Skip to main content

করোনা পরিস্থিতি : আমাদের করণীয়

 বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম


করোনা পরিস্থিতি : আমাদের করণীয়

করোনা পরিস্থিতি বিপদজনক হয়ে উঠেছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যু ১৬,১৮৯ (গতকাল ছিল সর্বোচ্চ ২১২, আজ ১৮৫) মোট শনাক্ত ১০,০৯,৩১৫ (গতকাল ছিল ১১,৩২৪ ও আজ ৮,৭৭২)। ভারতীয় ডেল্টার দ্বারা আমাদের মৃত্যু ও সংক্রমণের এই উর্ধগতি। আসলে করোনা ক্রমাগত তার রূপ পাল্টাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত। বিশ্বে মোট সংক্রমণ ১৮,৬৯,৫৮,৩৭৫ এবং মৃত্যু ৪০,৩৭,৬৬৬ জন। একেবারে শুরু থেকে আমি করোনা নিয়ে ভেবেছি এবং প্রচুর লিখেছি। আমি যা করেছি সবই আমার বিশ্বাসের জায়গা থেকে। এখনো প্রতিদিন করোনার আপডেট দিয়ে থাকি এবং সতর্ক করি।

করোনা শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন ঘরকেই মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিলাম এবং এক ঈদ ঘরেই আদায় করেছি। সেই সময় থেকে মাস্ক ব্যবহার শুরু করেছি এবং তা অব্যাহত রয়েছে। গ্রামে করোনা ছিল না, গত দুই মাসে করোনা দেখা দিয়েছে। তারপরও বাড়ি গেলে মাস্ক ছাড়া বের হয়নি এবং অনেক সময় দেখা গেছে গ্রামের মসজিদে মাস্কপরা আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার দৃষ্টিভঙ্গি, সরকারের যেকোনো নির্দেশনা তা যদি কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থি না হয় তাহলে দেশের নাগরিক হিসেবে তা মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। এছাড়া দেশে বিপর্যয় দেখা যাবে।

করোনার বিস্তৃতি রোধে সরকার একের পর এক লকডাউন ও কঠোর লকডাউন দিচ্ছে এবং সামনে ঈদ, এখন করণীয় নির্ধারণ সরকারের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। লকডাউন ও কঠোর লকডাউনের কার্যকারিতা আমরা দেখলাম। গত ঈদে ঘরমুখো মানুষের কষ্টকর ও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে ঢাকা ত্যাগ ও ফেরাও আমরা দেখেছি। মানুষের প্রয়োজন কোনো বাধা মানে না। লকডাউনে দরিদ্র মানুষের সীমাহীন কষ্ট আমরা যারা আর্থিকভাবে নিরাপদ তারা উপলব্ধি করতে পারছি না। হয়তো অনেকেই বলবেন, জীবনের চেয়ে মূল্যবান তো আর কিছু নয়। হ্যাঁ, এই কথাটি আসছে আমাদের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং করোনা থেকে সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজ জনগোষ্ঠী থেকে। সাধারণ ব্যবসায়ী, খামারি, শ্রমজীবী মানুষ, পরিবহন শ্রমিক- এরা একবাক্যে বলবে, ‘লকডাউন চাই না, আমাদের কাজ করে খাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক’।

ঈদের সাথে কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়, আমাদের অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দুই ঈদ আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন সেক্টর, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক সকলেই এর সুবিধাভোগী। দেশের সাধারণ মানুষের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম গণপরিবহন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে (দুই সিটে একজন) গণপরিবহনে চলাচল অনেকখানি নিরাপদ। আমি নিজে গণপরিবহনে চলাচল করি বিধায় লক্ষ করি সেখানে মাস্ক ছাড়া কেউ উঠতে পারে না। লকডাউনে মানুষ গণপরিবহণ ছাড়া ট্রাক বা মাইক্রোয় গাদাগাদি হয়ে যাতায়াত করেছে। দশ সিটের হায়েসে গেছে ১৩/১৪ জন। মানুষ পায়ে হেঁটে, ভ্যানে, অটো, নৌকা নানাভাবে যাতায়াত করেছে। মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। লকডাউন নয়, মাস্কব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের ওপর গুরুত্ব প্রদান দরকার বলে মনে করি।

