বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
জুমার খুতবা
০৫.০৫.২০২৩
মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ শুরুতে আল্লাহপাকের হামদ ও রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করেন। তিনি বলেন, সালাম ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং আদব বা শিষ্টাচার, আজকের খুতবায় সালাম প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদিস থেকে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন। সুরা নেসার ৮৬ নং আয়াত (যখন তোমাদের সালাম দ্বারা অভিবাদন জানানো হয়, তখন তোমরা তার চাইতেও উত্তম পন্থায় তার জবাব দাও, কিংবা ততটুকু ফেরত দাও, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর হিসাব রাখেন) উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, সালাম দিতে হবে উত্তম পন্থায় এবং জবাব দিতে হবে তার চেয়েও অধিক উত্তম পন্থা ও মর্যাদা সহকারে।
আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাদিস উদ্ধৃত করে খতিব মহোদয় বলেন, রসুলুল্লাহ সা. একজন সাহাবিকে সালাম দেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে। সাহাবি জবাবে বলেন, ওয়া আলাইকুমুস সালাম। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার জন্য দশ নেকি। আর একজন সাহাবি জবাবে বলেন, ওয়া আলাইকুমুস সালাম ও রহমাতুল্লাহ। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার বিশ নেকি। আর একজন সাহাবি জবাবে বলেন, ওয়া আলাইকুমুস সালাম ও রহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতু। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার ত্রিশ নেকি। অর্থাৎ সালামের জবাব যে যত সুন্দরভাবে দিতে পারবে তার নেকি তত বেড়ে যাবে। একান্ত না পারলে অন্তত সালাম দানকারীর মতো করে দিতে হবে। সালাম আদান- প্রদানের সময় হাসিমুখ থাকতে হবে। সালামের ফজিলত প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর অনেক কথা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দুজন মুমিন সালাম বিনিময় শেষে যখন পরস্পর মুসাফা করেন তখন তাদের থেকে গুনাহ ঝরে যায় যেমন গাছ থেকে শুকনা পাতা ঝরে যায়।
সালামের প্রচলন মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে। আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পর তাঁকে বলেন, ফেরেশতাদের একটি দল সেখানে অবস্থান করছে তুমি তাদের সালাম দাও। আদম আ. ফেরেশতাদের সালাম দেন- আসসালামু আলাইকুম বলে। ফেরেশতারা জবাবে বলেন, ওয়া আলাইকুমুস সালাম। জান্নাতিরা জান্নাতে সর্বত্র বিচরণ করবে এবং তাদের সম্ভাষণ হবে সালাম। আল্লাহর বাণী, ‘সেখানে তাদের একটি মাত্র ধ্বনিই থাকবে, হে আল্লাহ তায়ালা, তুমি মহান, তুমি পবিত্র! সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’ এবং তাদের শেষ ডাক হবে আলহামদু লিল্লাহ, যাবতীয় তারিফ সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহ তায়ালার জন্য’- সুরা ইউনুস ১০। জান্নাতে মুমিনদের সাথে আল্লাহপাকের দীদার হবে এবং আল্লাহ নিজেও সালাম দিবেন। আল্লাহ তায়ালার এক নাম সালাম।
আল্লাহপাক ঈমানদারদের জন্য মজুদ করে রেখেছেন অসংখ্য নেয়ামতেভরা জান্নাত। ঈমানদাররা দলে দলে জান্নাতে প্রবেশ করার সময় তাদেরকে সালামের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো হবে। আল্লাহর বাণী, ‘যারা তাদের মালিককে ভয় করেছে তাদের সবাইকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে; এমনি করে যখন সেখানে তারা এসে হাজির হবে তার দরজাসমূহ (তাদের অভিবাদনের জন্য আগেই) খুলে রাখা হয়েছে, (উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে) তার রক্ষী (ফেরেশতা)-রা তাদের বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাকো, চিরন্তন জীবন কাটানোর জন্য তোমরা এখানে দাখিল হয়ে যাও’- সুরা আঝ ঝুমার ৭৩।
