একজন ব্যক্তির ইমান আনার পরে সর্বপ্রথম কর্তব্য হয় আল্লাহর স্মরণে নামাজ আদায় করা। আল্লাহপাক প্রভু (মনিব) এবং মানুষ তাঁর গোলাম- এই স্বীকৃতির প্রকাশ পায় নামাজের মাধ্যমে। নামাজ ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ। রোজা বছরে এক মাস। অতি বৃদ্ধ হলে ফিদিয়া দিয়ে ছাড় রয়েছে। জাকাত কেবল ধনীদের (সাহেবে নেসাব যারা) এবং হজ জীবনে একবার মাত্র (ধনীদের জন্য)। কিন্তু নামাজ ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ সবার জন্য। দাঁড়িয়ে পড়তে না পারলে বসে, বসে না পারলে শুয়ে, শুয়ে না পারলে ইশারায় এবং যুদ্ধের ময়দানে বা পানিতে পড়ে গেলে অর্থাৎ চেতনা থাকা পর্যন্ত নামাজ বাধ্যতামূলক, কোনো ছাড় নেই। নামাজ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার স্মরণে তোমরা নামাজ কায়েম করো’- সুরা ত্বহা ১৪।
একজন বিশ্বাসী ব্যক্তির
ঘুম ভাঙ্গে আল্লাহু আকবরের সাথে হাই আলাচ্ছলা, হাই আলাল ফালা ডাক শুনে। আল্লাহর
বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে যার মধ্যে চেতনা আছে সে ছুটে চলে মসজিদ পানে। বড়
বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে স্বীকার করে ‘আমরা তোমারই গোলামী করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই’। প্রতি রাকাতে বারবার ও দৈনিক কমপক্ষে পাঁচবার
এই প্রতিশ্রুতি প্রদান। মানুষ কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আজান শুনে সে সম্বিত ফিরে
পায়, সে যে আল্লাহর গোলাম এবং এই গোলামির বাইরে তার কোনো জীবন নেই। এজন্যই নামাজকে
বলা হয়েছে জিকির।
যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে
দিল সে আল্লাহর গোলামির বাইরে চলে গেল। সে নিজেকে আর মুসলিম দাবী করতে পারে না।
আল্লাহপাক তাঁর কিতাবে সেটিই উল্লেখ করেছেন, নামাজ ছেড়ে দেয়া ব্যক্তি তার রবের
অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ এবং পরকালে অবিশ্বাসী। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা সাহায্য চাও সবর ও সালাতের মাধ্যমে।
কিন্তু এটা বড়ই কঠিন কাজ; তবে তাদের জন্য (কঠিন) নয়, যারা আল্লাহর প্রতি
বিনীত-অনুগত, যারা বিশ্বাস করে যে তাদের প্রভুর সাথে অবশ্যই মোলাকাত (সাক্ষাত) হবে
এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবে’-
সুরা বাকারা ৪৫-৪৬।
একজন ব্যক্তির
জাহান্নামে যাওয়ার জন্য নামাজ না পড়াটাই যথেষ্ট। আল্লাহর বাণী, ‘কোন্ জিনিস তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে আসলো? তারা
বলবে, ‘আমরা মুসল্লিদের মধ্যে শামিল ছিলাম না’- সুরা মুদ্দাস্সির ৪২-৪৩। আল্লাহর এ বাণী থেকে
নামাজের গুরুত্ব আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। ‘মুসল্লিদের মধ্যে শামিল ছিলাম না’- এ কথার মাধ্যমে জামায়াতে নামাজ আদায়কেই বোঝানো হয়েছে। আরো বলা
হয়েছে, ‘তোমরা সালাত আদায় করো, জাকাত আদায় করো এবং
রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’-
সুরা বাকারা ৪৩। রসুলুল্লাহ (সা) ও সাহাবিদের যুগে ওজর ছাড়া জামায়াত ছেড়ে দেয়া ছিল
অকল্পনীয়। সেসময়ে মুনাফিকরাও বাধ্য হত জামায়াতে হাজির হতে কিন্তু তারা ছিল নামাজে
অমনোযোগী এবং তাদের উদ্দেশ্যে ছিল লোক দেখানো। একথাটিই সুরা মাউনে এভাবে বলা
হয়েছে, ‘ধ্বংস তাদের জন্য যারা নামাজে অবহেলা করে ও লোক
দেখানো কাজ করে’।
আখেরাতে প্রথম বিচার
হবে নামাজের। নামাজ ত্যাগকারী দুনিয়া, কবর ও আখেরাত সর্বত্রই কঠিন অবস্থায় পতিত
হবে। কবর তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়বে ও আগুনে ভর্তি থাকবে। আখেরাতে কঠোরভাবে হিসাব
গ্রহণ করা হবে, আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হবেন এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা
হবে।
আল কুরআনে অধিকাংশ
জায়গায় নামাজ ও জাকাত একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে (৮২ বার)। আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে
নামাজ আদায়ের সাথে কিছু মানুষ জাকাত দিতে অস্বীকার করে। এই অস্বীকারকারীদেরকে
মুরতাদ বিবেচনা করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নামাজ আদায় না করা
সেসময়ে কেউ ছিল না। ফলে রসুলুল্লাহ (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে বেনামাজীর
শাস্তি জানা যায় না। মুসলিম উম্মাহর ইজমা (ঐকমত্য) হলো, যারা ইচ্ছাকৃত নামাজ ছেড়ে
দিবে তারা কাফের।
জাবির (রা) থেকে
বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বান্দার ও কুফুরির মধ্যে পার্থক্য হলো সালাত
ত্যাগ করা। সহিহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ।
বুরাইদা (রা) থেকে
বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তাদের মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে, তাহলো ‘সালাত’। সুতরাং যেই সালাত ত্যাগ করলো সেই কুফুরি করলো। মুসনাদে আহমদ,
