Skip to main content

কুরআনের পাঠ (সূরা আহযাব ৩৬)

‘যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মু’মিন পুরুষ ও নারীর সেই ব্যাপার নিয়ে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়’- সূরা আহযাব ৩৬। সূরা আহযাবে তিনটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয় আহযাব (খন্দকের) যুদ্ধ, জিলকদ মাসে বনি কুরাইযার যুদ্ধ এবং একই মাসে আল্লাহর রসূল (সা)-এর সাথে হযরত যয়নব (রা)-এর বিয়ে। হযরত জয়নব (রা)-এর বিয়ের বিষয়টি পুরোটাই মহান আল্লাহপাকের ইংগিতে সম্পন্ন হয়। এই বিয়ে আয়োজনের পশ্চাতে লক্ষ্য ছিল দীর্ঘদিনের চলে আসা কুসংস্কারের মূলোৎপাটন। হযরত যায়িদ (রা) ছিলেন আল্লাহর রসূল (সা)-এর খরিদ ও আযাদকৃত গোলাম এবং তিনি তাঁকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালে পালক পুত্র/কন্যা নিজের ঔরসজাত/গর্ভজাত পুত্র/কন্যার মতো বিবেচিত হতো। বিয়ে-সাদী ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্র/কন্যা ও পালক পুত্র/কন্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। সে সময়ে মদীনায় উত্তরাধিকার আইন কার্যকরসহ নানা সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। বংশীয় আভিজাত্য, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারবের পার্থক্য দূর করে মানুষের মাঝে সমতাবিধানও ছিল এই ঘটনার অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ আদমের (আ) সন্তান ও পরস্পরের ভাই, শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে। ইসলামে বিয়ে-সাদীর ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য (কুফু) বিধান অস্বীকার করা না হলেও তাকওয়াকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে এবং তাতে ভবিষ্যৎ শুভ হবে বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত যয়নব (রা)-এর সাথে আযাদকৃত গোলাম হযরত যায়িদ (রা)-এর বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা)। যয়নব (রা) ছিলেন আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশের কন্যা এবং মুহাম্মদ (সা)-এর ফুফাতো বোন। এই প্রস্তাব পেয়ে যয়নব (রা) ও তাঁর পরিবার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তার প্রেক্ষিতে এই আয়াতটি নাযিল হয় এবং এই আয়াত নাযিলের ফলে যয়নব (রা) ও তাঁর পরিবার বিয়েতে সম্মত হন। আল্লাহর রসূল (সা) নিজে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন করান। পরবর্তীতে তাঁদের মাঝে বনিবনা হয় না। সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠলে হযরত যায়িদ (রা) যয়নাব (রা)-কে তালাক দেয়ার কথা আল্লাহর রসূল (সা)-কে জানান। রসূলুল্লাহ (সা) না করলেও তাঁদের পক্ষে একত্র থাকা সম্ভব না হওয়ায় যায়িদ (রা) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেন। সকল বৈধ কাজের মধ্যে তালাক অপছন্দনীয় হলেও ইসলামে সুযোগ রয়েছে। ইদ্দত পালন শেষে রসূল (সা) যয়নবের কাছে তাঁর নিজের বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। এখানে দু’টি সংস্কার এক সাথে করা হয়েছে। এক. বংশীয় আভিজাত্য শেষ করে দেয়া, দুই. পালক পুত্র ধারণার মূলে চিরতরে কুঠারাঘাত করা। মৌখিক বলা নয়, আল্লাহপাকের নির্দেশে নিজে আমল করে দেখিয়ে দিলেন পালক পুত্র প্রকৃত পুত্র নয় এবং তাকে তার পিতার নামেই পরিচিত করতে হবে। যায়িদ বিন মুহাম্মদ (রা) হয়ে গেলেন যায়িদ বিন হারিসা (রা)। আর কারো পিতৃপরিচয় জানা না থাকলে সে হবে দ্বীনি ভাই। কুরআন মজিদে সকল সাহাবী (রা)-এর মাঝে কেবল যায়িদ (রা)-এর নাম সরাসরি পরবর্তী আয়াতে উল্লেখের মাধ্যমে তাঁর উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতটি হযরত যায়িদ বিন হারিসা (রা) ও হযরত জয়নব (রা)-এর বিবাহ বিষয়ে অবতীর্ণ হলেও এটি ইসলামী আইনের মূলনীতি। