Skip to main content

আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণই কুরবানির উদ্দেশ্য

 বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম


জুমা বক্তৃতা
১৬.০৭.২০২১

কাঁটাবন জামে মসজিদের সম্মানিত খতিব অধ্যাপক মাওলানা রফিকুর রহমান মাদানি আল্লাহর হামদ ও রসুলল্লাহ (সা)-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ শেষে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত ও কুরবানি উপলক্ষে আলোচনা করেন।

জিলহজ মাসের প্রথম দশকের বেশ ক'দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। কুরআন ও হাদিসে এই ক'টা দিন সম্পর্কে অনেক ফজিলতের কথা উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে দশ রাতের (সুরা ফজর) কসম প্রসঙ্গে মুফাস্সিরদের মাঝে অনেকে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের কথা বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয় আর কোনো সময়ের নেক আমল নেই। এমন কি সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছেন, জিহাদও কি আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়। জবাবে রসুলল্লাহ (সা) বলেছেন, জিহাদও নয়, তবে কেউ যদি মাল-সামান ও নিজের জীবন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কিছুই আর ফিরে না আসে তার কথা স্বতন্ত্র।

আর একটি হাদিস উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, রসুলল্লাহ (সা) বলেছেন, এর প্রতিটি দিনের নেক আমলের সওয়াব এক বছরের সমান এবং প্রতি রাত লাইলাতুল কদরের মতো। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন, আরাফার দিনের রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা বিগত বছরের ও আগামী বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। আগামী বছরের গুনাহ ক্ষমা করার অর্থ গুনাহ থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করেন।

এখানে রসুলল্লাহ (সা) ৯ জিলহজ বলেননি, বলেছেন আরাফার দিন। তাই তিনি তাঁর মুসল্লিদের ৮ ও ৯ জিলহজ সোম ও মঙ্গলবার রোজা রাখার জন্য আহবান জানান। আর যারা পুরো নয়দিন রাখতে পারেন তারা বড়ই সৌভাগ্যবান। কারণ রসুলল্লাহ (সা) ও সাহাবায়ে কেরাম নয়দিন রোজা রাখতেন।

আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য এসব বোনাস। দ্রব্য বা সেবা ক্রয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানাবিধ অফার ঘোষণা করা হয়। আল্লাহর বান্দাদের জন্যও তাঁর পক্ষ থেকে অফার যাতে মানুষ বেশি বেশি নেক আমল করে নেকির পাল্লাকে ভারি করতে পারে। নেক আমল বলতে তিনি নামাজ, রোজা, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ তাহলিল বেশি বেশি আদায় করার কথা বলেন।

জিলহজ মাস শুরু হলে রসুলল্লাহ (সা) ও সাহাবায়ে কেরাম বেশি বেশি তাকবির পাঠ করতেন (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)। আবু হুরায়রা (রা) বাজারে এসে উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করতেন এবং অন্যান্যরা তা শুনে তারাও পাঠ করতেন। এছাড়াও ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজ শেষে তাকবির পাঠের কথা তিনি স্মরণ করে দেন।

জিলহজ মাসের প্রথম দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো হজ ও কুরবানি। কুরবানি মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকে চলে আসছে। আদম (আ)-এর দুই ছেলে কুরবানি পেশ করেছিলেন। একজন মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে আল্লাহর দরবারে তা গৃহিত হয়। পক্ষান্তরে অপর ভাই অনাগ্রহ সহকারে নিকৃষ্ট জিনিস পেশ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। যার কুরবানি প্রত্যাখ্যাত হয় সে তার অপর ভাইকে হত্যা করার কথা বললে তিনি জবাবে বলেন, আমি আল্লাহকে ভয় পাই। আল্লাহর সেই নেক বান্দা বিতর্ক এড়িয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহপাক কেবল মুত্তাকিদের কুরবানিই কবুল করেন। বনি ইসরাইলদের কুরবানি করার নির্দেশ প্রদান করা হলে তারা নানা বিতর্ক সৃষ্টি করে। বিতর্ক সৃষ্টি আল্লাহর পছন্দ নয়।

খতিব মহোদয় কুরবানি প্রসঙ্গে বলেন, মাসালাগত বিতর্ক এড়িয়ে কুরবানি করতে হবে। ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা মর্যাদাগতভাবে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আল্লাহপাকের নির্দেশ, তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানি করো। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যার সামর্থ আছে সে যদি কুরবানি না করে, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে। রসুলুল্লাহ (সা) মদিনার দশ বছরের জীবনে প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন। তিনি তাঁর নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। আবার উম্মতের পক্ষ থেকেও কুরবানি করেছেন। ইবাদত হিসেবে আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ রয়েছে তাদের সবারই কুরবানি করা উচিৎ। যার সামর্থ রয়েছে সে উট কুরবানি করবে বা গরু কুরবানি করবে এবং যার সামর্থ কম সে ছাগল কুরবানি করবে। কুরবানি হতে হবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

