Skip to main content

আল্লাহপাক শিরকের অপরাধ কখনো ক্ষমা করবেন না

 জুমার খুতবা

২৩.০৭.২০২১

আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর ঈদোত্তর প্রথম জুমায় হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর ঘটনাবহুল জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন।

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত আমরা তাকবির পাঠ করবো। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মহানত্ব এবং তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই উচ্চস্বরে ঘোষণা করবো (মহিলারা অনুচ্চস্বরে পাঠ করবে)।

এটিই ইসলামের মূল এবং প্রাণ। সকল নবি-রসুলের দাওয়াত ছিল এক ও অভিন্ন এবং তা হলো কালিমা তাইয়্যেবাহ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাঁর চেয়ে বড় বা সমকক্ষ কেউ নেই; তিনিই সব। শিরকের মূলোৎপাটন ও তাওহিদের প্রতিষ্ঠাই ছিল নবি-রসুলদের মৌলিক কাজ। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আমি তোমার আগে এমন কোনো নবি পাঠাইনি যার কাছে ওহী পাঠিয়ে আমি একথা বলিনি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই এবং তোমরা সবাই আমারই ইবাদত করো’- আম্বিয়া ২৫। সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্য অর্থাৎ আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই কুরবানির শিক্ষা।

হজরত ইবরাহিম (আ) ও তাঁর পরিবার আল্লাহর আনুগত্যের চরম নিদর্শন দেখিয়ে দিয়ে বিশ্ববাসীর ইমাম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। সকল নবি-রসুলই মানুষকে কেবল আল্লাহকেই ভয় করে চলার কথা বলেছেন। তাঁর বাণী, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রসুল, অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো’- শুয়ারা ১২৫-১২৬।

হজরত ইবরাহিম (আ)-এর জন্ম হয়েছিল এক পৌত্তলিক পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন প্রধান পুরোহিত। জ্ঞান-বুদ্ধি লাভের পর থেকেই তিনি তাঁর জাতিকে মূর্তিপূজা করতে দেখেছেন। কিন্তু তাঁর বিবেক এগুলোর প্রতি কখনো সায় দেয়নি। একদিন তিনি তাঁর পিতা আজরকে বলেন, ‘তুমি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছ। আমি তো দেখছি, তুমি ও তোমার জাতি সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত’- সুরা আনআম ৭৪। তিনি তাঁর প্রকৃত রবকে তালাশ করতে গিয়ে প্রথমে আকাশের নক্ষত্রকে দেখে বলেন, এই আমার রব। সেটি অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর চন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, এই আমার রব। এরপর সূর্যকে যখন দীপ্তিমান দেখলেন তখন বলেন, এই আমার রব, এটি সবচেয়ে বড়। সেটি যখন ডুবে গেল তখন চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করো তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তো একনিষ্ঠভাবে নিজের মুখ সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি যিনি জমিন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং আমি কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’- সুরা আনআম ৭৬-৭৯।

উক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, কোনো সৃষ্টি রব বা উপাস্য হতে পারে না বা তার সম্মুখে বিনয়াবনত হওয়া যায় না বরং আসমান-জমিনসহ সবকিছুর যিনি স্রষ্টা ও মালিক তিনিই একমাত্র রব ও ইলাহ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার একমাত্র দাবীদার সেই মহান আল্লাহ। প্রসঙ্গক্রমে খতিব মহোদয় বলেন, শিখা চিরন্তন বা শিখা অনির্বাণকে ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ আমাদের ইমানের সাথে সাংঘর্ষিক। চিরন্তন সত্তা হলেন কেবল আল্লাহ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা ও প্রশংসা সবই তাঁর প্রাপ্য। এমন আচরণ শিরকের পর্যায়ভুক্ত এবং শিরকের গুনাহ আল্লাহ কখনই ক্ষমা করবেন না।