কুরআন ও হাদিসে নানাভাবে সালামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে সালামের ব্যাপক প্রসারের কথা বলা হয়েছে। দুনিয়ার জীবনে মুমিনদের সকল তৎপরতার লক্ষ্য হলো জান্নাতপ্রাপ্তি। জান্নাতপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. চারটি আমলের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো ১. সালামের ব্যাপক প্রসার, ২. মানুষকে খানা খাওয়ানো, ৩. আত্মীয়স্বজনের প্রতি রহম করা, ৪. সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন রাত্রি জেগে তাহাজ্জুদ আদায় করা। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। খতিব মহোদয় বলেন, আমাদের সমাজে ধারণা প্রচলিত আছে ছাত্র শিক্ষককে সালাম দিবে, অধীনস্থরা বসকে সালাম দিবে অর্থাৎ মর্যাদায় যারা ছোট তারা বড়দের আগে সালাম দিবে। অথচ রসুলুল্লাহ সা.-কে আগে সালাম দেওয়া কখনো সম্ভব হতো না। তিনি ছোটদের আগে সালাম দিতেন। মুসলমানমাত্রই পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে সালাম দেওয়ার জন্য হাদিসে বলা হয়েছে। আগে সালাম দেওয়া সুন্নত এবং যে সালাম শুনবে তার জবাব দেওয়া ওয়াজিব। সালাম এমনভাবে দিবে যাতে যাকে সালাম দেওয়া হচ্ছে সে শুনতে পারে। উচ্চস্বরে সালাম দেওয়া যা অন্যের জন্য বিরক্তিকর, সেটা ঠিক নয়। রসুলুল্লাহ সা. এমনভাবে সালাম দিতেন যাতে পাশে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমের ব্যাঘাত হতো না। সালাম দেওয়ার সময় হাত উঠানো ঠিক নয়। অবশ্য দূরবর্তী কাউকে হাতের ইশারায় সালাম দেওয়া যায়।
পারিবারিক জীবনে ব্যাপক সালামের প্রচলন হওয়া দরকার। স্বামী স্ত্রীকে ও স্ত্রী স্বামীকে এবং পিতা-মাতা সন্তানকে ও সন্তান পিতা-মাতাকে সালাম দিবে। সালাম একটি ইবাদত ও দোয়া। যে পরিবারে সালামের ব্যাপক প্রচলন আছে সেই পরিবারে সাধারণত শান্তি বিরাজ করে। পরিবারে শান্তি বিনষ্টের অন্যতম কারণ সালামের প্রচলন না থাকা। নিজের ঘর বা কারো ঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে আল্লাহ সালাম দেওয়ার কথা বলেছেন। কুরআনের বাণী, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা কখনো নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে- (সে ঘরের লোকদের) অনুমতি না চেয়ে ও তার বাসিন্দাদের প্রতি সালাম না করে প্রবেশ করো না; এটা তোমাদের জন্য উত্তম, আশা করা যায়, তোমরা (এ থেকে কিছু) শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে’- সুরা নূর ২৭।
সালামের প্রসঙ্গে খতিব মহোদয় বলেন, আরোহী ব্যক্তি দণ্ডায়মান বা বসা ব্যক্তিকে সালাম দিবে, চলন্ত ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে আগে সালাম দিবে, অধিক সংখ্যক লোককে অল্পসংখ্যক লোক সালাম দিবে, ছোটরা বড়দের আগে সালাম দিবে, সন্তান পিতামাতাকে সালাম দিবে- সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো আদব। আগে সালাম দেওয়াকে উত্তম বলা হয়েছে এবং সেটাকে অহঙ্কার থেকে মুক্ত থাকার উপায় বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজে একটি কথা চালু আছে যে সালাম দিলে ৯০ নেকি এবং জবাবে ১০ নেকি অথচ সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং জবাব দেওয়া ওয়াজিব। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। হাদিসে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। অবশ্যই আগে সালাম দেওয়া উত্তম এবং তাতে বেশি নেকি রয়েছে। খতিব মহোদয় সালামের ব্যাপক প্রসারের জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।
Comments
Post a Comment