কুরবানির অর্থ নৈকট্যলাভ, ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই নৈকট্য অর্জন সম্ভব। কুরবানি মূলত ইবরাহিম (আ) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ। আল্লাহর সকল নির্দেশ কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই তিনি পালন করেছেন। সর্বশেষ পরীক্ষা ছিল নিজ হাতে আপন সন্তানকে জবেহ করার নির্দেশ বাস্তবায়ন। পিতা যখন সন্তানকে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন, জবাবে পুত্র বলেন, আব্বাজান! আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। পিতা-পুত্র উভয়ই আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করেন অর্থাৎ মুসলিম হন। পিতা জবেহ করতে এবং সন্তান জবেহ হতে রাজি হয়েছেন। এটি ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে পুরুষ্কৃত করেন এবং তাঁকে জগতবাসীর ইমাম হিসাবে ঘোষণা করেন।

আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। কুরবানির মূল উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা। লক্ষ টাকার গরু কুরবানির মাধ্যমে ইব্রাহিম (আ)-এর আল্লাহর রাহে যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা যদি জাগ্রত না হয় তাহলে এ কুরবানি কেবল গোশত খাওয়ারই নামান্তর হবে। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের কুরবানিই কবুল করেন।

কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই প্রদান করেন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, কুরবানি (যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান), জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহরই জন্য। একজন মানুষ যদি অন্তর থেকে এ ঘোষণা প্রদান করে এবং অনুভব করে ইব্রাহিম (আ)-এর সেই ছেলে কুরবানির দৃশ্য তাহলে কী আর তার দ্বারা সম্ভব আল্লাহর কোনো নাফরমানি করা। মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করাই আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগির উদ্দেশ্য।

কুরবানির গোশতের ব্যাপারে আল্লাহপাকের নির্দেশনা হলো, নিজেরা খাও ও গরীব-দুঃস্থদের খাওয়াও। কুরবানির মাঝে রয়েছে ত্যাগ স্বীকারের এক প্রেরণা। তাই সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর অসহায় বান্দাদেরকে ঈদের আনন্দে শরীক করাতে হবে। কুরবানি আল্লাহর হুকুম। এখানে প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। কুরবানির বিনিময়ে দরিদ্রদের অর্থদান বা অন্য কিছুর প্রশ্ন উঠানো একজন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। কুরবানির মাঝে কোনো অপচয় নেই। এই উৎসবের সাথে অজস্র মানুষের আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল হয়। গরীব মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন রয়েছে এর মাঝে। এই গরু-ছাগলগুলো পালন করে গরীব মানুষগুলো। আবার গোশতের একটি অংশ তাদের কাছে পৌঁছে। তারা হয়তো বছরের এই সময় ছাড়া গোশত খাওয়ার সুযোগ পায় না।

কুরবানির বিষয়ে কোনো প্ররোচনায় কর্ণপাত না করে আল্লাহর হুকুম জ্ঞান করে সন্তুষ্টচিত্তে পশু জবেহর মধ্য দিয়ে পিতা ইবরাহিম (আ)-এর পরম আত্মত্যাগ স্মরণ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ সঁপে দিতে হবে। একজন কুরবানিদাতা কুরবানির মধ্য দিয়ে নিজেকে একনিষ্ঠ মুসলিম হিসেবে অনুভব করতে পারে।

খতিব মহোদয় সাড়ে বারোটায় বক্তৃতা শুরু করেন এবং কুরআন হাদিসের প্রচুর উদ্ধৃতিসহ আলোচনা শেষে মিম্বরে স্বল্পসময়ের জন্য বসে ছানি খুতবা শুরু করেন। সেসময়ে তিনি আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহ, দেশের অগ্রগতি, করোনা থেকে হেফাজত, মুসল্লিদের সার্বিক কল্যাণ ও তাদের মরহুম পিতা-মাতার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন এবং মুসল্লিরা দোয়ার জবাবে আমিন, আমিন বলতে থাকেন। খুতবা শেষে একামতের মাধ্যমে নামাজ শুরু হয়। নামাজ শেষে আলাদা কোনো মোনাজাত হয় না।

Comments