শিখা চিরন্তন বা শিখা অনির্বাণ অগ্নিপূজকদের প্রতীক। পারস্যের সহস্র বছরের প্রজ্জলিত আগুন সেদিন নিভে গেল যেদিন আমাদের প্রিয়তম নবি (সা) জন্মগ্রহণ করলেন। খতিব মহোদয় হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে তাদেরই দলভুক্ত হবে। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ) ও আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ (সা)-এর মৌলিক কাজ ছিল শিরকের মূলোৎপাটন করে তাওহিদের প্রতিষ্ঠা। শিরক পরিহার করে চলার জন্য তিনি তাঁর মুসল্লিসহ সকলের প্রতি আহবান জানান।

মাতাপিতার প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহপাক সন্তানকে জোর তাগিদ দিয়েছেন। পিতামাতা যদি মুশরিকও হয় তবুও তাদের সাথে সন্তানকে সদাচরণ করতে হবে। পিতামাতা সন্তানের কাছে তাদের সকল প্রয়োজন পূরণ ও উত্তম আচরণ পাওয়ার হকদার। তবে তারা যদি ইসলাম মানার ক্ষেত্রে বাধা দেয় বা শিরক করতে বাধ্য করেন তাহলে তা কখনই মানা যাবে না। সাহাবি সাদ (রা)-এর ইমান আনার প্রেক্ষিতে তাঁর মা অসম্ভব অসন্তুষ্ট হন এবং এক পর্যায়ে বলেন, ইসলাম ত্যাগ না করলে তিনি কোনো খাদ্যখানা গ্রহণ করবেন না। সেই সাহাবিও তাঁর মাকে অসম্ভব ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তারপরও সাহাবি বলেন, মা মারা গেলেও সে ইসলাম ত্যাগ করতে পারবে না। শেষে মা সন্তানের কাছে নত হন। সুরা লুকমানে আল্লাহপাক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি পিতা-মাতার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা বলেছেন। তারপরও শিরকের ব্যাপারে আল্লাহপাক কোনো ছাড় দেননি এবং তিনি বলেছেন, ‘কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যাকে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনই মেনে নিয়ো না। দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচার করতে থাকো কিন্তু মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে। তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে- সুরা লুকমান ১৪-১৫।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু সাধু, গুরু, সন্যাসী, গোত্রপ্রধান মানুষকে বিভিন্ন মতবাদের দিকে আহবান জানিয়েছেন। ইসলামের বাইরে সকল মতবাদই মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে গেছে। কেউ বলেছে ভোগবাদেই শান্তি। আবার কেউ বলেছে বৈরাগ্যে মুক্তি। কেউ পূর্বপুরুষের সমাধি ও প্রতিমাকে পূজনীয় বানিয়েছে। আবার কেউ আকাশের চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রকে উপাস্য বানিয়েছে, আবার কেউ নিজেকেই খোদা দাবী করেছে। মানুষের মাঝে আবার কেউ বলেছে খোদা তিনজন। আবার কেউ বলেছে জনগণই ক্ষমতার উৎস। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। স্বাধীনভাবে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় জনগণই ক্ষমতার উৎস অর্থাৎ নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত মেনে নেয়া হবে- তাতে কোনো আপত্তি নেই বরং এটা ইসলামেরই মত। কোনো কিছু হালাল-হারাম ঘোষণার এখতিয়ার কেবল আল্লাহর। এক্ষেত্রে কারো কোনো অধিকার নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী-

‘তুমি বলো, এরপরও কি আমি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো মালিক সন্ধান করে বেড়াবো? অথচ তিনিই সবকিছুর রব; প্রতিটি ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য নিজেই দায়ী হবে এবং কেয়ামতের দিন কোনো বোঝা বহনকারী অন্য কোনো লোকের বোঝা বহন করবে না, অতপর তোমাদের সবাইকে তোমাদের মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তিনি তোমাদের সেসব কিছুই জানিয়ে দেবেন, যা নিয়ে (দুনিয়ার জীবনে) তোমরা মতবিরোধ করতে’- আনআম ১৬৪।

কোনো মতপার্থক্য করার সুযোগ নেই। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে রয়েছে কল্যাণ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতপ্রাপ্তি। খতিব মহোদয় কুরবানি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও সকল অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে ও রসুলুল্লাহ (সা)-এর আনুগত্য করে চলার জন্য তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।

Comments