বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
মাল্টিপ্ল্যান
রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত
ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ আজকের খুতবায় আল্লাহপাকের হামদ ও
রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার পর গত জুমার ধারাবাহিকতায় আজকেও সবর
নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কুরআন-হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতি পেশ করেন।
সবর অর্থ ধৈর্য ধারণ
করা, চুপ থাকা, বরদাশত করা, শক্তি-সাহস থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষমা
করা। এ প্রসঙ্গে তিনি রসুলুল্লাহ (সা) ও সাহাবায়ে কেরামের উদাহরণ তুলে ধরেন। ধৈর্য
ধারণ করা এবং মানুষকে ক্ষমা করার প্রশংসা করে আল্লাহ বলেছেন, এটি অত্যন্ত
সাহসিকতাপূর্ণ কাজ। তাঁর বাণী, ‘আর
যে ধৈর্য ধরে এবং ক্ষমা করে দেয়, এটা অবশ্য সাহসিকতাপূর্ণ কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত’- সুরা শূরা ৪৩।
আমাদের সমাজে প্রতিশোধ
গ্রহণে মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরে। একটি থাপ্পড়ের পরিবর্তে দশটি মারতে চায়, একটি কটূ
কথার পরিবর্তে দশটি কটূ কথা শোনাতে চায়। নিজে প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম না হলে
সন্তানদের বলে যায়। এসবের মধ্যে সে সাফল্য তালাশ করে, অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন
সাফল্য রয়েছে ধৈর্য ধারণের মধ্যে। তাঁর বাণী, ‘আমি আজ তাদেরকে তাদের ধৈর্যের পুরস্কার এই দিলাম যে, তারা সফলকাম
হয়েছে’- সুরা আল মোমেনুন ১১১।
আজকে পৃথিবী
হিংসা-বিদ্বেষে ভরে গেছে। প্রতিশোধ গ্রহণে মানুষ উন্মাদ হয়ে পড়েছে। চারিদিকে
হানাহানি ও জুলুম-নির্যাতনের মূলে রয়েছে প্রতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ততা ও ধৈর্যহীনতা।
মানুষ পরস্পরকে ক্ষমা করতে ভুলে গেছে। প্রতিশোধ গ্রহণে অক্ষম হলে লজ্জা অনুভব করে।
ধৈর্যের মতো মহৎ গুণের অনুপস্থিতিই সকল অশান্তির কারণ। আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী
বান্দাদের বিপদ-মুসিবত, জুলুম-নির্যাতনে কাতর না হয়ে ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে তাঁর
কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজ দ্বারা সাহায্য কামনা করো।
নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’- সুরা বাকারা-১৫৩। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন- এ উক্তি মোমিনের
জীবনে প্রশান্তি নিয়ে আসে।
দুনিয়ার জীবনে
সুখ-সাচ্ছন্দ নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। আখেরাতকে বাদ দিয়ে ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার
অর্থ-সম্পদ, কর্তৃত্ব লাভের আশায় মানুষ দুর্নীতি করে, মানুষের প্রতি
জুলুম-নির্যাতন করে; কিন্তু মানুষকে যা দেয়া হয়েছে তা পেয়ে যদি ধৈর্য ধারণ ও
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারতো তাহলে সে এ ধৈর্যের পুরস্কার অবশ্যম্ভাবী আল্লাহর
কাছে পেত। আল্লাহর বাণী, ‘যা
কিছু তোমাদের নিকট আছে, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর যা আল্লাহর নিকট আছে, তা চিরন্তন
থাকবে; আর যারা ধৈর্যধারণ করবে আমি অবশ্যই তাদের পুরস্কার প্রদান করবো তাদের ভালো
কাজের বিনিময়ে’- সুরা নাহল ৯৬।
আল্লাহপাক তাঁর
বান্দাদের বারবার ধৈর্য ধারণের তাগিদ দিয়েছেন। নামাজের চেয়েও অধিক সংখ্যকবার
ধৈর্যের কথা বলেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা ধৈর্যধারণ ভুলে গেছি। ধৈর্যহীনতার
