Skip to main content

ইসালে সওয়াবের সুন্নাত সমর্থিত পদ্ধতি

 জুমার খুতবা

২৬.০৫.২০২৩

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ শুরুতে আল্লাহপাকের হামদ ও রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করেন। তিনি বলেন, মুমিনরা সবসময় আখিরাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। পক্ষান্তরে কাফিররা দুনিয়ার জীবনটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাদের কাছে হালাল-হারাম বড়ো কথা নয়। কীভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যায় এবং দুনিয়ায় প্রাধান্য বিস্তার করা যায় সে চেষ্টায় সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে এবং মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতনে পিছপা হয় না। তারাও কিছু ভালো কাজ করে এবং সেটার পেছনে থাকে নাম-যশ ও খ্যাতি। মারা গেলে বড়ো জৌলুস করে খানাপিনার আয়োজন করে। মানুষ মারা গেলে তাদের প্রিয়জন মৃতের জন্য ইসালে সওয়াব করতে পারে (মৃতের জন্য সওয়াব পৌঁছানো)। আজকের জুমা আলোচনায় খতিব মহোদয় সুন্নাত সমর্থিত ইসালে সওয়াব নিয়ে আলোচনা করেন। আজকের আলোচনায় তিনি কুরআন ও হাদিস থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি পেশ করেন।

প্রথমত : দোয়া করা

ইসালে সওয়াবের জন্য প্রথম করণীয় হলো মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। জীবিতদের কাছে এটি তার হক। আসলে মুসলমান মাত্রই পরস্পর কল্যাণকামী, সেটি জীবিত ও মৃত সবার জন্য। এ প্রসঙ্গে কুরআনের কিছু আয়াত খতিব মহোদয় উল্লেখ করেন। আল্লাহপাক সুরা হাশরের ১০ নং আয়াতে মুমিনদের চরিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে- (সফলকাম তারাও) যারা পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের রব! তুমি আমাদের মাফ করে দাও, আমাদের আগে যে ভাইয়েরা ইমান এনেছে, তুমি তাদেরও মাফ করে দাও এবং আমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে, তাদের ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না, হে আমাদের রব, তুমি অবশ্যই মেহেরবান ও পরম দয়াল।’

সুরা নূহ ২৮ নং আয়াতে এভাবে দোয়া করা হয়েছে- ‘হে আমার রব! তুমি আমাকে, আমার পিতামাতাকে- তোমার ওপর ইমান এনে যারা আমার সাথে ইমানের এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, এমন সব ইমানদার পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য চূড়ান্ত ধ্বংস ছাড়া কিছুই তুমি বৃদ্ধি করো না।’

সুরা ইবরাহিম ৪১ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে আমাদের রব! যেদিন চূড়ান্ত হিসাব কিতাব হবে, সেদিন তুমি আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সকল ইমানদার মানুষদের ক্ষমা করে দিয়ো।’

পিতামাতার জন্য দোয়া করার ভাষাও আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন- ‘রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা’- সুরা বনি ইসরাইল ২৪।

আমরা সকল মুসলমানের জন্য দোয়া করবো। তন্মধ্যে নিজের পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত জনদের জন্য বেশি করে করবো। এই দোয়ার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়- চার দিন, চল্লিশ দিন বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন নয়। এগুলো সবই বিদয়াত। এই দোয়া সবসময় এবং নামাজ ছাড়া আসলে দোয়া হয়ে ওঠে না। নিজের জন্য যখন দোয়া করবো তখন সেই দোয়ায় শরীক করবো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজন এবং যারা দোয়া চাইবে তাদের  সবাইকে।

দ্বিতীয়ত : সদকা করা

জীবিতদের মতো মৃতদের জন্যও দান-সদকা করা যায় এবং এর সওয়াব তাদের কাছে পৌঁছে। বহু হাদিস দ্বারা তা প্রমাণিত। এখানে কিছু হাদিস পেশ করা হলো।

১. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদা রা.-এর অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার কোনো উপকারে আসবে? বললেন, হাঁ। সাদ রা. বললেন, আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমার ‘মিখরাফ’ নামক বাগানটি আমার মা’র জন্য সদকা করলাম। সহিহ বুখারি, হাদিস ২৭৫৬।

২. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, এক লোক নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন, কোনো অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয়, তিনি যদি কথা বলতে পারতেন, তাহলে সদকা করে যেতেন। আমি তার পক্ষ থেকে সদকা করলে তিনি কি এর সওয়াব পাবেন? বললেন, হাঁ। সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০০৪

৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন এবং ধন-সম্পদ রেখে গেছেন কিন্তু অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার (গোনাহের) কাফফারা হবে? বললেন, হাঁ। সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৬৩০

