আমরা চেষ্টা করি সপ্তাহে একদিন পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে একটু বসতে। সবসময় হয়ে ওঠে না। সেখানে কুরআন থেকে আলোচনা, হাদিস পাঠ ইত্যাদি হয়ে থাকে। আজকে ছিলাম তিন জন। আমি সুরা মুদ্দাসিসর প্রথম সাতটি আয়াত আলোচনা করি এবং ছেলে চারটি হাদিস ও তার মা একটি হাদিস আলোচনা করে। আমি এর মধ্য থেকে ফেসবুক বন্ধুদের জন্য সংক্ষেপে পবিত্রতা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
পঠিত আয়াতের সরল অর্থ-
হে কম্বল আবৃত, ওঠো এবং মানুষকে সাবধান করো, তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, তোমার পোশাক আশাক পবিত্র করো এবং মলিনতা ও অপবিত্রতা পরিহার করো, কখনো বেশি পাওয়ার লোভে কাউকে কিছু দান করো না, তোমার রবের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করো।
আমরা জানি সুরা আলাকের পাঁচটি আয়াতের মধ্য দিয়ে রসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর ওহি অবতীর্ণ শুরু। তারপর বেশ বিরতি দিয়ে সুরা মুদ্দাসিসর প্রথম সাতটি আয়াত নাজিল হয়। এর মধ্য দিয়ে রসুলুল্লাহ সা.-এর দায়িত্ব বলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ বড়ো গাফেল অবস্থায় আছে এবং তাদের সতর্ক করতে হবে। আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বলতে হবে আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি সবার উপরে এবং সেভাবেই তাঁকে জানতে হবে ও মানতে হবে। রসুল সা. তাঁর জাতির কাছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর আহবানই পেশ করেছিলেন।
তৎকালীন সমাজে ধার্মিকতা মানেই অপবিত্র- অপরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় ও উসকো-খুসকো চুল এমন একটা চেহারা মনে করা হতো। আজও মাজারকেন্দ্রিক যে ধার্মিকতার চর্চা তাতে সেটিই পরিলক্ষিত হয়। সুন্দর পোশাক আশাক ও পরিপাটি জীবন যাপনকে মানুষ দুনিয়াদারী বলে মনে করে। আর আল্লাহ তায়ালা নবুওয়তের সূচনাতেই রসুল সা.-কে নিজের পোশাক- পরিচ্ছদ পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং সবধরনের মলিনতা পুঁতিগন্ধময়তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে নির্দেশ প্রদান করেন।
আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারা ২২২ নং আয়াতে বলেছেন, আল্লাহ তওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন। রসুলুল্লাহ সা. পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধেক বলেছেন। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র শুরু করা হয় তাহারাত দিয়ে। পবিত্রতা ছাড়া একজন মুসলমান নিজেকে কল্পনাও করতে পারে না।
ইসলামে পরিচ্ছন্ন ও উত্তম পোশাক পরিধানে উৎসাহ যোগানো হয়েছে এবং পরিপাটি থাকার কথা বলা হয়েছে। একজন সাহাবিকে উসকো- খুসকো ও এলোমেলো চুলে দেখে রসুলুল্লাহ সা. তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সে পরিপাটি হয়ে আসলে রসুল সা. বলেন, এলোমেলো চুলে শয়তানের বেশে না এসে পরিপাটি হয়ে আসায় সুন্দর হয়েছে না? আর্থিক সামর্থ্য তার পোশাক আশাকে প্রকাশে কোনো দোষ নেই। তবে বাহুল্য বা অপচয় নিন্দনীয়।
পোশাক দেখে মানুষকে বোঝা যায়। অহংকারী না কৃপণ না ভবঘুরে ব্যক্তির পোশাক তা প্রকাশ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে পোশাক তাই যা লজ্জা নিবারণ করে ও সুন্দর দেখায়। অন্য ধর্মাবলম্বীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না, পুরুষের নারীর এবং নারীর পুরুষের মতো পোশাক হবে না। অহংকার প্রকাশক যেমন মাটি স্পর্শ করে (পুরুষের টাকনা পর্যন্ত) পরিধান করা যাবে না এবং অবশ্যই নারী ও পুরুষের সতর আবৃত হতে হবে। যে পোশাকে আল্লাহর ভয় প্রকাশ পায় সেটিই উত্তম। বয়স, পেশা, আবহাওয়া ইত্যাদি মানুষের পোশাকে ভিন্নতা আনতে পারে। তাতে কোনো দোষ নেই।