মহামারি একটি জাতীয় দুর্যোগ। সরকারের একার পক্ষে এর মোকাবেলা সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সকল বিরোধী দল, পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্রসংগঠন, আলেম সমাজসহ সকলের সহযোগিতা নিয়ে এর ধ্বংসকারিতা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। আইন দিয়ে বা শক্তি প্রয়োগ না করে উদ্বুদ্ধকরণ (Motivation) খুবই কার্যকর ও ফলপ্রসু পন্থা হিসাবে বর্তমানে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশে পরস্পরে যে বৈরী অবস্থা ও হিংসা-বিদ্বেষ তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে উদ্বুদ্ধকরণে ধর্ম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন পরস্পরে বৈরীভাব দূর করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ খুবই কার্যকর হতে পারে। হিংসা-বিদ্বেষ কেবল কবিরা গুনাহ নয় বরং তা ব্যক্তির সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহপাক বিশেষ বিশেষ দিনক্ষণে (যেমন লাইলাতুল কদর) তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন, কিন্তু মুশরিক ও হিংসুককে নয়। হিংসুক আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত। সুরা ফালাকে তিনি তাঁর বান্দাদের হিংসুকের অনিষ্ট থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়া শিখিয়েছেন।

হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে তারাই পারে যারা উদার ও ক্ষমাশীল। আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার সহজতম উপায় হলো তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করা। হাদিসের ভাষাটা এমন, তুমি তোমার ভাইকে ক্ষমা করো তাহলে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তোমাকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহর বাণী, যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো। আল্লাহ নিজে উদার, তিনি তাঁর বান্দাদের মাঝে উদারতা ও প্রশস্ততা দেখতে চান। জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ ও তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান সরকারের পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত। এমন হলে এই করোনা আমাদের রাজনীতির অঙ্গনেও স্বস্তি এনে দিতে পারে।

করোনা প্রতিরোধে আলেম সমাজ ভালো ভূমিকা পালন করতে পারেন। ইতোপূর্বে জঙ্গী তৎপরতা মোকাবেলায় আলেম সমাজের ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো ব্যক্তির তার নিজের ও অপরের ক্ষতি করার কোনো অধিকার নেই। জনস্বার্থ বিঘ্ন হয় এমন সকল কার্যক্রম ও আচরণ কবিরা গুনাহ। যেহেতু করোনা ছোঁয়াছে রোগ, রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মহামারি আক্রান্ত এলাকায় তোমরা কেউ যাবে না, আবার আক্রান্ত এলাকা থেকে কেহ বের হবে না। উদ্দেশ্য, যাতে মহামারি ছড়িয়ে না পড়ে। আলেম সমাজ সহজেই মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

নানা কারণে আলেম-উলামাদের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় দুর্যোগ মুহূর্তে মান-অভিমান সব ভুলে দেশের স্বার্থে একাট্টা হয়ে কাজ করা দরকার। আলেমদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা এবং তারা জেল-জুলুমের শিকার। মামলা- মোকাদ্দমা প্রত্যাহার করে তাদের মুক্তি প্রদান ও তাদের সাথে সরকারের আলোচনা করা উচিত। এছাড়া গ্রামে গ্রামে দল-মত, শ্রেণি-পেশার সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় ভূমিকা নেয়া দরকার। হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেরিয়ে একটি উদার ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ আমরা চাই।

