দাম্পত্য জীবন সুখের হোক এটা সকলের চাওয়া। কিন্তু আদতে কী ঘটে এবং কেন ঘটে? সেসব বিষয়ের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করবো আমরা।
ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবী করে ইসলাম মূলত তাই। এজন্য ইসলামকে বলা হয় সহজ ও প্রকৃতির ধর্ম। নর ও নারীর প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক-প্রকৃতিগত (আল্লাহপ্রদত্ত) এবং পরস্পর একত্র হওয়ার মধ্যে রয়েছে প্রশান্তি।
পরস্পর একত্র হওয়াকে ইসলাম একটি শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছে এবং এটিকে বলগাহীন ছেড়ে দেয়নি। প্রকৃতিগতভাবে নারী কোমল ও দুর্বল। সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা ও নারীর নিরাপত্তার স্বার্থে দাম্পত্য জীবন যাপনের লক্ষ্যে ইসলাম বিবাহকে ফরজ করেছে এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন চাহিদা পূরণের সকল উপায়-উপকরণকে হারাম ঘোষণা করেছে।
ইসলামে যিনা-ব্যাভিচার ও ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম। শাস্তি হিসেবে অবিবাহিতদের প্রকাশ্যে ১০০ বেত্রাঘাত এবং বিবাহিতদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করা। এ শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক, যাতে সবাই উপলব্ধি করে পাপাচার থেকে দূরে থাকে।
পক্ষান্তরে বিবাহের মাধ্যমে বৈধতা দানের ফলে যে জীবন-যাপন তা তৃপ্তিদায়ক হওয়ার সাথে ইবাদত হিসেবে ঘোষিত এবং স্বামী-স্ত্রীর সকল আচরণের বিনিময়ে রয়েছে ছওয়াব। তাদের মাঝে হাসি-তামাশা, দৃষ্টি বিনিময়, একে অপরের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের লক্ষ্যে সকল আচরণের বিনিময়ে রয়েছে ছওয়াব।
ছাহাবায়ে কেরাম (রা) আল্লাহর রসূল (সা)-এর কাছে জানতে চেয়েছেন, ইয়া রসূলুল্লাহ (সা)! আমরা তো আমাদের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য স্বামী-স্ত্রী পরস্পর মিলিত হই, এতেও কি ছওয়াব? জবাবে রসূল (সা) বলেছেন, হ্যাঁ, তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রী না হয়ে ভিন্নভাবে পূরণ করতে তাহলে তো গুনাহ হত; তাই তোমরা যখন বৈধভাবে পূরণ করো তখন সেটি গুনাহের পরিবর্তে ছওয়াবে পরিণত হয়।
যিনা-ব্যাভিচার ও ধর্ষণ ইসলামে হারাম হওয়ার সাথে সাথে এর সকল উৎস হারাম ঘোষণা করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা (দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে মুহাররম ও গায়ের মুহাররম বলে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে), যৌন উদ্দীপক সকল কার্যক্রম (গান-বাজনা, সাহিত্য, নাটক-সিনেমা) সবই নিষিদ্ধ।
পর্দা ফরজ করা হয়েছে, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, গায়ের মুহাররম কারো সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে স্পষ্ট কথা বলা, অপরের গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণ ও সালাম প্রদান, স্বামী/স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কারো ঘরে প্রবেশ না করার কথা বলা হয়েছে। ঘর হলো নারীর উপযুক্ত ক্ষেত্র এবং বাইরে বের হওয়ার সময় পর্দা অবলম্বন ও সাজ-সজ্জা না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পর্দা কোনো সুন্নাত-মুস্তাহাব আমল নয়, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ। মুসলিম দাবীদার এমন কারো পক্ষে এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে নারীর সতর অত্যন্ত বিস্তৃত। মুখমন্ডল ছাড়া সারা শরীর সতরের অংশ। পর্দার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কারো মতে মুখমন্ডল ঢেকে রাখা অর্থাৎ নেকাব পরা পর্দার অংশ এবং কারো মতে মুখমন্ডল খোলা রেখেও ফরজ পর্দা পালন করা যায়।
