূত হন সাড়াজাগানো অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস। তাঁকে পুঁজিবাদের
ত্রাণকর্তা বলা হয়। তিনি বললেন-সমাজের আয় ও ব্যয় কখনো সমান হয় না। মানুষ তার আয়ের একটি
অংশ সঞ্চয় করে। সমাজের মোট আয় ও ব্যয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার কারণেই মন্দা সৃষ্টি হয়
এবং দেখা দেয় উৎপাদন ও আয়হ্রাস; ফলে সৃষ্টি হয় বেকারত্ব। এর থেকে উত্তরণের জন্য ব্যয়
বাড়াতে হবে এবং ব্যয় বাড়ালে ভোগ বাড়বে ও উৎপাদন বাড়বে। তাই ভোগবৃদ্ধির লক্ষ্যে পুঁজিবাদী
অর্থনীতিতে শ্রমজীবী মানুষকে অধিক হারে মজুরি, বেকার ভাতা ও নানা ধরনের সুবিধা এবং
ঋণদানের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা হয়। সাধারণত ধনী মানুষের ভোগপ্রবণতা কম
অর্থাৎ তারা যা আয় করে তার বেশির ভাগই সঞ্চয় করে, পক্ষান্তরে দরিদ্র মানুষের ভোগপ্রবণতা
অনেক বেশি এবং তাদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। অর্থনীতিবিদরা হিসেব করে বলেছেন-একটি সমাজের
ভোগপ্রবণতা যদি ৮০% হয় তাহলে সেই সমাজে বিনিয়োগ করলে আয় সৃষ্টি হবে পাঁচগুণ। আর যদি
ভোগপ্রবণতা ৫০% হয় তাহলে আয় বাড়বে মাত্র দ্বিগুণ। যাকাতের খাতসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা
যায় যে, এখানে দরিদ্রদের পেছনেই ব্যয়টা হয়ে থাকে এবং এই শ্রেণির মানুষের ভোগপ্রবণতা
বেশি হওয়ায় সমাজে সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে
সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে ও বেকারত্ব দূর হয়। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য
সেন বলেন প্রাচুর্যতার মাঝেও দারিদ্র থাকতে পারে, যদি তাদের ক্রয়ক্ষমতা না থাকে। যাকাত
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায়। তাই আমরা যাকাত হিসেবে যা প্রদান করি সামগ্রিক অর্থনীতিতে
তা ব্যয়ের মাধ্যমে আয়ের স্রোতে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসে। তাই বলা যায়, যাকাত দারিদ্র
বিমোচনের সাথে সাথে সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এবং দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়।
আল্লাহ বলেছেন-তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করো, নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংস করো না। কার্পণ্যের
মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, বরং কল্যাণ রয়েছে আল্লাহর বান্দাদের জন্য খরচ করার মধ্যে। সুদ
প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা যায় যে, সুদের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক ঋণাত্মক। তাই সুদের হার
যত বাড়ে বিনিয়োগ তত হ্রাস পায় এবং এর ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়, আয় হ্রাস পায় ও বেকারত্ব
বাড়ে। আল্লাহপাক সাহেবে নেছাব ভাইবোনদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাঁর
প্রিয়ভাজন বান্দাহ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। ২১/০৬/২০১৭
Comments
Post a Comment