মানুষ আল্লাহপাকের সেরা ও প্রিয় সৃষ্টি। দুনিয়ার জীবনে সুখি ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য আল্লাহ বিধান দিয়েছেন এবং মৃত্যু পরবর্তী আখেরাতের জীবনে অনাবিল সুখ ও শান্তির জন্য সাজিয়ে রেখেছেন জান্নাত। কিন্তু মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন সতর্ক করার জন্য আল্লাহ বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন। ‘জলে-স্থলে যে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে তা মানুষের কৃতকর্মের দরুন। আল্লাহ চান তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে, যাতে তারা ফিরে আসে’- সুরা রুম ৪১। বান্দার ফিরে আসার ক্ষেত্রে আল্লাহর কত আকুতি। পিতা-মাতা সন্তানকে এবং শিক্ষক ছাত্রকে শাস্তি দেন, উদ্দেশ্য সন্তান বা ছাত্র ফিরে আসুক।

মানুষ আল্লাহর নিদর্শন উপলব্ধি করতে চায় না। কুরআন মজিদে অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসের ঘটনাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহ ছিল অত্যন্ত শক্তিমান। মশার কামড়ে নমরুদের মতো শক্তিমান শাসকের করুণ মৃত্যু, মুসা (আ)-এর নদী অতিক্রম করে যাওয়া এবং সেইপথেই ফেরাউনের সদলবলে ডুবে মরা আল্লাহপাকের নিদর্শন বৈ আর কিছু নয়।

গজবপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস পড়ে আমার কাছে অনুভূত হয়েছে, দুটি বড় বড় অপরাধে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। এক. নবিকে অমান্যসহ সীমাহীন জুলুম (নমরুদ, ফেরাউন ও শোয়াইব আ. এর জাতি), দুই. চরম অশ্লীলতা (লুত আ. এর জাতির সমকামিতা)। বর্তমান পৃথিবী সীমাহীন দুর্নীতি ও জুলুম-নির্যাতন এবং নগ্নতা-বেহায়াপনা ও অশ্লীলতায় ভরে গেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, তাদের সুউচ্চ বাড়িঘর ও সৈন্য-সামন্ত ছিল এবং এসব উন্নয়ন আল্লাহর আজাব থেকে তাদের রক্ষা করতে পারেনি।

আমরা যদি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখবো, চীনের উহান প্রদেশে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ করোনার সূচনা এবং আশেপাশের দরিদ্র দেশগুলো এড়িয়ে দূরবর্তী পরাশক্তি খ্যাত ইউরোপ-আমেরিকাকে একযোগে আঘাত হানে। এক অতি ক্ষুদ্র জীবাণুর কাছে তাদের জ্ঞান, ক্ষমতা, সম্পদ সবই পরাস্ত হয়, আনবিক বোমা কোনো কাজেই আসেনি। করোনা না আসলে এই পৃথিবী হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হত এবং ৪০ লক্ষাধিক নয় ৪০ কোটি আল্লাহর বান্দা হারিয়ে যেত।

আমরা একটি বিশ্বাসী জাতি। আল্লাহর চরম ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা গাফেল নই। আল্লাহরই বাণী, কোনো বিপদ কখনই আসে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান রাখে আল্লাহ তার দিলকে হেদায়াত দান করেন। আল্লাহ সবকিছু জানেন’ - সুরা তাগাবুন ১১। আমরা যদি আল্লাহর কাছে ফিরে আসি তাহলে তিনি আমাদের ওপর থেকে বিপদ হটিয়ে দিবেন। তাঁর বাণী, ‘তুমিই যখন তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলে তখন আল্লাহ তাদের আজাব নাজিল করতে চাচ্ছিলেন না। আর এটা আল্লাহর রীতি নয় যে, লোকেরা ক্ষমা চাইতে থাকবে এবং তিনি তাদেরকে আজাব দেবেন’- সুরা আনফাল ৩৩।

আল্লাহর প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে আমরা আমাদের সাধ্যমত সবধরনের সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি আল্লাহর ওপর নির্ভর করবো এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করবো। আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও ক্ষমা প্রার্থনার ফলে ইনশা-আল্লাহ করোনা থেকে তিনি আমাদের হেফাজত করবেন। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি রহম করুন। ১০.০৭.২০২১

Comments