Skip to main content

এক ব্যতিক্রম ও সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠান

আমাদের দেশে সরকারি অফিস-আদালত সম্পর্কে সুধারণা নেই। অধিকাংশ অফিসে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক অফিসে সেবাপ্রার্থীরা সেবাগ্রহণে গেলে পিয়ন থেকে শুরু করে সবারই ধারণা যে প্রভুর দরবারে গোলাম হাজির হয়েছে। একটু সদাচরণ বা কাজটি সময়মত করে দেওয়া তো নয়ই বরং নানাভাবে হয়রানির সম্মুখীন হয়। ঘুষ তো রয়েছেই। ঘুষ কারে দিতে হয় এবং কীভাবে দিতে হয় অনেক সেবাপ্রার্থী সেটাও জানে না। ফলে অনেক সময় তাদেরকে দালাল ধরতে হয়। অফিস-আদালতে এমন চিত্র আমাদের পত্র-পত্রিকা ও নানাবিধ প্রচার মাধ্যমে প্রায়ই লক্ষ করা যায়।

আজকে আমি এক ব্যতিক্রমধর্মী ও সুখকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো। আমার কাছে লাইফ ভেরিফিকেশনের মেসেজ আসে। ইতোপূর্বে কুষ্টিয়া জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে এই কাজটি করেছি। মেসেজে উল্লেখ রয়েছে, যে কোনো হিসাবরক্ষণ অফিসে এনআইডি কার্ড দেখিয়ে ভেরিফিকেশন করা যাবে। আমি একটু প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান স্যারের সাথে কথা বলি। তিনি জানালেন, সেগুনবাগিচায় সিজিএ অফিসে গেলে পাঁচ মিনিটেই ভেরিফিকেশন হয়ে যাবে। কুষ্টিয়া জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের সাবেক সুপার জনাব ইজ্জত আলী (অব) সাহেবকে বললে তিনি জানালেন, স্যার সিজিএ অফিসে গেলে চা- নাস্তাসহ আপনার কাজ করে দিবেন। 

আমি এক সুধারণা নিয়েই আজ সেগুনবাগিচায় সিজিএ অফিসে যাই। যাওয়ার সাথে সাথে এক পিয়ন জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার কি পেনশনের কাজ? আমার সাথে আসেন।’ দোতলায় এক কনফারেন্স রুমে গিয়ে চেয়ারে বসার সাথে সাথে এক বতল পানি, বিস্কুট ও চা চলে আসলো। আমি এনআইডি কার্ডটা কর্মরত অফিস সহকারীর হাতে দিলাম এবং চা পান শেষ হতে না হতেই আমার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। কোনো সরকারি অফিসে এত দ্রুত কাজ হয় আমার জানা ছিল না। এ এক অভাবনীয় ঘটনা। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন থেকে এমন সেবা চালু হয়েছে। তারা জানালেন, বর্তমান সিজিএ জনাব মো. নূরুল ইসলাম স্যার আসার পর প্রায় বছর খানেক হলো পেনশনারদের এমন সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। বললাম, আমি তাঁকে একটু অভিনন্দন জানাতে চাই। সাক্ষাত করার সুযোগ আছে কি? বললেন, হ্যাঁ। আমরা যেখানে কাজ করছিলাম তার বিপরীতে সিজিএ মহোদয়ের অফিস।

আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে আমার সাক্ষাতের বিষয়ে অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। অফিসে প্রবেশ করে সালাম দেওয়ার পর তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, বাবা বসেন। পেনশনার সবাইকে তিনি সম্মানসূচক ‘বাবা’ সম্বোধন করেন। তাঁর কথা, পেনশনাররা সবাই আমার বাবার বয়সী এবং তাঁদেরকে সম্মান প্রদানের মধ্য দিয়ে আমি তৃপ্তি পাই। তাঁরা সন্তুষ্ট হলে আল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন। বেশি সময় না নিয়ে আমি তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে আমাদের প্রকাশিত ‘উদ্দীপন’ ও ‘বেলাশেষে’ বই প্রদান করলাম। আমি বললাম, অবসর গ্রহণের পরই এই কাজগুলো আমরা করেছি। তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আমি একটি ছবি নিতে চাইলে বিনয়ের সাথে বললেন, না বাবা থাক। পিয়নদের দেখিয়ে বললেন, যারা সরাসরি আপনাদের সেবা দান করছে তাদের ছবি নেন।