৪. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, আস ইবনে ওয়ায়েল জাহেলি যুগে একশো উট জবেহ করার মানত করেছিল। অতঃপর (তার ছেলে) হিশাম তার পক্ষ থেকে ৫০টি উট জবেহ করে। (বাকি ৫০টি অপর ছেলে আমর জবেহ করতে চান।) এ ব্যাপারে তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তোমার পিতা যদি তাওহীদ স্বীকার করতো আর তুমি তার পক্ষ থেকে রোজা রাখতে বা সদকা করতে, তবে এ তার কাজে আসতো। মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৬৭০৪

যে কোনো নেক কাজের ইসালে সওয়াব করা জায়েয। তবে সকল পদ্ধতির গুরুত্ব ও মর্যাদা এক পর্যায়ের নয়।

তৃতীয়ত : হজ পালন

১. বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত, আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলো, ...আমার মা হজ না করে ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি? তিনি বললেন, (হাঁ), তুমি তার পক্ষ থেকে হজ করো। -সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৪৯

২. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, জুহায়না গোত্রের এক মহিলা এসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আমার মা হজের মানত করেছিলেন কিন্তু তা পূরণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি? তিনি বললেন, হাঁ, তার পক্ষ থেকে হজ করো। আচ্ছা তোমার মা’র উপর ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করো। তাঁর ঋণই অধিকতর পরিশোধযোগ্য। -সহিহ বুখারি, হাদিস ১৮৫২

৩. ইবনে আব্বাস রা, থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে لبيك عن شبرمة বলতে শুনে জিজ্ঞেস করলেন, শুবরুমা কে? বললো, আমার এক ভাই। অথবা বলেছে, আমার এক নিকটাত্মীয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হজ করেছ? বললো, জ্বি না। বললেন, আগে তুমি হজ করো তারপর শুবরুমার পক্ষ থেকে করো। -‘সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১৮১১

চতুর্থত : উমরা পালন

আবু রাজিন উকায়লী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রসুল! আমার পিতা খুবই বৃদ্ধ। তিনি হজ, উমরা এমনকি সফর করতেও সক্ষম নন। নবিজী বললেন, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা করো। -সুনানে তিরমিযী, হাদিস ৯৩০

এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, মাজুরের পক্ষ থেকে নায়েব হিসেবে উমরা করা জায়েয। সুতরাং নিজে উমরা করে মাইয়িতকে সওয়াব পৌঁছানোও জায়েয হবে। কারণ ‘নিয়াবতে’র চেয়ে ইসালে সওয়াব হালকা।

শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে সালেহ আল উসায়মীন রাহ. (১৪২১হি.) বলেন,

يجوز الاعتمار عن الميت كما يجوز الحج عنه.

মৃতের পক্ষ থেকে হজের মতো উমরা করাও জায়েয। -ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম পৃ. ৫০৬

শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে জিবরীন রাহ. (১৪৩০হি.) বলেন,

যে কোনো নেক আমল মাইয়িতকে হাদিয়া দেওয়া জায়েয এবং এ তার উপকারে আসবে। যেমন হজ, উমরা, সদকা, দোয়া, জিহাদ ইত্যাদি। -আদদুরারুল মুবতাকারাত ফী শরহি আখসারিল মুখতাসারাত ১/৪৫৪-৪৫৫

পঞ্চমত. কুরবানি

১. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির জন্য কালো পা, কালো পেট ও কালো ভ্রু বিশিষ্ট দুম্বা আনার নির্দেশ দিলেন। আনা হলে তিনি আয়েশা রা.-কে বললেন, একটি ছুরি এনে পাথরে ঘষে ধারালো করো। তিনি তা-ই করলেন। তারপর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাকে শুইয়ে জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন এবং বললেন,

باسم الله، اللهم تقبل من محمد وآل محمد، ومن أمة محمد.

‘আল্লাহর নামে জবেহ করছি। হে আল্লাহ! আপনি তা কবুল করুন মুহাম্মদ ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে।’ তারপর কুরবানি করলেন। -সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৯৬৭

২. আবু সায়িদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানি করেছেন এবং বলেছেন, এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার যে সকল উম্মত কুরবানি করতে অক্ষম তাদের পক্ষ থেকে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১১০৫১

আরো দ্রষ্টব্য : মুসতাদরাকে হাকিম ৪/২২৮

নূরুদ্দীন হায়ছামী রহ. (৮০৭হি.) বলেন, رجاله ثقات ‘এর বর্ণনাকারীগণ ছিকা’। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৪/১৯

৩. জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির দিন শিং বিশিষ্ট কালো ও সাদা রঙ মিশ্রিত দুটি দুম্বাকে জবেহের জন্য কেবলামুখী করে শোয়ান এবং এই দোয়া করেন-

إني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض، على ملة إبراهيم حنيفا، وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين، لا شريك له، وبذلك أمرت وأنا من المسلمين، اللهم منك ولك، وعن محمد وأمته، باسم الله والله أكبر.

