ইসলাম আল্লাহপাক প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ ও তাঁর মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থা (কুরআনের ভাষায় আদ্ দীন)। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দীন বা জীবনবিধান হলো ইসলাম’- সুরা আলে ইমরান ১৯। শুধু মুহাম্মদ সা.-এর উপর অবতীর্ণ দীনই নয় সকল নবি-রসুলের দীন ছিল ইসলাম। শুধু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা নয়, অতীতকালেও বিভিন্ন দার্শনিকদের মাঝে যেসব কল্যাণচিন্তার উদ্ভব ঘটেছে তারও পেছনে রয়েছে আসমানি কিতাবের অবদান। মানবজীবনে ভালো ও মন্দ- দুটোর পেছনে রয়েছে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি। শয়তান মানুষের মধ্যে মন্দ কর্মপ্রেরণা যোগায় আর আল্লাহপাক যোগান কল্যাণচিন্তা। অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের পার্থক্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে তার স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা ও কর্ম করার শক্তি। মন্দ পরিহার করে ভালো করলে মানুষ পুরস্কৃত হবে এবং মন্দ করলে তিরস্কৃত হবে। ভালো-মন্দের মানদণ্ড হলো আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন, ইসলাম।
ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান সেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আল কুরআন ও রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনেই রয়েছে। না থাকলে তো আর পূর্ণাঙ্গ হয় না। আল্লাহর দাবি, দীন পরিপূর্ণ মানতে হবে। তাঁর বাণী, ‘তোমরা কি দ্বীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’- সুরা বাকারা ৮৫। ইসলাম মূলত একটি রাষ্ট্রীয় দীন। ইসলামকে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার মিশন দিয়েই আল্লাহপাক সর্বশেষ নবি ও রসুল মুহাম্মদ সা.-কে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তিনি তাঁর আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীন বা ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারেন, মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন’- সুরা সফ ৯। একই কথা সুরা তওবা (৩৩ নং আয়াত) ও ফাতাহ (২৮ নং আয়াত) একটু হেরফের করে বলেছেন। শুধু কি তাই? সকল নবি-রসুলের মিশনও ছিল একই। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সে বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নুহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি, উপরন্তু যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মুসা ও ইসাকে দিয়েছিলাম, তোমরা এ দীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’- সুরা আশ শূরা ১৩। দীন প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করেই সকল নবি-রসুলের সাথে সমসাময়িক শাসকগোষ্ঠীর সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এবং হক ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক দীন প্রতিষ্ঠার ফলেই আমাদের পক্ষে মুসলমান হওয়া সম্ভব হয়েছে।
দীন কায়েমের জন্য স্রেফ আকাঙ্ক্ষা নয়, প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। সংঘবদ্ধতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত আর মুসলমান না হয়ে মরো না। তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’- সুরা আলে ইমরান ১০২-১০৩। আমাদের মুসলমান হওয়া সংঘবদ্ধতার উপর নির্ভর করে। নবুয়ত লাভের পর মুহাম্মদ সা.-এর প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল মানুষকে দীনের পথে ডাকা এবং তাঁর ডাকে যারা সাড়া দিয়েছেন তাদেরকে সাথে নিয়ে এক মজবুত সংগঠন কায়েম করা। রসুলুল্লাহ সা.-এর নেতৃত্বে গঠিত সংগঠনের বাইরে কেউ আর নিজেকে মুসলিম দাবি করতে পারতো না এবং সে সুযোগও ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একাধিক সংগঠন থাকতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন উদ্দেশ্য হলে অবশ্যই বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সৌহার্দ্র-সম্প্রীতি থাকবে। যদি তা থাকে তাহলে বুঝতে হবে সবাই সত্যপন্থী এবং হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যথায় পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও দলাদলি সৃষ্টি করা সুস্পষ্ট কুফরি এবং এর পরিণতি ভয়াবহ। আল্লাহর ভাষায়, ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে। যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে, ইমানের নেয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো’- আলে ইমরান ১০৫-১০৬।