আমরা বিতর্কে না গিয়ে বলবো যারা নেকাবসহ পর্দা করেন তারা অতি উত্তম এবং পর্দাহীনতার এই সয়লাবে যারা পরিপূর্ণভাবে সতর আবৃত করে পর্দা করেন তারাও প্রশংসারযোগ্য। আমরা উভয়কেই সাধুবাদ জানাই।
ইসলামে বড় আপত্তি রয়েছে একজন পুরুষ ও নারীর নিভৃতে একত্রিত হওয়াতে। হাদিসে বলা হয়েছে এক্ষেত্রে শয়তান হয় তৃতীয়জন।
অফিস-আদালতে অনেক কর্মকর্তার পিএস নারী, যেটি মোটেই ইসলাম অনুমোদন করে না; এসব ক্ষেত্রে নানা দুর্ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায় এবং অনেকের পারিবারিক জীবন তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারী-পুরুষের আলাদা কর্মক্ষেত্র ও আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া প্রয়োজন। একান্ত না হলে বড় কক্ষে নারী-পুরুষের সংখ্যা বেশি এবং সবারই পর্দা মেনে চলা উচিৎ।
মানব ইতিহাসের শুরু দাম্পত্য জীবন দিয়ে। আদম (আ)-কে সৃষ্টি করার পর তিনি বড় একাকীত্ব অনুভব করেন। তাঁর একাকীত্ব ঘুঁচানোর লক্ষ্যে আল্লাহপাক তাঁর থেকেই সৃষ্টি করেন মা হওয়া (আ)-কে। শুরু হয় তাঁদের দু’জনের পথচলা এবং লাভ করেন বিনোদনের সকল কিছু নিয়ে সৃষ্ট জান্নাতে ইচ্ছেমত চলার স্বাধীনতা। ছিল শুধু একটি নির্দিষ্ট গাছের নিকটে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা।
শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সেই নিষেধাজ্ঞা পালনে তাঁরা ব্যর্থ হন এবং খুলে যায় শরীর থেকে সকল পোশাক-পরিচ্ছদ। মানুষের চিরশত্রু শয়তান চায় সমাজে নগ্নতা-অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে। অর্ধনগ্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরে যারা যুবসমাজকে ধর্ষণের দিকে প্রলুব্ধ করে তারা মূলত শয়তানেরই দোসর।
সমাজের মানুষের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে, মা হাওয়া বাবা আদমকে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণে প্ররোচিত করেছেন, এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। বরং কুরআন আদম (আ)-কে সম্বোধন করেই কথাবার্তা বলেছে। শাস্তিস্বরূপ তাঁদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে, এটিও ঠিক নয়।
দুনিয়ায় তাঁর খলিফা হিসেবে পাঠানোর লক্ষ্যেই আদম (আ)-এর সৃষ্টি। নিষিদ্ধ বৃক্ষের উল্লেখ স্রেফ পরীক্ষা এবং ভুল করার সাথে সাথে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার মধ্যমে আদম (আ) অপরাধ মুক্ত হয়ে পড়েন। ভুল করে ক্ষমা চাওয়া বাবা আদমের স্বভাব এবং আদম (আ)-কে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে এই মেসেজই দিয়েছেন যে, বান্দাহ ভুল করে/অপরাধ করে ক্ষমাপ্রার্থী হলে সে আর পূর্বে কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না।
