Skip to main content

আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই কুরবানির শিক্ষা

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

যশোর সরকারি এম এম কলেজ ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও আমার সহকর্মী প্রফেসর মো. হামিদুল ইসলাম স্যার আজকে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও বক্তা আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরীর (ওলীপুর, হবিগঞ্জ, সিলেট) কুরবানি সম্পর্কে বক্তৃতার একটি ভিডিও পাঠান। আমি সেই বক্তৃতাটি ফেসবুক বন্ধুদের সাথে একটু শেয়ার করছি।


খতিব মহোদয় বলেন, আমরা যে কুরবানি করছি তার ইতিহাস হজরত ইব্রাহিম (আ) ও পুত্র ইসমাইল (আ) থেকে। যখন কুরবানির ঘটনা ঘটে তখন ইব্রাহিম (আ)-এর একমাত্র সন্তান ছিলেন হজরত ইসমাইল (আ)। তাঁর পরবর্তী ছেলের জন্ম কুরবানির ঘটনার পরে। ঐতিহাসিক মতে সেসময়ে ইসমাইল (আ)-এর বয়স ছিল ১৪ বছর। এই বয়সে এবং একমাত্র ছেলে হওয়ায় ইসমাইল (আ) ছিলেন ইব্রাহিম (আ)-এর বড় আদরের। ছেলে নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন, কত ভাবনা। এমনি সময়ে ইসমাইল (আ)-কে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে জবেহ করার জন্য ইব্রাহিম (আ)-কে স্বপ্ন দেখান। প্রশ্ন উঠে, সরাসরি কুরবানি করার হুকুম না দিয়ে স্বপ্নে দেখালেন কেন?

আল্লাহ যদি সরাসরি বলতেন, তুমি তোমার ছেলেকে কুরবানি করো। কুরবানি করা অর্থ গলা কেটে দেয়া। কিন্তু তিনি সরাসরি না বলে স্বপ্নে দেখান যে জবেহ করার জন্য কাত করে শোয়ায়ে দিচ্ছেন, ছুরি চালাচ্ছেন। ইব্রাহিম (আ) ঠিকই বুঝেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে জবেহ করছেন বা গলা কাটছেন। কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য গলা কাটা নয়, তিনি দেখতে চান ইব্রাহিম (আ) কতখানি তাঁর আনুগত্য করতে প্রস্তুত।

নবিদের স্বপ্ন আল্লাহ দেখান এবং তা শতভাগ সত্য। শয়তান নবিদেরকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না। তিনি বলেন, স্বপ্ন তিন প্রকার- খেয়ালি, শয়তানি ও রহমানি। মানুষ যা কল্পনা করে বা আশেপাশে যা দেখে ঘুমের মাঝে সেটিই দেখে এবং এর নাম খেয়ালি। মানুষকে ভয় দেখানো বা গোমরাহ করার লক্ষ্যে যে স্বপ্ন তাকে শয়তানি স্বপ্ন বলে। যেমন, স্বপ্ন দেখালো, মাজারে মান্নত করলে তোমার ছেলের রোগ দূর হয়ে যাবে। এই স্বপ্ন দেখে গরু নিয়ে মাজারে গিয়ে জবেহ করে দিল। মোমিন ও সাধারণ মানুষকে স্বপ্নে আল্লাহপাক অনেকসময় নির্দেশনা ও সুসংবাদ দান করেন এবং এই স্বপ্নকে বলে রহমানি স্বপ্ন।

হজরত ইসমাইল (আ)-কে স্বপ্নের কথা এভাবে বলেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবেহ করছি। এখন বলো, তোমার অভিমত কী? জবাবে ছেলে ইসমাইল (আ) বলেন, আব্বাজান আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন (সুরা আছ ছাফফাত ১০২)।

জবেহ করার উদ্দেশ্যে যখন ইসমাইল (আ)-কে জবেহ স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শয়তান তিন জায়গায় বাধা দেয়ার চেষ্টা করে এবং সেসময়ে তিনি পাথর ছুঁড়ে শয়তানকে বিতাড়িত করেন। হজের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে আল্লাহপাক সেটি জারি রেখেছেন।

ইবরাহিম (আ) ছেলেকে জিজ্ঞাসা করার অর্থ এ নয় যে, তিনি ছেলের মতামত চাচ্ছেন। বরং তিনি আল্লাহর কাছে চেয়েছিলেন এক নেক সন্তান। সত্যিই ইসমাইল (আ) ছিলেন তাঁর নয়নশীতলকারী সন্তান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা দুজনই (পিতা-পুত্র) আত্মসমর্পণ করলো এবং সে তাকে (জবেহ করার উদ্দেশ্যে) কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য প্রমাণ করেছ, নিঃসন্দেহে আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরকার দিয়ে থাকি। এটা ছিল তাদের উভয়ের জন্য একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি ছেলের পরিবর্তে একটি বড় কুরবানির জন্তু তাকে দান করলাম। (অনাগত মানুষদের মাঝে এভাবেই) তাঁর স্মরণকে আমি অব্যাহত রেখে দিলাম (সুরা আছ ছাফফাত ১০৩-১০৮)।

