আজ ১২ই রবিউল আউয়াল। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে ঈদে মিলাদুন্নবি সা.। আজ সরকারি ছুটির দিন। আমাদের সময়ে স্কুল-কলেজে ঘটা করে অনুষ্ঠিত হতো বার্ষিক মিলাদ অনুষ্ঠান। দেশের সর্বত্র মিলাদের ধুম পড়ে যেত। সাধারণের মাঝে আগের মতো সেই আবেদন না থাকলেও একটি বিশেষ মহলের মাঝে এই দিনটি উদযাপিত হয় ঈদের মতো মহা আনন্দের সাথে। সকাল দশটার দিকে মিরপুর এক নম্বরে জোসনে জৌলুস নাম দিয়ে ট্রাক ও মটর সাইকেলসহ বিশাল মিছিল লক্ষ করলাম। রঙ বেরঙের ব্যানার ফেস্টুন ছিল। বেশ জাকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা হলো।
১২ রবিউল আউয়াল রসুলুল্লাহ সা.-এর জন্মদিন নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এদিনে যে তিনি মারা গেছেন সেটির ব্যাপারে কারো মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। এই দিনটি সাহাবায়ে কেরামদের রা. কাছে কেমন ছিল একটু কল্পনা করুন। আজ মর্নিং ওয়াকে কয়েক বন্ধুর মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে একজন বলছিলেন, রসুল সা.-এর আগমনের দিন মদিনা ছিল উৎসবমুখর, আর যেদিন তিনি ইন্তেকাল করেন সেদিনে যেন মদিনায় কিয়ামত সংঘটিত হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম চরমভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কঠোর হৃদয়ের অধিকারী বলে যাকে মনে করা হয় সেই ওমর রা. রসুল সা.-এর মৃত্যুকে যেন মেনেই নিতে পারছিলেন না। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘যে বলবে, মুহাম্মদ সা. মারা গেছেন আমি তাকে তরবারি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করবো।’ আবু বকর রা. শান্তকণ্ঠে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বললেন, ‘মুহাম্মদ একজন রসুল বৈ আর কেউ নন, তার পূর্বে অনেক রসুল গত হয়েছে। যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা উল্টা দিকে ফিরে যাবে? মনে রেখ, যারা ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না’। তিনি বললেন, যারা মুহাম্মদের পুজারি তারা বুঝুক মুহাম্মদ সা. মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহর পুজারি (ইবাদতকারী) তারা জানুক, আল্লাহ অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব। ওমর রা. দ্রুতই সম্বিত ফিরে পেলেন। আর পাবেনই বা না কেন? তিনি তো ফারুক, সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী। আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর কথায় তাৎক্ষণিক সাড়া দানকারীদের একজন।
১২ রবিউল আউয়াল সাহাবায়ে কেরামদের জন্য কখনই উৎসবের দিন ছিল না এবং সেটি হতেও পারে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, যারা পালন করে তারা তো জন্মদিন হিসেবে পালন করেন। জন্মদিনই যদি পালন করতে হয় তাহলে সেটি পালনের সুযোগ স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনে তো ছিল। মদিনায় দশটি বছর তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান ছিলেন। কিন্তু তিনি তা পালন করেননি। শুকরিয়াস্বরূপ তিনি তাঁর জন্মদিন সোমবারে রোজা রাখতেন। আল্লাহপাক তাঁর রসুলের মাধ্যমে দীনের পূর্ণতা দান করেছেন। কোনো কিছু তিনি গোপন করে যাননি যা পরবর্তীকালে তাঁর কোনো উম্মত চালু করে গোপন করার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কোনো মুর্খের মাঝে যদি এরকম চেতনা জাগ্রত হয় তবে সেটি হবে তার জন্য বড়ো বদনসিব এবং সে হবে কপালপোড়া। এই বিদয়াত চালু করে রসুল সা. থেকে সে কেবল দূরত্বই বাড়াবে না বরং নিজেকে জাহান্নামেই নিক্ষেপ করবে।
প্রত্যেক জাতির মাঝে আনন্দোৎসব রয়েছে। আমরা তার ব্যতিক্রম নই। সেই উৎসব আমাদের দীনেরই অংশ। রসুলুল্লাহ সা. দুটি উৎসব- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর উৎসব তাদের ধর্মগুরুদের সাথে সংশ্লিষ্ট। বড়দিন পালিত হয় হজরত ইসা আ.-এর জন্মকে কেন্দ্র করে। আবার হিন্দুদের জন্মাষ্টমী (শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন) ও গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন উপলক্ষে বৌদ্ধরা পালন করে বৌদ্ধপুর্ণিমা। ব্যক্তিপূজা ও সৃষ্টিপূজা ইসলামে নেই। ইসলামে শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মহানত্ব সবই আল্লাহর (আল্লাহু আকবার)। কুরআন মজিদ খুলে যে শব্দটি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়, সেটি হলো ‘আলহামদু লিল্লাহ’। প্রশংসা আল্লাহর নয়, সকল প্রশংসা আল্লাহর। মাত্র ২৩ বছরে দীন বিজয়ের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধনের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে সুরা নসরে ঘোষণা আসলো, যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলো আর লোকে দলে দলে আল্লাহর দীনের মধ্যে শামিল হলো। এ বিজয় নবি মুহাম্মদ সা.