পৃথিবীতে পাঠানোর ক্ষেত্রে একজনকে সিংহলে ও অপর জনকে হাওয়ায় দ্বীপে, এ কথার মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। বরং বিবেক-বুদ্ধি এটিই বলে, জ্ঞান-বুদ্ধি-যোগ্যতাসহ তাঁদেরকে নতুন সংসার জীবন-যাপনের উপযোগী ও আদম (আ)-কে নবুয়তি দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে এবং কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি বলে তাঁদেরকে জান্নাতেই ক্ষমা করা হয়েছে।
দাম্পত্য জীবন সুখের হোক করার জন্য যা প্রয়োজন আল্লাহপাক নারী-পুরুষের প্রকৃতিতেই তা দিয়ে রেখেছেন। ভিন্নতর পরিবেশের দু’জন নর ও নারীর অন্তরে পরস্পরের প্রতি দরদ-ভালোবাসা, এক অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার ও একে অপরকে অগ্রাধিকার দান সবই প্রকৃতিপ্রদত্ত (আল্লাহপ্রদত্ত)। শয়তানের ছোঁয়ায় প্রকৃতিবিরোধী হয়ে উঠায় সমাজে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা।
আল্লাহপাক নারী-পুরুষকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, মন-মানসিকতা ও পরস্পরের পরিপূরক করে সৃষ্টি করেছেন। নারীবাদীদের দাবী মোতাবেক নারী-পুরুষ সমান নয়; পরস্পরের পরিপূরক। একজন ছাড়া আর একজন অপূর্ণ। দুই-এ মিলে পূর্ণতা। আল্লাহর ভাষায়, ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী। এখানে কেউ কারো প্রভুও নয়, দাসও নয়। অবশ্য শৃঙ্খলা বিধানের জন্য পুরুষকে কর্তৃত্বশীল করা হয়েছে এবং ঈমানদার নারী স্বামীর অনুগত হয়ে থাকে।
দাম্পত্য জীবন সুখের হোক করার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি আস্থা, সুধারণা ও কল্যাণ কামনা এবং সন্দেহ-সংশয় থেকে দূরে থাকা, পরস্পরকে গোপন না করা। কুরআনে নর ও নারীকে পরস্পরের পরিচ্ছদ বলা হয়েছে। পরিচ্ছদ শরীরের সাথে লেগে থাকে আবার শরীরকে আবৃত করেও রাখে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো আড়াল নেই বা গোপনীয়তা নেই। যে কথা কাউকে বলা যায় না সেই কথা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা যায় এবং সেটি আমানত, তা কখনই প্রকাশ করা যায় না।
অনেকের কাছে শুনি, স্ত্রীর কাছে সঠিক কথা বলতে নেই অর্থাৎ সাত শত টাকায় শাড়ি ক্রয় করে বলে দেড় হাজার টাকা। এতে সাময়িক প্রতারিত করা যায়, কিন্তু তাতে লাভ নেই, সত্য এক সময় প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং তাতে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়। অবাধে সত্য বলার মত পরিবেশ সৃষ্টি করা উভয়েরই দায়িত্ব।
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে কাছে পেয়ে হবে তৃপ্ত, উৎফুল্ল। কিন্তু পরস্পরের দোষ-ত্রুটি তালাশ করা, সেটিকে বড় করে দেখা ও ঘ্যানর ঘ্যানর করা সম্পর্ক বিনষ্ট করে ও পরস্পরকে দূরে ঠেলে দেয়।
ডেল কার্নেগীর উক্তি, ‘গৃহজীবনে সুখি হতে চান? পরস্পরকে অবিশ্বাস করবেন না আর ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না’। এই ঘ্যানর ঘ্যানর স্বভাব এবং সর্বক্ষণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পরকে দূরে সরিয়ে দেয়। পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাওয়া-পাওয়া অভিন্ন হবে, এমনটি কখনই সম্ভব নয়। ভিন্নতাসহ পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ খুবই জরুরি। এই ঘ্যানর ঘ্যানর স্বভাব ও ছিদ্রান্বেষণ অনেক সময় স্বামী/স্ত্রীর সম্পর্কটা বিষিয়ে তুলে।