শুধু পোশাকের পবিত্রতাই নয়। অন্তর ও বাইরের সবধরনের মলিনতা ও পুঁতিগন্ধময়তা থেকে দূরে থাকতে হবে। মন থেকে শিরক-বিদয়াত, হিংসা- বিদ্বেষ, গিবত সবধরনের নোংরামী দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। উদারতা, ক্ষমাশীলতা মুমিনের বড়ো গুণ।
পবিত্রতা সম্পর্কে ইসলাম যে ধারণা পেশ করেছে তার থেকে বাড়াবাড়ি করে নিজের ওপর কাঠিন্য আরোপ করা ঠিক নয়। আমাদের দীন সহজ এবং আল্লাহ তায়ালা এই দীনের মাঝে কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি। মসজিদে নববিতে একজন বেদুইন পেশাব করলে সাহাবিরা তার দিকে ছুটে যায়। রসুল সা. থামিয়ে দিয়ে বলেন, এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তিনি আরো বলেন, তোমাদের তো সহজ করতে বলা হয়েছে। পানি সবকিছু পবিত্র করে দেয়। কোথাও কোনো অপবিত্রতা দেখা দিলে সেটা ধুয়ে ফেললেই মিটে যায়। বারবার ধোয়ার প্রয়োজন নেই। জুতায় নাপাকি লাগলে মাটির সাথে ডলা দিলেই পবিত্র হয়ে যায়। কাপড়ে নাপাকি লাগলে সেই অংশটুকু ধুয়ে দিলেই পাক হয়ে যায়।
কোনো কিছুর স্পর্শ কোনো কিছুকে অপবিত্র করে না। আমাদের মাঝে অনেকের বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস রয়েছে। এটা রোগ বা বাড়াবাড়ি। এমন আচরণ কাম্য নয়। অনেকের মধ্যে সন্দেহ কাজ করে। এই ওজু চলে গেল! বারবার ওজু করা একটা নিজের প্রতি অবিচার। বায়ু নিঃসরণ নিয়ে এমনটি মনে হয়। যতক্ষণ না গন্ধ বের হয় বা শব্দ না হয় ততক্ষণ ওজু যায় না। একদিন রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের সঙ্গে করে কোথাও যাচ্ছেন। পানির চৌবাচ্চার কাছে দাঁড়ালে একজন সাহাবি চৌবাচ্চার মালিককে বলছেন, তোমার চৌবাচ্চায় কি কোনো হিংস্র প্রাণী মুখ লাগিয়েছে? রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তুমি বলবে না, ও খুঁতখুঁতে স্বভাবের। আল্লাহর দীনের মাঝে কত প্রশস্ততা!
সবধরনের পানি পবিত্র। যদি পানিতে অপবিত্র কিছু পড়ে স্বাদ বা রঙের পরিবর্তন হয় সেটি ভিন্ন। কোনো কিছুর উচ্ছিষ্টও পবিত্র। কুকুর বা হিংস্র প্রাণী মুখ দিলে সেটি অপবিত্র। এমনকি কুকুর মুখ দিলে সেই পাত্র সাতবার ধোয়ার কথা বলা হয়েছে। বিড়াল কোনো কিছুতে মুখ দিলে বা পানি পান করলে তা অপবিত্র হয় না। মুসলিম অমুসলিম কোনো কিছু খেলে বা পান করলে তার বাকি অংশ পবিত্র এবং সেটি খেতে বা পান করতে কোনো দোষ নেই। অমুসলিমদের রান্না বা তাদের বাড়িতে খানাপিনা জায়েজ। কিন্তু তাদের জবেহ করা জিনিস খাওয়া যাবে না। কারণ জবেহ করার ক্ষেত্রে শর্ত হলো আল্লাহর নামে হতে হবে। অনেকে মনে করে বেনামাজির হাতে খেলে ইবাদত কবুল হয় না। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। দেখতে হবে যে খানা খাওয়া হচ্ছে সেটি হালাল কি না?
অতীতে মানুষ হালাল-হারাম, পবিত্র-অপবিত্রতা নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে নিজেদের জীবনকে সংকীর্ণ করে তুলেছিল। সবকিছুর মধ্যে হারাম বা অপবিত্রতা তালাশ করতো। আল্লাহ তায়ালা হারাম সুনির্দিষ্ট (শুকরের মাংস, প্রবাহিত রক্ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবেহ এবং এর সাথে হাদিসে বর্ণিত কিছু হিংস্র প্রাণী) করে বলেছেন, সকল পাক জিনিসই তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। আমাদের চিন্তা-ভাবনা এবং আচার-আচরণে উদার হতে হবে। সেটি সম্ভব হলে জীবনটা হবে সহজ ও আরামদায়ক। আল্লাহপাক আমাদের মাঝে প্রশস্ততা দান করুন। ১৮.০৫.২০২৩
Comments
Post a Comment