রাইনখোলা জামে মসজিদে সিরাত আলোচনা
ঢাকায় আসার পর সেই ২০১২ সাল থেকে দীর্ঘদিন রাইনখোলায় ছেলের বাসায় থাকতাম। সেই বাসাটি ছিল দুই রুমের ছোট্ট বাসা। বাসার মালিকসহ প্রতিবেশী অনেকের সাথে ছিল দারুণ সখ্যতা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমা আদায় করতাম রাইনখোলা জামে মসজিদে। মসজিদের খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের সাথে ছিল মুহাব্বতের সম্পর্ক। আর আমি আমার বিশ্বাস থেকে আলেমদের ভালোবাসি। আলেমরা হলেন নবি-রসুলদের উত্তরাধিকার। মসজিদ মিশনের দায়িত্ব পালনের কারণে আমার কাজ ছিল মসজিদ ও আলেমদের সাথে। দীর্ঘদিন পর গতকাল সিরাত আলোচনায় শ্রোতা হিসেবে গিয়েছিলাম রাইনখোলা জামে মসজিদে। অনেকদিন পর খতিব মহোদয়ের সাথে সাক্ষাত হওয়ায় খতিব মহোদয় সন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং মাঝে-মধ্যে যাওয়ার জন্য বললেন। যাবো ইনশা-আল্লাহ।
মাগরিবের পর কুরআন তেলাওয়াত এবং হামদ-নাত পেশের পর সিরাতের উপর আলোচনা করেন বরেণ্য আলেম ড. মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি এশা পর্যন্ত তাঁর আলোচনায় কুরআন ও হাদিস থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি পেশ করেন। এখানে তাঁর আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশা-আল্লাহ।
প্রথমেই তিনি মুহাম্মদ সা.-এর পরিচয় তুলে ধরেন। মুহাম্মদ সা. হলেন আল্লাহর রসুল এবং শেষ নবি, তারপর আর কোনো নবি বা রসুল নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার রসুল এবং নবিদের সিলমোহর (শেষনবি), আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে অবগত’- সুরা আহজাব ৪০। এখানে পুরুষের পিতা নয় বলা হয়েছে। কন্যা সন্তান ছাড়া তাঁর সকল পুত্র অতি শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। মানুষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল। তাঁর বাণী, ‘মুহাম্মদ একজন রসুল বৈ আর কেউ নন, তার পূর্বে অনেক রসুল গত হয়েছে। যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা উল্টা দিকে ফিরে যাবে? মনে রেখ, যারা ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না’- আলে ইমরান ১৪৪। তাই আনুগত্য ব্যক্তি মুহাম্মদ সা. নয়, তাঁর আনুগত্য হতে হবে রসুল হিসেবে এবং সেটি কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য।
দ্বিতীয়ত, মুহাম্মদ সা.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেন। পৃথিবীতে যতো নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান রয়েছে তার ওপর আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ রসুল সা.-কে পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘তিনি তাঁর আপন রসুলকে হেদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দীন বা ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁর দীনকে বিজয়ী করতে পারেন, মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন’- সুরা সফ ৯। এ ছাড়া সুরা তওবা ৩৩ ও ফাতাহ ২৮ একটু হেরফের করে একই কথা ব্যক্ত করেছেন। মুহাম্মদ সা.-এর সমগ্র জীবন এই লক্ষ্যেই অতিবাহিত হয়েছে। তিনি মানুষের কাছে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তাদেরকে সংগঠিত করেছেন ও পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সাথে সাথে তাদেরকে দীনের দাওয়াতে নিয়োজিত করেছেন। দীন কায়েমের এই প্রচেষ্টাকে তিনি সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার দান করেছেন। আল্লাহর দাবিও তাই। তাঁর বাণী, হে নবি! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাকো এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ করো- এসব যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে তোমাদের কাছে প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো, আল্লাহ ফাসেকদের কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না’- সুরা তওবা ২৪।
নবি-রসুলদের মৌলিক কাজ ছিল আল্লাহর জমিনে তাঁর দীন কায়েম করা এবং এই একটিই কারণে সকল নবি-রসুল নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু তাই নয় পরবর্তীকালেও যারা হকের ওপর চলতে গিয়েছেন তাঁরাও জেল-জুলুমের মুখোমুখি হয়েছেন। ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. শাসকের পক্ষে কাজির দায়িত্ব পালনে অপরাগতা প্রকাশ করলে তাঁকে কারারুদ্ধ হতে হয় এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ইমাম বুখারি রহ.-কেও শাসকের রোষানলে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। দীন কায়েমের পথ কখনই ফুল বিছানো ছিল না। এক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে দীনের দায়ীদের অগ্রসর হতে হয়েছে। বাতিলের জুলুম-নির্যাতনই প্রমাণ করে তারা নবি-রসুলদের দেখানো পথেই রয়েছে।
যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে তাদেরকে রসুলের সা. আদর্শে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হয়। আল্লাহর রসুল সা.-এর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর নেই। আর আল্লাহর ঘোষণাও এমনই, ‘তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রসুলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে- এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ও পরকালের (মুক্তির) আশা করে এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে’- সুরা আহযাব ২১। যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত এবং পরকালে জান্নাতের প্রত্যাশা করে তাদেরকে অবশ্যই রসুলুল্লাহ সা.-কে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে। মানার ক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য ক্ষমা করা হবে না। মদিনায় এক মুহাজির ও আনসার সাহাবির মাঝে ক্ষেতে পানি দেয়া নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। তারা নিজেরা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে পেশ করেন। রসুলুল্লাহ সা. ফায়সালা দেন যে, যার জমি নালার নিকটে সে আগে নেবে। এতে আনসার সাহাবি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলেন, রসুল সা.-এর আত্মীয় হওয়ার কারণে এমন ফায়সালা দান করেছেন। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আয়াত নাজিল হয়, ‘(হে নবি), তোমার মালিকের শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারবে না, যতোক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের ফয়সালায় তোমাকে (শর্তহীন) বিচারক মেনে নেবে, অতঃপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তাদের মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না এবং তোমার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে’- সুরা নেসা ৬৫।
ড. হাবিবুর রহমান বলেন, আজকের এই দিনে সিরাতুন্নবি সা. উপলক্ষে আলোচনা তখনই সার্থক হবে যখন আমরা আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে সক্ষম হবো। খতিব মহোদয়ের অনুরোধে তিনি এশার সালাতে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন।
সালাতুল এশার পর মসজিদের সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি শাহ আলম নূর তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনায় নবি মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর উম্মতকে শ্রেষ্ঠতম আখ্যায়িত করে বলেন, আল্লাহপাক স্বয়ং তাঁর নবি সা.-কে সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল ও আমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের কাজ হলো মানুষকে ভালো ও কল্যাণের দিকে ডাকা এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখা। ভালো কাজের প্রসার এবং মন্দ কাজ দূর হওয়া তখনই সম্ভব যখন আল্লাহর দীন সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দীন প্রতিষ্ঠা কাজে তিনি সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
খতিব মহোদয় রসুলের প্রতি ভালোবাসা শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে রসুল সা.-এর সুন্নাত পুরোপুরি অনুসরণের জন্য তাগিদ দেন। কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, রসুলের সা. অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন’- আলে ইমরান ৩১।
খতিব মহোদয় বলেন, বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ অপরিসীম। বান্দা যখন মন্দ কাজে ইচ্ছা পোষণ করে তখনই আল্লাহ গুনাহ দেন না; এমনকি অন্যায় করার পরও বান্দার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেন (তওবা)। পক্ষান্তরে ভালো কাজের নিয়ত করার সাথে সাথে বান্দার আমলনামায় সওয়াব লেখা হয় এবং ভালো কাজ করলে তার সওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। পাশে কোনো একজন ধুমপানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে তিনি বলেন, রসুল সা.-কে অনুসরণ অর্থ তিনি যা বলেছেন তা মানা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। তিনি তাঁর মুসল্লিদের মধ্যে কারো ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেয়ার এবং যাদের মুখে দাঁড়ি নেই তাদের দাঁড়ি রাখার নিয়ত করার জন্য অনুরোধ জানান। চমৎকার আয়োজনের জন্য তিনি মসজিদ কমিটি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ও সবার জন্য দোয়া করেন। ১০.১০.২০২২
Comments
Post a Comment