আমি একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে মুখ ফেরালাম, যিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মিল্লাত অনুযায়ী, যিনি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহ অভিমুখী করেছিলেন। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামাজ, আমার কুরবানি ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এরই আদেশ করা হয়েছে। আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। ইয়া আল্লাহ! এটা তোমারই পক্ষ থেকে এবং তোমারই জন্য- মু‏হাম্মাদ ও তার উম্মতের তরফ থেকে।

এরপর তিনি বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবেহ করেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ২৭৯৫

ষষ্ঠত. রোজা

১. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ রোজা জিম্মায় রেখে মারা গেলে তার অভিভাবক যেন তার পক্ষ থেকে রোজা রাখে। -সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯৫২

২. ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আমার মা মারা গেছেন কিন্তু তার জিম্মায় এক মাসের রোজা ছিল। আমি কি তার পক্ষ থেকে কাজা করতে পারবো? তিনি বললেন, হাঁ। আল্লাহর ঋণই অধিকতর পরিশোধযোগ্য। -সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯৫৩

৩. বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত, আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলাম, এক মহিলা এসে বললো, -  ...আমার মা ইন্তেকাল করেছেন। তার জিম্মায় এক মাসের রোজা ছিল। আমি কি তার পক্ষ থেকে রোজা রাখতে পারবো? তিনি বললেন, হাঁ, তুমি তার পক্ষ থেকে রোজা রাখো। -সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৪৯

সপ্তমত. নামাজ

নামাজ পড়ে মৃত ব্যক্তিকে সওয়াব পৌঁছানো জায়েয। আমরা আগে দেখেছি যে, অর্থ ও দেহের সমন্বিত ইবাদত তো বটেই রোজার মতো নিখুঁত ইবাদাতে বাদানিয়ারও ইসালে সওয়াব জায়েয। এ থেকে বোঝা যায় যে, নামাজের ইসালে সওয়াব করাও জায়েয।

ইবনে কুদামা রাহ. (৬২০হি.) দোয়া, ইস্তিগফার, হজ ও রোজার ইসালে সওয়াব সংক্রান্ত কিছু হাদিস উল্লেখ করে বলেন,

এগুলো সহিহ হাদিস এবং এ থেকে বোঝা যায়, সকল নেক আমল মাইয়িতের উপকারে আসবে। কারণ রোজা, হজ, দোয়া ও ইস্তিগফার ইবাদাতে বাদানিয়া হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ এর কল্যাণ মৃত ব্যক্তিকে পৌঁছান। সুতরাং অন্যান্য নেক আমলের হুকুমও একই হবে। -আলমুগনী ৩/৫২১

শায়েখ উসায়মীন লিখেছেন,

নামাজ পড়ে বা সদকা করে বা হজ করে অথবা কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা রোজা রেখে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিকে দান করতে কোনো অসুবিধা নেই।

এরপর তিনি সদকা সংক্রান্ত দুটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, অন্যান্য ইবাদত সদকার মতই, উভয়ের মধ্যে কোনো ফারাক নেই।

আর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে এগুলোর ইসালে সওয়াব অবৈধ হওয়ার সমর্থনে কোনো বক্তব্য নেই। এজন্য এ কথা বলা যাবে না যে, যে বিষয়গুলোর ইসালে সওয়াবের কথা হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। সুন্নায় যেহেতু সাধারণ ইবাদতের কথা এসেছে তাই যেগুলো সম্পর্কে তা নীরব, সেগুলোর হুকুমও বর্ণিত বিষয়গুলোর মতই হবে। বিশেষত যখন এগুলো নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ থেকে ইরশাদ করেননি। বরং তাঁর কাছে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার সমাধান জানতে চাওয়া হলে তিনি সমাধান দিয়েছেন। আর নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের সমাধান থেকে এটা কিছুতেই প্রমাণিত হয় না যে, এ ছাড়া অন্যগুলো অবৈধ। -মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েলে ইবনে উসায়মীন ১৭/২৫৮

অষ্টমত. কুরআন তিলাওয়াত

আগের আলোচনা থেকেই বোঝা গেছে যে, কুরআন তিলাওয়াতের ইসালে সওয়াব করা জায়েয। রোজা আর কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই ইবাদাতে বাদানিয়া এবং নিম্নোক্ত বর্ণনাগুলো থেকেও এর বৈধতা বোঝা যায় :