জমিনে ইমানদারদের কর্তৃত্ব প্রদান আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি। ইমানদারদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই মূলত দীন প্রতিষ্ঠা। আবু জেহেল-আবু লাহাবদের হাত থেকে সমাজের কর্তৃত্ব রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর অনুসারীদের হাতে চলে আসাটাই ছিল দীনের বিজয় এবং এর ফলে মানুষের পক্ষে পরিপূর্ণ দীন মানা সহজ হয়ে পড়েছিল। আর প্রকৃত বিষয় হলো, দীন প্রতিষ্ঠার পূর্বে আল্লাহপাক সেই দীনের শরিয়ত পুরোপুরি দান করেননি। ইসলামের অনুসারীদের মৌলিক কাজ হলো দীন কায়েমের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালানো। আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টাকারীদের সকল গুনাহের ক্ষমা এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়েরও ওয়াদা রয়েছে (সুরা সফ ১০-১৩)। দীনের বিজয়ের জন্য প্রয়োজন ইমানের সাথে নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়া। এই নেক আমল হলো আচার-আচরণ, লেনদেন ও ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ইমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নুর ৫৫।
এখন প্রশ্ন, দীন কায়েমের প্রক্রিয়া কী? যে কোনো আদর্শই প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সেই আদর্শের ব্যাপক প্রচার এবং তার ভিত্তিতে একদল যোগ্য নেতা ও কর্মী গঠন। সেই সাথে প্রয়োজন জনমত গঠন। ইসলাম এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। নবি হওয়ার পর রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রথম কাজ ছিল মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়েছেন তাদেরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন ও পরিশুদ্ধ করেছেন। জনমত অনুকূলে না হওয়ায় রসুলুল্লাহ সা.-এর সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহপাক মক্কায় দীনের প্রাথমিক বিজয় দান করেননি। কিন্তু মদিনার জনগণ ইসলামকে গ্রহণ করে নেয়ায় আল্লাহ তায়ালা দয়া করে মদিনায় সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় দান করেন। এটি স্পষ্ট, দীনের বিজয়ের জন্য আল্লাহর রসুল সা. কোনো বাঁকা পথ গ্রহণ করেননি। সন্ত্রাস বা জঙ্গি কার্যক্রম নয়, স্বাভাবিক পন্থায় দাওয়াত প্রদান, সংগঠন কায়েম, নেতৃত্ব ও কর্মী গঠন- এই ছিল তাঁর প্রক্রিয়া। মক্কায় দীর্ঘ তেরো বছর তিনি এবং তাঁর সাহাবিরা এক তরফা নির্যাতিত হয়েছেন; তাঁদের পক্ষ থেকে গোপনে বা প্রকাশ্যে পাল্টা আঘাত বা কোনো ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনাও ছিল না। শুধু মুহাম্মদ সা.-এর জীবনেই নয় কুরআনে বর্ণিত সকল নবি-রসুল ও ইমানদারদের আল্লাহপাক জুলুমের শিকার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে দীন কায়েমের মিশন দিয়েই পাঠিয়েছেন এবং দীন কায়েমের প্রক্রিয়াও সকলের এক ছিল। অর্থাৎ দীনের দাওয়াত দান, তাদেরকে সংগঠিত ও পরিশুদ্ধ করা। নবি-রসুল আল্লাহপাক কর্তৃক নিযুক্ত এবং নবির উপর ইমান আনার সাথে সাথে শর্তহীন আনুগত্য ইমানদারদের জন্য ফরজ। নবি-রসুলের জীবিত অবস্থায় কোনো বিকল্প নেতৃত্ব নেই এবং সেক্ষেত্রে নবি-রসুলের একক নেতৃত্ব। রসুলের অনুপস্থিতিতে পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন পরামর্শের ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়েছে। মুমিন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘যারা নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’- সুরা শুরা ৩৮। রসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের পর খলিফা নির্বাচন পরামর্শের ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়েছিল। যেখানেই সামষ্টিক স্বার্থ রয়েছে সেখানেই পরামর্শ। রসুল সা. আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত হওয়ার পরও আল্লাহ তাঁর নবিকে বিভিন্ন পরামর্শে তাঁর সাহাবিদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘(হে নবি!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো। তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করো এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করো। তারপর যখন কোনো মতের ভিত্তিতে তোমার স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো। আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর উপর ভরসা করে’- সুরা আলে ইমরান ১৫৯।
