আল্লাহপাকের অপূর্ব সৃষ্টি নর ও নারী- প্রতিটি জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং পরস্পর পরিপূরক করেছেন। আল্লাহ নর ও নারীকে স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, পৃথক মন-মেজাজ, পছন্দ, ঝোঁকপ্রবণতা দান করেছেন এবং নারীকে অপেক্ষাকৃত কোমল হৃদয় ও দুর্বল শারীরিক শক্তি দিয়েছেন। নারীর প্রকৃত কর্মক্ষেত্র তার ঘর। সন্তান গর্ভে ধারণ, জন্মদান, লালন-পালন ও শিক্ষাদান- মা হিসেবে নারীর অনন্য অবদান এবং এ কারণেই পুরুষকে নারীর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকা উচিত। নর ও নারীর প্রতি পরস্পর আকর্ষণ আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত (প্রকৃতিগত)। এই আকর্ষণের কারণেই নারী প্রতিনিয়ত পুরুষ কর্তৃক নানাভাবে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরস্পর থেকে সুখ ও তৃপ্তি লাভের লক্ষ্যেই আল্লাহপাক নর ও নারীর মাঝে বিবাহের প্রচলন করেছেন। বিবাহ বহির্ভূত নর ও নারীর একত্র জীবন- যাপনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এমন কিছু ঘটলে সেটি ঘৃণ্য ও অপরাধ।
পর্দা নর ও নারী উভয়ের জন্য। আমি ইতোপূর্বে কিছুটা আলোচনা করেছি। পর্দা প্রসঙ্গে সুরা আহজাবে ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, যে সব নারী পর্দা মেনে ঘর থেকে বের হয় তারা সম্ভ্রান্ত এবং তাদেরকে উত্যক্ত করা হয় না। আল্লাহপাক পর্দানশীন নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করেছেন। আমি পর্দা নিয়ে ফেসবুকে মাঝে-মধ্যেই লিখবো ইনশা-আল্লাহ। পরবর্তী সময়ে একটি ছোট্ট পুস্তিকা প্রকাশেরও খেয়াল আছে। সুরা নুরের ৩০ নং আয়াতে পুরুষকে দৃষ্টি নিম্নগামী করার কথা বলা হয়েছে এবং ৩১ নং আয়াত পুরোটাই নারীকে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে আমি যুক্তিতর্কে না গিয়ে যারা পরকাল বিশ্বাস করে ও ইসলামকে মেনে চলে এবং জান্নাতের প্রত্যাশী তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর বিধান তুলে ধরতে চাই। আল্লাহপাক পরিপূর্ণ পর্দার বিধান ফরজ করেন মদিনায় ৫ম হিজরিতে সুরা নুর ও আহজাবে (২৪তম সুরা নুর ২৭-৩১, ৫৮-৬০ এবং ৩৩তম সুরা আহজাব ৫৩-৫৫, ৫৯)। বান্দার মধ্যে আল্লাহর বিধান মেনে চলার মতো মনমানসিকতা প্রস্তুত করার জন্য তিনি সুদীর্ঘ ১৮টি বছর অপেক্ষা করেছেন। যে রাতে পর্দার বিধান ফরজ করা হয় পরের দিন ফজরে মহিলা সাহাবিগণ মোটা ওড়না দ্বারা আবৃত হয়ে মসজিদে হাজির হন।
আল্লাহপাক তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি নারীর মাঝে সকল সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন এবং এই সৌন্দর্যই পুরুষের জন্য ফেতনা হয়ে দেখা দেয়। এই ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই দৃষ্টি সংযত ও পর্দা মেনে বের হওয়ার জন্য বলেছেন। নারী ও পুরুষকে লজ্জাস্থান হেফাজত করার কথা বলা হয়েছে। পুরুষের লজ্জাস্থান (সতর) হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত এবং নারীর লজ্জাস্থান (সতর) হলো মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা ছাড়া সমগ্র শরীর। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো সতর নেই। অবশ্য এই সতরের সীমারেখা মাহরাম ও গাইর মাহরামের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। মাহরাম বলতে বোঝায় যাদের সাথে বিবাহ হারাম। আল্লাহপাক নারীর সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি সীমারেখা দাঁড় করেছেন। যাদের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে সুরা নুর ৩১ নং আয়াতে তার একটি তালিকা প্রদান করা হয়েছে।