১. মাকিল ইবনে ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের মাইয়িতের জন্য সুরা ইয়াসিন পাঠ করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩১২১

আরো দ্রষ্টব্য : সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৩০০২; মুসতাদরাকে হাকিম ১/৫৬৫

২. আবদুর রহমান ইবনে আলা ইবনে লাজলাজ থেকে বর্ণিত, তার পিতা সন্তানদের বলেছেন, আমি মৃত্যুবরণ করলে তোমরা আমাকে কবরে রাখবে এবং بسم الله وعلى سنة رسول الله বলে সুন্দরভাবে মাটি বিছিয়ে দিবে। তারপর আমার মাথার কাছে সুরা বাকারার শুরু ও শেষাংশ পাঠ করবে। আমি ইবনে উমর রা.- কে তা পছন্দ করতে দেখেছি। -তারিখে ইবনে মায়ীন, দূরী সংকলিত ২/৩৭৯-৩৮০

ইমাম বায়হাকী রাহ. (৪৫৮হি.) বলেন, هذا موقوف حسن ‘এর সনদ হাসান’। ইমাম নববী রাহ.ও এর সনদকে হাসান বলেছেন।

দ্রষ্টব্য : আদ দাআওয়াতুল কাবীর ২/২৯৭; নাতাইজুল আফকার ৪/৪২৬

৩. শাবী থেকে বর্ণিত, আনসার (সাহাবিগণ) মাইয়িতের কাছে সুরা বাকারা তিলাওয়াত করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১০৯৫৩

ইবনে হাজার রাহ. বলেন, মুজালিদ জয়িফ হলেও পরিত্যক্ত নন; বরং ইমাম মুসলিম রাহ. তার হাদিস সমর্থক পর্যায়ে এনেছেন। -নাতাইজুল আফকার ৪/৩০৯

৪. আবু উমায়্যা আযদী থেকে বর্ণিত, জাবির ইবনে যায়েদ রাহ. মাইয়িতের কাছে সুরা রা‘দ তিলাওয়াত করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১০৯৫৭

ইবনে হাজার রাহ. বলেন, سنده صحيح ‘এর সনদ সহিহ’। -নাতাইজুল আফকার ৪/৩১২

এ বর্ণনাগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে কিছু দুর্বলতা থাকলেও সামগ্রিকভাবে এটা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন তিলাওয়াত মাইয়িতের উপকারে আসে।

ইমাম ইবনে কুদামা রাহ. তিলাওয়াতের সওয়াব রেসানির বৈধতার দলীল আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,

এতে মুসলমানদের ইজমা আছে। প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক শহরে তারা সমবেত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে সওয়াব রেসানি করেছে। এতে কেউ কোনো আপত্তি করেনি। -আলমুগনী ৩/৫২২

শাফেয়ি ফকিহদের মধ্যেও অনেক ফকিহের মত এটাই যে, কুরআন তিলাওয়াতের ইসালে সওয়াব করা জায়েয। বিশেষত যদি আল্লাহর কাছে এই দোয়া করা হয় যে, তিনি যেন এই সওয়াব মাইয়িতের কাছে পৌঁছে দেন। যাদের মধ্যে ইবনে আবী আসরূন রাহ. (৫৮৫হি.), ইবনে আবিদ দাম রাহ. (৬৪২হি.), ইবনুস সালাহ রাহ. (৬৪৩হি.), তাকীউদ্দীন সুবকী রাহ. (৭৫৬হি.), ইবনুল মুলাক্কীন রাহ. (৮০৪হি.), যাকারিয়া আনসারী রাহ. (৯২৬হি.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

খতিব মহোদয় বলেন, মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদের দেশে টাকা-পয়সা বা খানাপিনার বিনিময়ে আনুষ্ঠানিক কুরআন খতমের যে আয়োজন করা হয় তা সুন্নাহ সমর্থিত নয়। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনরা স্বতস্ফুর্তভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে মৃত ব্যক্তির ইসালে সওয়াব করতে পারবে। 

খতিব মহোদয় বলেন, মানুষ মারা গেলে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত জানাজা ও দাফন হওয়া উত্তম। বিদেশ থেকে লাশ নিয়ে আসা বা একাধিক জানাজা বা গায়েবানা জানাজা সুন্নাহ সমর্থিত নয়। আল্লাহপাক আমাদের সকল কাজকর্ম বিদয়াতমুক্ত হয়ে সুন্নাহ সমর্থিত পন্থায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

★ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : খতিব মহোদয় তাঁর আলোচনায় যেসব হাদিস উল্লেখ করেছেন সেগুলো আমার হোয়াটসএ্যাপে দেওয়ার কারণে লেখাটি সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দোয়া রইলো।

Comments