আমরা শেখ সাদী (রহ) ও লিও টলস্টয়কে জানি, জগতবিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক ছিল না। পৃথিবীতে যত আত্মহত্যা তার অন্যতম কারণ দাম্পত্য কলহ।
নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। সুখ ও দুঃখ মিলেই মানুষের জীবন। দাম্পত্য কলহ না হওয়া উত্তম এবং কলহ দেখা দিলে দ্রুত মিটিয়ে ফেলা দরকার। রসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনেও কলহ দেখা দিয়েছিল। তালাক হয়ে যাওয়ার মতো সন্দেহ অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল।
রসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি না বলেন। ইসলামে মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহ। স্বামী-স্ত্রী বা দু’জন মুসলিমের মাঝের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বে তৃতীয় জন মহিলার কাছে যদি বলে, আপু, ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল, তিনি আপনাকে খুব অনুভব করেন। আবার পুরুষটির কাছে গিয়ে বলে, আপনার জন্য আপু তো খুব পেরেশান। কী খান না খান সে চিন্তায় তো তার আহার-নিদ্রা সব বন্ধ। হয়তো বললো, তোর আপুকে বোঝায়ে বল চলে আসার জন্য। এ মিথ্যা মিথ্যা নয়। এটি ছওয়াবের।
মানবতার ধর্ম, ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম সব মানুষের শুধুই কল্যাণ চায়।
স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদাকে ইসলাম অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। স্ত্রীর মহরানা ও তার উপার্জনের ওপর তাকে কর্তৃত্ব দান করা হয়েছে। সে তার অর্থ সংসারে খরচ করতে বাধ্য নয়। সংসারে তার খরচ সদকা এবং সে প্রভূত ছওয়াবের অংশীদার হয়। আবার সংসারে কাজ করতেও সে বাধ্য নন।
সংসারে নারীর কাজটিকে খেদমত হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় এবং তাতে সে প্রভূত নেকির অধিকারী হয়।
হযরত আলী (রা) ও ফাতেমা (রা) ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। নিজ হাতে যাঁতা পিষতে গিয়ে ফাতিমা (রা)-এর হাতে ফোঁসকা পড়ে যায়। তিনি তাঁর পিতার নিকটে এসে একটি দাসী চান। রসূল (সা) দাসী না দিয়ে অধিক ছওয়াবের সুসংবাদ শোনাতে গিয়ে ফরজ নামায শেষে তেত্রিশবার ছোবহান আল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদু লিল্লাহ ও চৌত্রিশ বার আল্লাহু আকবার পড়তে বলেন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর কলিজার টুকরো মেয়েকে ঘর-সংসারের কাজ করার মর্যাদাও বুঝিয়ে দেন।
হযরত ওমর (রা)-এর স্ত্রী ছিলেন খুবই তেজস্বী। তিনি নিয়মিত নামাযের জামাতে উপস্থিত হতেন। ওমর (রা) চাইতেন ঘরে আদায় করতে, আবার স্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে নিষেধও করতে পারতেন না। তাঁর স্ত্রী বলতেন, তুমি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি যেতেই থাকবো। যেহেতু রসূল (সা) বলেন, আল্লাহর কোনো বান্দী মসজিদে আসতে চাইলে তাকে বাধা দিও না।
ওমর (রা) আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা)-এর হুকুম পালনে ছিলেন আপোষহীন। ফলে তিনি তাঁর পছন্দকে কখনই অগ্রাধিকার দিতে পারেননি।
জনৈক সাহাবী স্ত্রীর বিরুদ্ধে ঝগড়া-ঝাটি করার অভিযোগ নিয়ে খলিফা ওমর (রা)-এর নিকটে আসেন। আসার পর তিনি খলিফার ঘরে জোরে আওয়াজ শুনেন। উনি তখন ভাবেন, তাঁর চেয়ে খলিফা আরো বেশি অসহায়। তিনি ফিরে যেতে উদ্যত হন।