‘হে নবি, তুমি মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বেড়ায়, তবে তার শরীরের যে অংশ এমনিই খোলা থাকে (তার কথা আলাদা), তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশের ওপর দিয়ে রাখে, তারা যেন তাদের স্বামী, তাদের পিতা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর (আগের ঘরের) ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে, তাদের বোনের ছেলে, তাদের (সচরাচর মেলামেশার) মহিলা, নিজেদের অধিকারভুক্ত সেবিকা দাসী, নিজেদের অধীনস্থ (এমন) পুরুষ যাদের (মহিলাদের কাছ থেকে) কোনো কিছু কামনা করার নেই, কিংবা এমন শিশু যারা এখনো মহিলাদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে কিছুই জানে না-(এসব মানুষ ছাড়া তারা যেন) অন্য কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, (চলার সময়) জমিনের ওপর তারা যেন এমনভাবে নিজেদের পা না রাখে- যে সৌন্দর্য তারা গোপন করে রেখেছিল তা (পায়ের আওয়াজে) লোকদের জানাজানি হয়ে যায়; হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, (আগের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য) তোমরা সবাই আল্লাহর দরবারে তওবা করো, আশা করা যায় তোমরা নাজাত পেয়ে যাবে’- সুরা নুর ৩১।
তালিকা প্রকাশের পর আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন যে, এর বাইরে যেন নারীরা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু প্রকাশ করা যাবে। সতরের সীমারেখা গাইরি মাহরাম থেকে মাহরামের একটু ভিন্ন। মাহরামের সম্মুখে একজন নারী তার মাথা, চুল, কান, চেহারা, গর্দান, হাত, পা, টাখনু খোলা রাখতে পারে। আর গাইরি মাহরামের সম্মুখে মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা ছাড়া পুরো শরীর সতর। এই বিধান দেয়ার সাথে সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, পূর্বে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে গেছে তার জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করলে আশা করা যায় তারা নাজাত পাবে। এখনো যেসব মহিলা নানা কারণে পর্দা মানতে পারছে না তারা আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরে আসলে আশা করা যায় তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করবেন। ফেসবুকে অনেক মহিলা তাদের নিজেদের ছবি ও অন্যদের ছবি পোস্ট করে থাকেন এবং এটিও কবিরা গুনাহ।
পর্দার বিষয়টি অনেক ব্যাপক। কলেবর বেড়ে যাচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করবে এবং সেটি হবে অনেকখানি নিরাপদ। সবচেয়ে বড়ো আপত্তি নিভৃতে একজন নর ও নারীর একত্রে কাজ করা। যেমন, কোনো কর্মকর্তার পিএস নারী, এটি হবে অকল্পনীয়। রসুলুল্লাহ সা.-এর হাদিস অনুযায়ী এমতাবস্থায় তৃতীয় জন হবে শয়তান। ইসলাম নারীর জন্য স্বতন্ত্র কর্মপরিবেশ দাবি করে। একটি মুসলিম প্রধান দেশে পর্দার বিধান মানার ক্ষেত্রে চরম শৈথিল্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। এতে শুধু পর্দাহীন নারী-পুরুষই নয় তাদের অভিভাবকরাও গুনাহের শামিল হচ্ছে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্রী এবং ইসলামী সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক নারী শুধু সতর ঢেকে নয় নেকাব পরে চলাফেরা করে।জাহিলিয়াতের এই সমাজে আমাদের নারীদের জন্য পর্দা একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। আমার মনে হয় এর মাধ্যমে কেবল ফরজ পালনের সওয়াবই নয়, প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে চলার কারণে তারা জিহাদের সওয়াব লাভ করবে। প্রশ্ন হলো, শতকরা নব্বই জন নারী যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে, অফিস- আদালতে ও কলে-কারখানায় (বিশেষ করে গার্মেন্টসে) বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত তাদের মধ্যেও ইসলামের প্রতি দরদ রয়েছে, একটু পরিবেশ পেলেই তারা পর্দা মেনে চলবে ইনশা-আল্লাহ। আমরা তাদেরকে সতর আবৃত করে চলার জন্য অনুরোধ করি। হাতে গোণা স্বল্পসংখ্যক মহিলা ছাড়া অধিকাংশ মহিলার মাঝে আল্লাহ, রসুল ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস অনেক প্রবল। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। ১৪.১০.২০২২।
Comments
Post a Comment