পিতা-পুত্র উভয়ই আত্মসমর্পণ করলেন অর্থাৎ পিতা জবেহ করতে এবং ছেলে জবেহ হতে রাজি হয়ে গেলেন। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, এটি ছিল এক বড় ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহপাক তাঁর বান্দার মাঝে দেখতে চেয়েছেন আনুগত্য। পিতা-পুত্র তাতে শতভাগ সফল হয়েছেন। আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে এক জন্তু কুরবানির মাধ্যমে ইসমাইল (আ)-কে মুক্ত করে দেন এবং প্রতি বছর পশু কুরবানির মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত তাঁদের আত্মত্যাগের স্মরণ জারি করে দিলেন। এই কুরবানির মূল শিক্ষাই হলো আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেয়া। কুরবানির দিন আমরা ইব্রাহিম (আ)-এর আত্মত্যাগ স্মরণ করে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারি তবেই আমাদের পশু কুরবানি সার্থক হবে। আমরা সারা বছর আল্লাহর নাফরমানি করি, কুরবানির দিনেও যদি আমাদের মধ্যে উপলব্ধি আসে এবং ফিরে আসি তাহলে আশা করা যায় আল্লাহপাক অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। অন্যথায়, এ থেকে আমাদের কোনো প্রাপ্তি ঘটবে না। এই কুরবানি আমাদের এই শিক্ষাই প্রদান করে যে, আল্লাহর হুকুম পালনের ব্যাপারে একজন মুসলিম সামান্যতম অন্যথা করতে পারে না।

আল্লাহ ইসমাইল (আ)-এর রক্ত প্রবাহিত করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন, ইবরাহিম (আ) তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত কি না। ইব্রাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ) সফল হয়েছেন। আমরা তাঁর সন্তান হয়ে প্রতিকী পশু কুরবানির মাধ্যমে কোনো ধরনের দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই লাখ টাকার গরু কুরবানি দিচ্ছি। কুরবানি উপলক্ষে আমরা কি পারি না আমাদের পশুটা হালাল অর্থে খরিদ করতে বা একটু ত্যাগ স্বীকার করে হারাম উপার্জন পুরোপুরি পরিহার করতে তাহলে আল্লাহ আমাদের পেছনের গুনাহ ক্ষমা করে নতুনভাবে জীবনযাপনের তৌফিক দান করবেন ইনশা-আল্লাহ।

কুরবানি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া’- সুরা হজ ৩৭। আমরা পশু কুরবানি করি সেটির গোশত নিজেরা খাই, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির মাঝে বন্টন করি। কোনো কিছু আল্লাহ গ্রহণ করেন না। আল্লাহ দেখতে চান বান্দার তাকওয়া। তাকওয়া প্রসঙ্গে একদিন ওমর (রা) উবায়েদ ইবনে কাব (রা)-কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটাদার গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে পথ অতিক্রম করেছেন। হ্যাঁ, সেটি হলো- মানুষ খুবই সতর্কতার সাথে কাঁটাদার গাছ এড়িয়ে রাস্তা অতিক্রম করে। পৃথিবীটা কাঁটাদার গাছে ভর্তি, হাজারো হারাম পথ রয়েছে। এসব মাড়িযে খুবই সন্তর্পণে বেছে বেছে চলার নামই তাকওয়া এবং যে চলে সেই মুত্তাকি। দুনিয়াকে বাদ দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকওয়া দুনিয়ার পাপ-পঙ্কিল পথ মাড়িয়ে সত্য পথে চলায় সহায়তা করে। একজন মুত্তাকি ব্যক্তি মানে গুনাহমুক্ত মানুষ। কোনো অন্যায়, পাপাচর বা যে কাজে সামান্যতম গুনাহ রয়েছে মুত্তাকি ব্যক্তি সেটি এড়িয়ে চলে।

আমরা হাজারো গুনাহে যুক্ত এবং অনেক সময় গুনাহকে গুনাহ মনে করি না। তিনি কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পর্দাহীনতা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে এবং এটি যে গুনাহ তা অনেকেই মনে করে না। অপ্রয়োজনে ও বিলাসিতা করে অনেকে ছবি উঠান ও মোবাইলে সংরক্ষণ করে, এটিও গুনাহের কাজ সে উপলব্ধি নেই; মসজিদের অজুখানায় পানির অপচয়, অপ্রয়োজনে ফ্যানগুলো চালু রেখে অপচয় করা সবই গুনাহ, কিন্তু এগুলো আমরা হালকা করে দেখি।

একজন মুত্তাকি বান্দা কখনো কোনো গুনাহকে হালকা করে দেখে না। গুনাহ অর্থ আল্লাহর নাফরমানি। মুত্তাকি গুনাহমুক্ত বান্দা, সে সবধরনের নাফরমানি থেকে দূরে থাকে। কুরবানি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও গুনাহমুক্ত জীবনযাপনের তাগিদ দেয়। এটি যদি সম্ভব হয় তবেই এই কুরবানি আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হতে সহায়তা করবে এবং জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত করবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সত্যিকার মুসলিম হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। ০৯.০৭.২০২১।

Comments