Skip to main content

গিবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য

 জুমার খুতবা

২১.১০.২০২২

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর সুরা ইবরাহিম ৩৪ নং আয়াত তেলাওয়াত করে বলেন, বান্দার জন্য আল্লাহর নেয়ামত অগণিত। আল্লাহর বাণী, ‘যিনি এমন সবকিছু তোমাদের দিয়েছেন যা তোমরা চেয়েছো। যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামতসমূহ গণনা করতে চাও তাহলে তাতে সক্ষম হবে না। আসলে মানুষ বড়ই বে-ইনসাফ ও অকৃতজ্ঞ।’ 

আমাদের শরীরটাই যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখবো সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিখুতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তন্মধ্যে মানুষের জবান অন্যতম। কথা বলা বা নিজের ভাবনা প্রকাশের কারণে মানুষ সকল সৃষ্টির সেরা। আল্লাহপাকের নেয়ামতসমূহের মধ্যে জিহবা সেরা নেয়ামত এবং সেটিংটাও চমৎকার। মানুষের চেহারা সমগ্র শরীরের মাঝে সর্বোত্তম অংশ এবং চেহারার মধ্যে রয়েছে মুখ। মুখের ভেতরে রয়েছে জিহবা যা ৩২টি দাঁতের মাধ্যমে সুরক্ষা দান করা হয়েছে। এই জবান বা জিহবা দ্বারা যদি ভালো কিছু প্রকাশ করা হয় তাহলে মানুষ প্রশংসিত হয়। পক্ষান্তরে মন্দ কিছু বলা হলে মানুষ হয় তিরস্কৃত।

এই জিহবার রয়েছে ভয়ঙ্কর ক্ষমতা। তলোয়ারের চেয়েও জিহবা ধারালো। কথার দ্বারা মুহূর্তেই মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করা যায়। তলোয়ারের আঘাত চিকিৎসায় দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে কিন্তু জবানের আঘাত থেকে সহজে নিরাময় সম্ভব নয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কেউ যদি আমাকে দুই ঠোঁটের মাঝখান ও দুই রানের মাঝখানের হেফাজতের নিশ্চয়তা দিতে পারে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হয়ে যাবো। আমাদের দেশে জিহবার আক্রমণ বড়ো ভয়াবহ। সর্বত্র গিবত সেকায়াত, মানুষের দোষ অন্বেষণ মহামারি রূপ নিয়েছে। পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে মসজিদ, অফিস- আদালত সবখানে গিবতের চর্চা। গিবত যেন পরিণত হয়েছে ঘিভাতে। ঘিভাতের মতো মানুষ গিবতে খুব মজা পায়। অথচ এটি যে কতো ভয়াবহ অপরাধ মানুষ সেটি একটুও খেয়াল করে না। আল্লাহপাক গিবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গুনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুলকারী এবং দয়ালু’- আল হুজুরাত ১২।

রসুলুল্লাহ সা. মিরাজের রাতের বর্ণনা দানের সময় বলেন, জিবরাইল আ.-এর সাথে চলার সময় একদল লোককে দেখলাম, তারা তামার নখের দ্বারা তাদের চেহারা ও শরীরের গোশত খামচায়ে ক্ষত-বিক্ষত করছে। জিবরাইল আ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে বললেন, এরা তারা যারা মরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করতো অর্থাৎ যারা মানুষের গিবত করতো। মরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করা খুবই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়, আল্লাহর ভাষায়- ‘তোমরা কেউ পছন্দ করবে না এবং তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়’। মুফাস্সিরদের মতে, মৃত মানুষের গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করার মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে মৃত মানুষের শরীর থেকে গোশত কেটে ভক্ষণ করায় মৃত ব্যক্তির বাধা দেয়ার যেমন ক্ষমতা থাকে না তেমনি গিবত হলো অসাক্ষাতে কারো নিন্দা করা, অনুপস্থিতির কারণে যার গিবত করা হয় তার আপত্তি জানানো বা বাধা দেয়ার কোনো ক্ষমতা থাকে না।

গিবত প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম রা. রসুলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞাসা করেছেন, কারো মধ্যে দোষ থাকলেও কি গিবত হবে? জবাবে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কারো মধ্যে দোষ থাকা সত্ত্বেও তার অসাক্ষাতে বলা হলে সেটি হবে গিবত এবং দোষ না থাকা অবস্থায় কারো প্রতি মিথ্যা দোষারোপ সেটি ভয়াবহ অপরাধ এবং সেটিকে বলা হয় অপবাদ। মানুষের সমাজে জেনা-ব্যভিচার খুবই ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক কাজ এবং সব ধর্মেই সেটিকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, গিবত জেনা অপেক্ষাও জঘন্য। শয়তানের প্ররোচনায় কেউ কখনো জেনা করে বসলে সে খুব লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং একসময়ে সে আল্লাহর কাছে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে। গিবত আমাদের সমাজে ডালভাতের মতো। এই গিবতের কারণেই আমাদের সমাজে এতো হানাহানি ও দলাদলি। গিবত যে গুনাহ সেই উপলব্ধি না থাকায় গিবত থেকে তওবা করা এবং যার গিবত করা হয়েছে তার কাছ থেকে মাফ চাওয়া হয়ে উঠে না। কোনো প্রকৃত মুসলিম অসাক্ষাতে তার ভাইয়ের দোষ চর্চা করতে পারে না। মুসলমান তো পরস্পর ভাই, একে অপরের আয়না সদৃশ। আয়না সামনে ধরলে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে দেয়। ত্রুটি মুছে ফেললে আর আয়নায় সেটি দেখা যায় না আবার আয়না সরিয়ে ফেললেও কোনো দোষ-ত্রুটি আর প্রদর্শন করে না। মুসলমান তার ভাইয়ের মাঝে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলে সে দরদের সাথে তা ধরিয়ে দেয় এবং যার দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দেয় সে তার ভাইকে কল্যাণকামী হিসেবেই জানে।