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা) প্রদত্ত আইনের বিপরিতে কোনো ফয়সালা দানের এখতিয়ার কোনো মুসলিম শাসক, পার্লামেন্ট বা বিচারালয়ের নেই। ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং সব ধরনের লেনদেন ও কাজেকর্মে রসূলুল্লাহ (সা)-কে অনুসরণের বাধ্যবাধকতাই এখানে বলা হয়েছে। আল্লাহপাক তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে সাথে রসূল (সা)-এর আনুগত্য ফরজ করে দিয়েছেন। এখানে ধর্মীয়, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক কর্মকান্ডের কোনো বাছ-বিচার নেই। রসূল (সা)-এর আনুগত্যকে খন্ডিতভাবে গ্রহণেরও কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহপাক তাঁর নবীর (সা) ওপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তা পুরোটাই মানতে হবে। দ্বীনের আংশিক মানার ক্ষেত্রে আল্লাহপাক কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনো আর কিছু অংশের সাথে কুফুরি করো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কী হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে তারা লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখিরাতে তাদের কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড থেকে আল্লাহ বেখবর নন’-সূরা বাকারা ৮৫। আমরা নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকভাবে আল্লাহর রসূল (সা)-এর অনুসরণ করি এবং এই অনুসরণের ক্ষেত্রে সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলে পরস্পর ঝগড়া করি ও মারামারি করতে উদ্যত হই; অথচ জীবনের বৃহত্তম অংশে রসূলুল্লাহ (সা)-এর আনুগত্যের ব্যাপারে আমরা একবারেই বেখবর। আবার যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর রসূল (সা)-কে প্রেরণ করেছেন (তিনি তাঁর আপন রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীন বা ব্যবস্থাপনার ওপর তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারেন’) সে কাজে নিয়োজিতদের বিরোধীতা করে নিজে ধার্মিক সাজার চেষ্টা করি। এ আচরণ যে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর সাক্ষাত অনুসরণ সে উপলব্ধিও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আর একটি বিষয় বিবেচ্য, রসূল (সা) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উম্মতের কাছে দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইবাদত হিসেবে কোনো কিছু সংযোজনের সুযোগ নেই। রসূল্লাহ (সা) ইবাদত হিসেবে যা বলেছেন, করেছেন, অনুমোদন করেছেন এবং তাঁরা সাহাবায়ে কেরাম (রা) করেছেন সেটিই ইবাদত। এর অতিরিক্ত যা তা সবই বিদয়াত। বিদয়াত সবই ভ্রষ্টতা এবং তা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। বিদয়াত সেই জাল টাকা যা দেখতে চকচক করে কিন্তু সরকারের অনুমোদন না থাকায় জাল টাকার মালিকের স্থান হয় শ্রীঘরে। আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সা)-এর কথার ক্ষেত্রে একজন মুসলমানের উক্তি হবে ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’। কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই বা কোনো যুক্তি-বুদ্ধি খাটানোর অবকাশ নেই। শর্তহীনভাবে আল্লাহর রসূল (সা)-এর আনুগত্য করতে হবে। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল তাদের আনুগত্য করো। যদি তোমাদের মাঝে মতপার্থক্য হয় তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরে এসো’। রসূল (সা)-এর আনুগত্যের বাইরে আর কারো আনুগত্য নিঃশর্ত নয়, শর্তাধীন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (সা)-কে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়ে পূর্ণভাবে তাঁকে অনুসরণ এবং তাগুতের সাথে সকল সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ মেনে পূর্ণরূপে মুসলিম (অনুগত) হওয়ার তাওফিক আল্লাহ আমাদেরকে দান করুন। আমিন। ০১.১০.২০২০।

Comments