সামষ্টিক বিষয় বিশেষ করে শাসক নির্বাচিত হবে অবশ্যই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। রাজতন্ত্র, বন্ধুকের নল বা জোর-জুলুম করে শাসক হওয়ার কোনো সুযোগ আল্লাহর বিধানে নেই। রসুলুল্লাহ সা.- এর ইন্তেকালের পরে কে খলিফা হবে তা স্পষ্ট করতে রসুলুল্লাহ সা. পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। খলিফা নির্বাচন কম গুরুত্বপূর্ণ সেটিও ছিল না। তাই সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়তম নবি সা.-এর দাফন- কাফনের চেয়ে তাঁদের নেতৃত্ব নির্বাচনকে বড়ো করে দেখেছেন। পরবর্তী খলিফারাও কাউকে মনোনীত না করে উম্মাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমান গণতন্ত্রের সাথে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ছাড়া ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ যেটা পছন্দ করে সেটিই আইন। পক্ষান্তরে ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং আইনের উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। শতভাগ মানুষের রায় যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর নিয়ম বহির্ভূত হয় তাহলেও সেটি অগ্রাহ্য হবে। কুরআন ও সুন্নাহর অধীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে। কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয় অধিকাংশের মতই পালনযোগ্য এবং এক্ষেত্রে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মাঝে কোনো বিরোধ নেই।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শভিত্তিক ব্যবস্থা বা গণতন্ত্র সর্বোত্তম। গণতন্ত্র বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হবে এবং দেশ পরিচালিত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর দেয়া নির্দেশনার (যারা নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে) সাথে আব্রাহাম লিংকনের দেয়া সংজ্ঞার মধ্যে কোনো বিরোধ দেখি না 'Democracy is a government of the people, by the people and for the people' (গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার)। তাঁর আরো উক্তি, ‘ব্যালট বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী’ এবং ‘নির্বাচন জনগণের, এটা তাদের সিদ্ধান্ত’। জোর-জুলুম করে শাসন করার সুযোগ গণতন্ত্রে নেই।
ইউরোপ-আমেরিকার জনগণ তাদের দেশে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছে এবং উন্নয়নের পাশাপাশি সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানে কাউকে ইরানের শাহ, লিবিয়ার গাদ্দাফি বা ইরাকের সাদ্দামের মতো পরিণতি ভোগ করতে হয় না, আবার আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার মতো কোনো দেশ ও জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয় না। সেসব দেশে সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে হয় না। ইউরোপ-আমেরিকায় শক্তিশালী সেনাবাহিনী রয়েছে, কখনো শোনা যায় না, জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তাদেরকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। তাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনী রাজনীতিক সরকারের অধীন এবং আনুগত্য করতে বাধ্য। সম্প্রতি একটি বছরে বৃটেনে তিনজন প্রধানমন্ত্রী হলেন। সেখানে এসব পরিবর্তন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে অনিয়ম বা কারচুপি বা ভোট ডাকাতি তাদের কল্পনাতেও নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনাও নেই। কোথাও কোনো কিছু ঘটলে তার বিচার আছে। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে মানুষ ছুটছে সেসব দেশে। ইউরোপ-আমেরিকা কেন? পার্শ্ববর্তী ভারতেও স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাহত হয়নি। বহু ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর বিশাল দেশ টিকে আছে কেবল গণতন্ত্রের কারণে।
যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে সেসব দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দাওয়াত প্রদান ও জনমত গঠন সহজ হয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টারত সংগঠনসমূহ মানুষের সম্মুখে দীন কায়েমের কর্মপন্থা নিয়ে হাজির হবে এবং মানুষ যদি তাদেরকে যোগ্য বিবেচনা করে ভোট দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দান করে তাহলে সহজেই দীন কায়েম হওয়া সম্ভব। দীন কায়েম হওয়া মূলত নেতৃত্বের পরিবর্তন। প্রাথমিক শর্ত ইসলামের ভিত্তিতে একদল যোগ্য নেতা ও কর্মী গঠন এবং দ্বিতীয় শর্ত যে জনপদে দীন কায়েম করতে চায় তার জনগণ সক্রিয় বিরোধী না হয়ে সমর্থক হবে। এমন পরিবেশ তৈরী হলে আল্লাহপাক তাঁর একান্ত অনুগ্রহ, সেই জনপদে ইসলামের বিজয় দান করবেন।