কারণে আজ আর আমাদের গৃহ প্রশান্তির কেন্দ্র নয়, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রেও শান্তি
নেই। ধৈর্যের পুরস্কার হিসেবে দুনিয়াতে আমরা শান্তি ও আখেরাতে সুসংবাদ লাভ করতে
পারি। জনৈক সাহাবি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা) বলেন, এখন যে লোকটি মসজিদে উপস্থিত
হবে সে জান্নাতি। সেই সাহাবির আগমনে এমন উক্তি আল্লাহর রসুল (সা) পরপর তিন দিন
করলেন। একজন ব্যক্তি সম্পর্কে বারবার জান্নাতি বলার প্রেক্ষিতে একজন সাহাবির জানার
খুব আগ্রহ জাগলো, কী আমলের কারণে ঐ সাহাবি দুনিয়া থেকে বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত
হলেন। তাই তিনি তিন দিনের জন্য তাঁর মেহমান হলেন। সেই সাহাবির রাতের ইবাদত কেমন
তিনি তা খুব খেয়াল করলেন। কিন্তু তিনি কিছু দেখলেন না। কিছুটা হতাশ হয়ে তাঁকে
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রসুলুল্লাহ
(সা) আপনার সম্পর্কে একাধিকবার বলেছেন যে আপনি জান্নাতি। কী আমলের কারণে তিনি এমন
সুসংবাদ শোনালেন? জবাবে সাহাবি বললেন, ‘আমার বিশেষ কোনো আমল নেই, তবে প্রতি রাতে ঘুমানোর পূর্বে আমি
সবাইকে ক্ষমা করে দেই। কারো প্রতি আমার হিংসা-বিদ্বেষ নেই।’ তখন সাহাবি বুঝতে পারলেন, তিনি যথার্থই
জান্নাতি; এটি তাঁর ধৈর্য ও ক্ষমার পুরস্কার। ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছাড়া কেহ ক্ষমা
করতে পারে না। আল্লাহর বাণী,
‘আর তাদের ধৈর্যের বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত এবং
রেশমী পোশাক প্রদান করবেন। এমতাবস্থায় যে, তারা তার মধ্যে পালঙ্কের উপর হেলান দিয়ে
থাকবে, সেখানে তারা না উত্তাপ ভোগ করবে আর না শীত (বরং পরিবেশ হবে নাতিশীতোষ্ণ’- সুরা দাহর ১২-১৩।
খতিব মহোদয় সাহাবায়ে
কেরাম এবং তৎপরবর্তী সময়ের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরে বলেন, কোনো কিছুই আল্লাহর নেক
বান্দাদের উত্তেজিত করতে পারতো না। তিনি আব্বাসীয় এক শাসকের উদাহরণ দিয়ে বলেন,
তিনি ছিলেন একজন অতীব ধৈর্যশীল (হালিম)। একদিন এক লোক উত্তেজিত করার লক্ষ্যে তাঁকে
অনেক গালমন্দ করে এবং দেশের নাগরিক হিসেবে সে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। ধৈর্যধারণ
করে সব কথা শোনার পরে বাদশাহ লোকটিকে প্রচুর সহযোগিতা করেন। আর একদিন এসে আরো বাজে
কথাবার্তা বলে সে জানায় এ রাজ্যে থাকার মতো অবস্থা তার নেই। জবাবে শাসক বলেন,
তোমার সকল প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করবো এবং চলে যেতে চাইলেও সে ব্যাপারে সহযোগিতা
করবো। সে এসেছে তাঁকে উত্তেজিত করতে; তৃতীয় দিন সে তার মা সম্পর্কে বলে তুমি খারাপ
মায়ের সন্তান এবং তুমিও খারাপ। আমি আর তোমার রাজ্যে থাকবো না, চলে যাচ্ছি। এ কথায়
তিনি উত্তেজিত না হয়ে আরো অধিক পরিমাণ সহযোগিতা করেন। শেষে বিষয়টি তাঁকে অবহিত করে
বলে, আমি চেয়েছিলাম আপনাকে উত্তেজিত করতে, আমি বলছি আপনি ভালো মায়ের ভালো সন্তান।
শাসক তাকে প্রচুর সাহায্য-সামগ্রী দিয়ে বিদায় করেন।
খতিব মহোদয় বলেন, ধৈর্য
হলো উত্তম চরিত্রের সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। ধৈর্য ছাড়া কেউ উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে
পারে না। সদাচরণ উত্তম চরিত্রের অন্যতম গুণ। ধৈর্যশীল ছাড়া কেউ তার পরিবার,
আত্মীয়-স্বজন ও মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করতে পারে না। হারাম থেকে দূরে থেকে হালালে
সন্তুষ্টি এসবেরও মূলে রয়েছে ধৈর্য। আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম
ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম। এ প্রসঙ্গে তিনি হাদিস উল্লেখ করেন।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে
আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, নবি করিম (সা) এরশাদ করেন : ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোক হলো তারা, যাদের
চরিত্র তোমাদের সকলের চাইতে উত্তম’- বুখারি, মুসলিম।
আবু দারদা (রা) থেকে
বর্ণিত। নবি করিম (সা) বলেছেন : কেয়ামতের দিন ইমানদার বান্দার পাল্লায় উত্তম
চরিত্র অপেক্ষা ভারী জিনিস আর কিছুই হবে না; আর যে ব্যক্তি বেহুদা, অশ্লীল ও
নিকৃষ্ট ধরনের কথাবার্তা বলে, আল্লাহ তায়ালা তাকে মোটেই পছন্দ করেন না’- তিরমিজি।
হজরত আবু হুরায়রা (রা)
থেকে বর্ণিত। নবি করিম (সা) বলেছেন : ‘ইমানদারদের মধ্যে ইমানের দিক দিয়ে পূর্ণ ব্যক্তি সেই হতে পারে, যে
তাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সকলের চাইতে উত্তম’- আবু দাউদ।
নৈতিক চরিত্রের গুরুত্ব
বোঝাতে গিয়ে খতিব মহোদয় বলেন, ইসলামের সকল বিধি-বিধান গুরুত্বের দাবীদার; তন্মধ্যে
নৈতিক চরিত্র সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। উত্তম চরিত্রের অধিকারীরা নবি-রসুলদের
কাছাকাছি অবস্থান করেন। পার্থক্য তাঁরা নবুয়ত পাননি। নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের
লক্ষ্যেই মূলত নবি-রসুল প্রেরণ। ইমাম মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তাঁর কাছে এই খবর
পৌঁছেছে যে, নবি করিম (সা) এরশাদ করেন : ‘আমাকে নৈতিক চরিত্র মাহাত্ম্য পরিপূর্ণ করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই
প্রেরণ করা হয়েছে’-
মুয়াত্তা ইমাম মালিক।
তিনি বলেন, নামাজ,
রোজা, হজ, জাকাত, তাহাজ্জুদ সালাত আদায় সব পথই জান্নাতের দিকে গিয়েছে কিন্তু
সবক্ষেত্রেই জ্যাম রয়েছে। একটি পথই জ্যামমুক্ত সেটি হলো নৈতিক চরিত্র। যার নৈতিক
চরিত্র উত্তম সে সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ধৈর্য সর্বোত্তম গুণ এবং
ধৈর্যশীল ব্যক্তি জান্নাতে পৌঁছার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। আল্লাহর বাণী, ‘বরং নেক কাজ তো এটাই যে, কোনো ব্যক্তি ইমান রাখে
আল্লাহর প্রতি, কেয়ামত দিবসের প্রতি ....... আর যারা ধৈর্যধারণ করে অভাব অনটনে,
অসুখে-বিসুখে ও যুদ্ধ-জিহাদে। এরাই হচ্ছে সত্যবাদী, এরাই সত্যিকারের মুত্তাকি’ সুরা বাকারা-১৭৭। বেছে বেছে কিছু ইবাদত
অনুষ্ঠান নয় বরং মানব জীবনের কিছু মৌলিক গুণাবলীর কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবার, সমাজ ও
রাষ্ট্রে সবখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। খতিব মহোদয়
নসিহত হিসেবে বলেন, জনৈক মহিলা এক বুজর্গকে এসে জানালেন, তাদের সংসারে খুব অশান্তি।
সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি একটি তাবিজ চাইলেন। বুজর্গ বললেন, তোমার
স্বামী যখন ঘরে ফিরবে সেসময়ে মুখে পানি রেখে দিবে, কিন্তু স্বামী যেন সেটি না
জানে। তিন দিন পরে মহিলা এসে জানান, তাদের সংসারে আর ঝগড়া-ঝাটি বা অশান্তি নেই।
তারা এখন সুখে-শান্তিতে রয়েছেন। ধৈর্য অর্থাৎ চুপ থাকার গুণ তাদের অশান্তি দূর
করেছে। যাদের পরিবারে এধরনের সমস্যা রয়েছে, মুখে পানি পুরে রাখার এ আমল পরীক্ষা
করে দেখার জন্য তিনি আহবান জানান।
করোনাকালে এই কঠিন
লকডাউনে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ে সুযোগ লাভের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া
আদায় করেন। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং মাস্ক পরে ও জায়নামাজ হাতে নিয়ে
মসজিদে আসার জন্য তিনি তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।
Comments
Post a Comment