এমন সময়ে খলিফা বেরিয়ে এসে তার কাছে সাক্ষাতের কারণ জানতে চান। সাহাবীর অভিযোগ শোনার পর ওমর (রা) বলেন, দেখ, আমাদের স্ত্রীরা কত খেদমত করে থাকেন। সন্তানদের লালন-পালন, দুগ্ধপানসহ সংসারের যাবতীয় কার্য সম্পাদন করে থাকেন, তাদের একটু কটু কথা শুনতেই হয়।
তিনি বলেন, ধৈর্যধারণ ও মিলেমিশে চলার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। সংকীর্ণতা নয়, উদারতা ও প্রশস্ততার মধ্যেই রয়েছে দাম্পত্য জীবন সুখের হোক, শান্তি ও কল্যাণ।
কুরআন মজিদে আমাদের সম্মুখে কিছু দম্পতির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ছিল কলহ বিবাদ এবং একে অপর থেকে সম্পূর্ণ বিপরিত মেরুতে। হযরত লুত (আ) ছিলেন আল্লাহর একজন নবী অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নবী হিসেবে স্বামীকে অস্বীকারকারী।
অথচ আল্লাহর গজব আসার পূর্ব পর্যন্ত স্ত্রীকে সৎ পথে আনার ক্ষেত্রে নবীর (আ) প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ঠিক বিপরিত ফিরাউনের স্ত্রী আছিয়া ছিলেন তাঁর সময়ের নবী মুসা (আ)-এর অনুসারী একজন খাঁটি মুসলিম। তিনি তাঁর ঈমান গোপন রেখে একত্রে জীবনযাপন করেছেন। অবশেষে শাহাদত বরণ করেছেন। এতো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তাঁরা তাঁদের পারিবারিক জীবন যাপন করেছেন। নূহ (আ)-এর বিষয়টিও এমনই। তাঁকে নবী হিসেবে অস্বীকার করার পরও তিনি তাঁর ছেলেকে ত্যাগ করেননি। আসলে ত্যাগ করলে সংশোধনের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেব্যাপারে আল্লাহ তাঁর বান্দার মাঝে উদারতা দেখতে চান।
এ প্রসঙ্গে সূরা তাগাবুনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কতিপয় শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
এমন অনেক স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়েছে যারা তাদের স্বামী/পিতার হালাল রুজিতে সন্তুষ্ট নয়; আবার এমন কপালপোড়া স্বামীও আছে যারা স্ত্রীর পর্দায় চলা পছন্দ করে না। এদেরকে আল্লাহপাক শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
দাম্পত্য বা পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হোক এমনটি আল্লাহ চান না। বরং আল্লাহ চান স্বামী-স্ত্রী পরস্পর উদার, সহনশীল ও ক্ষমার নীতি অবলম্বন করুক। তার বিনিময়ে আল্লাহকেও ক্ষমাশীল ও দয়ার্দ পাবে।
নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক ও পারিবারিক জীবনটাকে সুখি, সুন্দর ও তৃপ্তিদায়ক করার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের সকলেরই আন্তরিক হওয়া দরকার। পরস্পর দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা অর্থাৎ সকলেরই ছাড় দেয়ার মনোবৃত্তি থাকতে হবে। অনমনীয় মনোভাব সংসারে সমস্যার সৃষ্টি করে।
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর সদাচরণ প্রসঙ্গে রসূল (সা) বলেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আল্লাহর হক পালনের সাথে সাথে স্ত্রীর ওপর স্বামীর সন্তুষ্টি প্রসঙ্গে রসূল (সা) বলেন, সেই স্ত্রী জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি প্রবেশ করতে পারবে।
আল্লাহপাক আমাদের পরিবারগুলোকে শান্তির নীড় করে দিক। সন্তান-সন্ততি দ্বারা তিনি আমাদের চোখকে শীতল করে দিন। আমিন। ১৩.১০.২০২০
Amin
ReplyDelete