একদিন রসুলুল্লাহ সা. সাহাবয়ে কেরামকে বললেন, তোমরা কি জানো, তোমাদের মধ্যে হতদরিদ্র কে? স্বাভাবিকভাবে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, যার টাকা- পয়সা বা স্বর্ণ-রৌপ্য নেই সেই দরিদ্র। রসুলুল্লাহ সা. বললেন, না- দরিদ্র সে নয় বরং দরিদ্র সে যার নামাজ- রোজা-হজ-জাকাত ও দান-সাদাকার মতো প্রচুর নেক আমল রয়েছে এবং সাথে সাথে সে মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে, গিবত করেছে, খেয়ানত করেছে ও নানাভাবে জুলুম করেছে। কিয়ামতের দিন পাহাড় পরিমাণ নেকি নিয়ে সে উপস্থিত হলেও তার অনেক পাওনাদার হাজির হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে সে কাউকে চড়-থাপ্পড় মেরেছে, গিবত করেছে, ওজনে কম দিয়েছে, ভেজাল দিয়েছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে অর্থাৎ নানাভাবে মানুষের প্রতি জুলুম করেছে। সেদিন কারো টাকা-পয়সা থাকবে না বরং মহান আল্লাহ তায়ালা জালেমের নেক আমলের বিনিময়ে মজলুমের পাওনা পরিশোধ করবেন। তা দিয়ে পরিশোধ না হলে মজলুমের গুনাহ জালেমের আমলনামায় চাপিয়ে দিয়ে জালেমকে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

দুনিয়ায় থাকতেই জালেমের উচিৎ মজলুমের পাওনা পরিশোধ করে দেয়া বা ক্ষমা চেয়ে নেয়া। যার গিবত করা হয়েছে তাকে বলা- ভাই, সেসময়ে তো এতো বুঝিনি আমি অমুকের কাছে তোমার নিন্দা করেছি, তুমি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও। কাজটি যদিও কঠিন কিন্তু পরকালে জাহান্নামের আগুনের ভয় যাদের আছে তাদের কাছে কঠিন হওয়ার কথা নয়। আর যদি সম্ভব না হয় তাহলে যাদের কাছে নিন্দা করা হয়েছে তাদের সম্মুখে বলা যে, ভাই সেদিনে অমুখের যে দোষের কথা আপনাদের সম্মুখে বলেছিলাম তা সঠিক নয়, আমি অন্যায় করেছি, উনি বড়ো ভালো মানুষ। জুলুমের বদলা এ দুনিয়ায় প্রদান সম্ভব না হলে জালেমের উচিৎ সর্বদা আল্লাহর দরবারে তওবা করা ও মজলুমের মাগফেরাত কামনা করা এবং তার জন্য নফল নামাজ-রোজা ও দান-সদকা করা। এর বিনিময়ে হয়তো আল্লাহপাক জালেমকে ক্ষমা করবেন। 

গুনাহ নিয়ে হতাশ না হওয়ার জন্য আল্লাহ বলেছেন। পাহাড় পরিমাণ গুনাহ করার কারণে বান্দা যদি যথার্থই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং গুনাহ থেকে যথার্থই ফিরে আসে তাহলে আল্লাহ আকাশ ছোঁয়া রহমত নিয়ে বান্দার সম্মুখে হাজির হবেন। বান্দার গুনাহ তো ক্ষমা করবেনই পূর্বের পাপকেও নেকি দ্বারা বদলিয়ে দিবেন। গুনাহের কথা স্মরণ করে বান্দা যতবার অনুতপ্ত হবে ততবার আল্লাহ তাকে নেকি দান করবেন।

খতিব মহোদয় দীর্ঘ আট বছর মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মানুষ, তাঁরও দোষ-ত্রুটি হয়েছে। তিনিও গিবতের মতো অপরাধ করতে পারেন। মসজিদে হয়তো ৩/৪ হাজার মুসল্লি রয়েছে। তিনি তাঁর কার্যক্রমের জন্য নিজের ও মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে সবার কাছে ক্ষমা চান এবং তিনি বলেন, আমিও আপনাদের কারো প্রতি ক্ষোভ বা বিদ্বেষ পোষণ করছি না এবং সবাইকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমরা যদি পরস্পরকে ক্ষমা করে দিতে পারি তাহলে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি হতে রেহাই পাবো। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে তাঁর নেক বান্দাদের দলভুক্ত করুন। আমিন। সংক্ষেপিত।

Comments