নাসায়ি, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর
ইবনে আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসুলুল্লাহ (সা) সালাতের বিষয় আলোচনা
করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : যে কেউ সালাতের হেফাজত করবে না, কেয়ামতের দিন তার
জন্যে কোনো আলো, প্রমাণ এবং মুক্তি সনদ থাকবে না। শুধু তাই নয়, বরং সেদিন সে
কারূণ, ফেরাউন, হামান এবং উবাই ইবনে খালফের সঙ্গী হবে। মুসনাদে আহমদ, তাবারানি,
ইবনে হিব্বান।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম
বলেছেন, যে ব্যক্তি সালাতের হেফাজত করে না অর্থাৎ সালাত ত্যাগ করে, এর পেছনে থাকে
অর্থ-সম্পদের ব্যস্ততা, রাজত্বের ব্যস্ততা, সরকারি কাজের ব্যস্ততা কিংবা
ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যস্ততা। সুতরাং যে তার অর্থ-সম্পদ (উপার্জন ও রক্ষায়)
ব্যস্ততায় সালাত ত্যাগ করে, সে কারূণের সাথি হবে। যে ব্যক্তি দেশ ও রাজত্ব
পরিচালনার ব্যস্ততায় সালাত ত্যাগ করে, সে হবে ফেরাউনের সাথি। যে ব্যক্তি সরকারি
কাজের ব্যস্ততায় সালাত ত্যাগ করে, সে হবে হামানের সাথি। আর যে ব্যক্তি
ব্যবসা-বাণিজ্য (এবং চাকরি বাকরির) ব্যস্ততায় সালাত ত্যাগ করে, সে হবে উবাই ইবনে
খালফের সাথি।
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা),
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ, আবু দারদা (রা) প্রমুখের মতে, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায়
নামাজ ত্যাগ করে নামাজের পুরো সময়টা যদি পার করে দেয়, সে কাফের। ইসলামের সোনালী
যুগে (রসুলুল্লাহ সা. ও খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগ) মুসলিম দাবীদার একজনও ছিল না যে
নিয়মিত সালাত আদায়কারী নয় এবং সালাত আদায়কারী অর্থ জামায়াতের সাথে আদায়কারী। বিনা
কারণে জামায়াত ত্যাগ করার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে মুনাফিকরাও জামায়াতে শরীক হত।
জামায়াতে নামাজের ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস রয়েছে।
ইবনে ওমর (রা) থেকে
বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে, যতক্ষণ
না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর
রসুল, নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে। তারা এ কাজগুলো সম্পন্ন করলেই তাদের জান ও
মাল আমার দিক থেকে নিরাপদ হয়ে যাবে। কেবল ইসলামের অধিকারের জন্য ব্যতিত। আর তাদের
হিসাব গ্রহণ আল্লাহর দায়িত্বে। বুখারি ও মুসলিম।
ইসলামী রাষ্ট্রে নামাজ না পড়ার শাস্তি
প্রসঙ্গে ইমামদের মাঝে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ) বলেন, তারা তওবা না করলে জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখা হবে
যতক্ষণ না তওবা করে বা মৃত্যু হয়। অন্যান্য ইমামগণ (ইমাম মালেক রহ, ইমাম হাম্বলি
রহ ও ইমাম শাফেয়ী রহ) বলেন, বেনামাজীকে মুরতাদ হিসাবে ঘোষণা করে তাদেরকে তওবা করার
জন্য আহবান জানানো হবে। ফিরে না আসলে হত্যা করা হবে।
ফকিহদের মধ্যে অনেকের
মতে বেনামাজীর সাথে মুসলিম নারীর বিবাহ বৈধ নয়, উত্তরাধিকার হিসেবে পিতা-মাতার
সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে, জানাজার সালাত ও মুসলিম কবরস্থানে দাফন হবে না, মক্কা ও
হারাম এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। খুব কঠিন অবস্থা। অবশ্য ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হলে সকল
মুসলিম পরিবেশগত কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামাজী হয়ে যাবে। ঐ রকম কঠিন অবস্থার
সম্মুখীন আদৌ হতে হবে না।
যারা মুসলিম ঘরে
জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদের উচিৎ সময়ক্ষেপন না করে দ্রুত
তওবা করে নামাজ শুরু করা। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
বান্দা তওবা করলে পূর্বের গুনাহের জন্য আর শাস্তিযোগ্য থাকে না।
আমরা প্রতিমুহূর্ত
মৃত্যুর মুখোমুখি, জানি না কখন ডাক আসে। আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সর্বক্ষণ
প্রস্তুত থাকা দরকার। নামাজের মতো পু্ঁজি সাথে থাকলে মহান রবের ক্ষমা আশা করা যায়।
নামাজের বিষয়ে পরিবার
থেকে তালিম দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালার দির্দেশ, তোমার পরিবার-পরিজনকে নামাজের
নির্দেশ দাও এবং তাতে দৃঢ়পদ থাক’-
সুরা ত্বহা।
সারবা ইবনু মাবাদ (রা)
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন : তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিকে
সাত বছর বয়সে সালাত কায়েমের আদেশ দেবে। যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হবে তখন
সালাতের জন্য মৃদু প্রহার করবে। জামে তিরমিজি হাদিস ৩৮২।
আল্লাহপাক আমাদেরকে
নিজেদের নামাজের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং সন্তান-সন্ততিকে
নামাজী হিসেবে কবুল করার মধ্য দিয়ে চোখের শীতলতা দান করুন। ০১.০৭.২০২১
Comments
Post a Comment