-এর ক্রেডিট নয়, সকল ক্রেডিট মহান আল্লাহর। আর আল্লাহ রসুল সা.- কে শিখিয়েও দিলেন, তোমার রবের প্রশংসা করো এবং তার কাছে মাফ চাও। প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. নিজে আল্লাহর প্রশংসা উচ্চারণের পাশাপাশি তাঁর উম্মতকেও শিখিয়ে দিয়েছেন। তাই কখনো ছুবহান আল্লাহ, কখনো আলহামদু লিল্লাহ, কখনো আল্লাহু আকবার- সর্বদা আল্লাহর প্রশংসায় জিহবা সিক্ত এবং হৃদয় প্রশান্ত থাকে।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহর সাথে সাথে তাদের ধর্মগুরুদেরও শরীক বানিয়ে নিয়েছে। মুহাম্মদ সা. তাঁকে নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি না করা হয় সেজন্য অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই তাঁকে নিয়ে কোনো উৎসব নেই। তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী পাঠ করেন এবং ঈমানদারদের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ আল্লাহ তায়ালাই প্রদান করেছেন। আজানে রসুল সা.-এর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, প্রতি নামাজে তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ এবং নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দরুদ পাঠের তাগিদ রয়েছে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রসুলের অনুসরণ ফরজ করেছেন। নিজের ব্যক্তিসত্তা, সন্তান-সন্ততি, ধন- সম্পদ সবকিছু অপেক্ষা রসুলের সা. প্রতি মুহাব্বাত ও ভালোবাসা পূর্ণ মুমিনের পরিচায়ক। মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের প্রক্রিয়াও স্বয়ং রসুল সা. আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। ‘যার সম্মুখে আমার নাম উচ্চারিত হলো অথচ দরুদ পড়লো না, সে যেন ধ্বংস হয়’- এতো আল্লাহর রসুল সা.-এরই কথা। কাজে-কর্মে, চলা-ফেরায়, চিন্তা-চেতনায়, আচার-আচরণে, লেন- দেনে সর্বাবস্থায় রসুল আমাদের আদর্শ- আল্লাহ ও রসুল সা.-এর কথা উচ্চারিত হলে আমাদের একটিই কথা- আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের এই বিশেষ দিনে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? না, ইবাদত হিসেবে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। ইবাদত তখনই হবে যখন সেটি রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক সমর্থিত হবে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া বাজারে জাল টাকা যতই চকচক করুক সেটি মূল্যহীন এবং ধরা পড়লেই শ্রীঘরে স্থান গ্রহণ করতে হবে। তাই কোনো কিছু যতই আবেগভরা ও ধার্মিকতার লেবাস পরিহিত হোক তা যদি রসুল সা. সমর্থিত পন্থায় না হয় তাহলে সেটি বিদয়াত। তবে রসুল সা.-এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সর্বদা তাঁকে নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি ও শিশু-কিশোরদের নিয়ে নানা রকম প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান করা যেতে পারে এবং শিক্ষা উদ্দেশ্যে সব ধরনের আয়োজনে সওয়াব রয়েছে যদি সেখানে শরিয়তের কোনো বিধানের লঙ্ঘন না হয়।
আমাদের কাছে একথা স্পষ্ট যে, মুসলমানদের জীবনে ঈদ মাত্রই দু’টি। তৃতীয় ঈদ উদ্ভাবন করা সুস্পষ্ট বিদয়াত অর্থাৎ গোমরাহী। রসুলুল্লাহ সা. জন্মের দিন শুকরিয়াস্বরূপ বড়জোর রোজা পালন করা যেতে পারে। আর ঈদের দিন কোনো রোজা নেই। উম্মাহর এক অতি ক্ষুদ্র অংশ ১২ রবিউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে রসুলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের নামে বাড়াবাড়ি করছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে রসুল সা.-এর একনিষ্ঠ অনুসরণের উপর নির্ভর করে ভালোবাসা। আল্লাহর বাণী, ‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন’- আলে ইমরান ৩১। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে রসুল সা.-কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের তৌফিক দান করুন। আমিন। ০৯.১০.২২
Comments
Post a Comment