আমি বিদায় নিতে চাইলে তিনি বললেন, আমি গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছি বলে ড্রাইভারকে রেখে আসতে বলে আমার সাথে নিচে নেমে আসলেন। আমি তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি অভিভূত। আমার মতো আরো যারা সবার সাথে এমন মানবিক আচরণটাই করা হয়। আসতে আসতে লিফটের মধ্যে বললাম, আল্লাহপাক যে নেক আমলের কথা বলেছেন, আপনি যে আমাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করলেন তারই নাম নেক আমল।

কুরআন মজিদে আল্লাহপাক বারবার ঈমানের সাথে নেক আমলের কথা বলেছেন, নেক আমলের মধ্যে সর্বোত্তম আমল হলো মানুষের সাথে সদাচরণ ও সেবা প্রদান। আমি একটি হাদিস শোনালাম, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন (আল্লাহপাক) তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। গাড়িতে উঠার পর পরস্পর ইশারায় সালাম বিনিময়ের পর উনি উনার অফিসে ফিরে গেলেন এবং আমি রওনা হয়ে আসলাম। আজকের এই আতিথেয়তার কথা কোনদিন ভুল হবার নয়। আল্লাহপাক তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে নিজ রহমতের চাদরে আবৃত করে রাখুন।

গাড়িতে আসার সময় ড্রাইভারের সাথে একটু মতবিনিময় হলো। তার বাড়ি চট্টগ্রাম। তিনি তার বসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং বললেন, আমরা এমন অফিসার অতীতে কখনই পাইনি। তিনি তাঁর বসের জন্য আমার কাছে দোয়া চাইলেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম। স্ত্রী ও অধীনস্থদের নিকট থেকে ভালো সার্টিফিকেট পাওয়া বেশ কঠিন।

 ইউরোপ-আমেরিকায় সরকারি দপ্তরে উত্তম আচরণের কথা শুনি। সেখানে জনগণকে সেবা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তৃপ্ত হন কিন্তু আমাদের দেশে সেটি দুর্লভ। আমার স্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে এক রাত হাসপাতালে ছিলেন। কত সেবাযত্ন ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা। ডাক্তার সাহেবের আচরণে তিনি দারুণভাবে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ডাক্তার সাহেব তার পায়ের জুতাটা নিজ হাতে এনে পায়ের কাছে দিয়েছিলেন। এই যে মানবিক আচরণ আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি।

এত উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার বিনয় ও সদাচরণ সত্যিই প্রশংসনীয়। যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. একরাম আলী শেখ (মরহুম) একদিন আমার অফিসে এসেছিলেন। স্যার বলেছিলেন, অফিস প্রধান যদি সৎ হন তাহলে সেই অফিসের ৮০% মানুষ  স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৎ হয়ে যায় এবং ১০% লোকের পেছনে একটু তদারকি করতে হয়। আর বাকি ১০% লোক প্রকৃতিগতভাবে অসৎ এবং তাদের জন্যই শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হয়। আমরা দোয়া করি, আমাদের প্রতিটি অধিদপ্তরে জনাব মো. নূরুল ইসলামের মতো একজন কর্মকর্তা হোক যার মাধ্যমে জনগণ সেবা লাভে ধন্য হবে।

আল্লাহপাক সাত শ্রেণির লোককে হাশরের ময়দানে তাঁর আরশের নিচে স্থান দিবেন। তার মধ্যে ন্যায়পরায়ণ শাসক। শাসক বলতে একক ব্যক্তি নয় বরং শাসক শ্রেণি যারা ক্ষমতা পেয়ে মানুষের সাথে ইনসাফ করে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। আল্লাহপাক বারবার ঈমানের সাথে নেক আমলের কথা বলেছেন। নেক আমল অত্যন্ত বিস্তৃত। মানবকল্যাণে সকল কাজই নেক আমল। ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ ব্যক্তি জান্নাতের প্রত্যাশা করতেই পারে। আমরা দোয়া করি, সিজিএ জনাব মো. নূরুল ইসলামসহ সরকারি দপ্তরে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে যারা দায়িত্ব পালন করছেন আল্লাহপাক তাদের সবাইকে কবুল করুন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমিন। ১৭.০৫.২০২৩

Comments