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে সেখানে দীনের দাওয়াতের মাধ্যমে একদল যোগ্য নেতা ও কর্মী বাহিনী গঠিত হলে গণ বিপ্লব সাধিত হতে পারে যেমনটি হয়েছিল ইরানে। তারপরও বৈধতা দানের জন্য সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং জনগণ ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পক্ষেই রায় দিয়েছিল। একথা বলা যায় মতামতের ভিত্তিতেই ইরানে ইসলামী শাসন কার্যকর রয়েছে। বর্তমানে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশসহ যেসব দেশে গণতন্ত্র চালু আছে সেসব দেশে ইসলামপন্থীদের উচিৎ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো। একজন মুসলমান সেই যে মনেপ্রাণে ইসলামকে সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা বিশ্বাস করে এবং সেটি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। ইসলামের যারা শত্রু তারা কখনই ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেবে না এবং তারা বিরোধীতা করবেই। যদি বিরোধীতা করে তাহলে বোঝা যাবে তারা নবি-রসুলদের মতো সঠিক তরিকায় রয়েছেন। একামতে দীনের বৈশিষ্ট্যই হলো কুফরি শক্তির বিরোধীতা (মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন’- সুরা সফ ৯) এবং বিরোধীতার মোকাবেলায় দীনের পথে অবিচল থাকতে পারলে সকল গুনাহের ক্ষমা এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে (সুরা সফ ১২)। অবশ্য খেদমতে দীনের বিনিময়েও জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। কুরআন মজিদে বিভিন্ন জায়গায় ইমানের সাথে নেক আমল করলে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। অবশ্য এমন অবস্থায় জান্নাত প্রাপ্তি বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দীন কায়েম না হলে পরিপূর্ণ ইসলাম মানা দুরূহ ব্যাপার। এজন্য দীন কায়েমে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও একটি কামনা- বাসনা থাকতেই হবে। এপ্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই। যে লোক মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু।
দীন কায়েমের পন্থা হিসেবে অনেকে কেতাল বা যুদ্ধের কথা বলে। তাদের মুখে উচ্চারিত হয়, গণতন্ত্র হারাম ও কুফরি মতবাদ এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এরাই মূলত সন্ত্রাসী বা জঙ্গি। এরা বিভ্রান্ত এবং ইসলামের দুশমনদের ক্রীড়নক। শান্তির ধর্ম ইসলামকে কলঙ্কিত করছে। আমার উপলব্ধি, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার নেই। এই অধিকার কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের। রসুলুল্লাহ সা. সুদীর্ঘ তেরো বছর মক্কায় একতরফা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনো সশস্ত্র আক্রমণ বা কাউকে হত্যা করার কোনো নজির নেই। যুদ্ধবিগ্রহ যা সবই মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে হয়েছে। কুরআন মজিদে যতো নবি-রসুলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেও তাঁদেরকে নির্যাতিত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে দীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখা ও পরম ধৈর্য অবলম্বনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এখনো যারা দীন কায়েম করতে চায় সমস্ত উস্কানি ও জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে নবি-রসুলদের পন্থায় মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে এবং নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। দীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্ত আল্লাহর এবং জমিনে যারা এই কাজ করে তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী। একামতে দীনের কাজের বিনিময়ে আল্লাহপাক তাদেরকে জান্নাত দান করবেন এবং আল্লাহর ভাষায় এটিই সবচেয়ে বড়ো সাফল্য (সুরা সফ ১২)। আরো দেবেন, যা আমরা পছন্দ করি, আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয় (সুরা সফ ১৩)। তাও আল্লাহ দেবেন এবং এটি অতিরিক্ত।
দীন প্রতিষ্ঠার কাজে মুমিনদের হারাবার কিছু নেই বা কোনো পরাজয় নেই। রয়েছে জান্নাতের গ্যারান্টি। প্রয়োজন শুধু খুলুছিয়াত। সকল কর্মতৎপরতার মূলে থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁরই উপর নির্ভরতা। আল্লাহপাক আমাদের মাঝে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দান করুন এবং সকল প্রতিকূল অবস্থায় অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন। ২৬.১০.২০২২।
Comments
Post a Comment