কুরআনের পাঠ
‘যে ব্যক্তি তার কাছে প্রকৃত হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং ঈমানদারদের পথ ছেড়ে অন্য ধরনের নিয়ম-নীতির অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ধাবিত করবো- যেদিকে সে ধাবিত হয়েছে, তাকে আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িবে দেবো, আর তা কতো নিকৃষ্ট আবাসস্থল’- সূরা আন্ নিসা ১১৫।
কুরআন মজিদ নাযিল হয়েছে বক্তৃতার আকারে। বক্তা একই সময়ে অনেক বিষয়ের অবতারণা করেন। এই সূরা আন্ নিসাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়াবলী সম্বলিত কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। তৃতীয় হিজরি থেকে চতুর্থ হিজরি শেষ বা পঞ্চম হিজরির শুরুর দিকে এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়। এই আয়াতে ইংগিত রয়েছে এক মুনাফিক ও ইহুদীর মামলা সংক্রান্ত বিষয়ের।
কোনো সূরা বা আয়াতে কোনো ঘটনার ইংগিত থাকলেও কুরআন মজিদ শ্বাশত, চিরন্তন এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা মানুষের জন্য হেদায়াত। তাফসির গ্রন্থ থেকে এতটুকু উপলব্ধি করা যায় যে একজন মুসলমান ও ইহুদীর মধ্যকার বিরোধের বিচার রসূল (সা)-এর কাছে আসে। ইহুদীটা সঠিক ছিল। বিষয়টি আল্লাহপাক রসূল (সা)-কে অবহিত করলে বিচার ইহুদীর অনুকূলে আসে। তাতে সেই মুসলিম ক্ষুব্ধ হয় এবং একপর্যায়ে মক্কায় ইসলামের শত্রুদের সাথে মিলিত হয়ে ইসলাম বিরোধীতায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে।
সমাজে ন্যায়-ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলাম আপোষহীন। এখানে পক্ষপাতিত্বের কোনো সুযোগ নেই, ইসলামে বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং বিচারকরা কখনই শাসকের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন না, তাঁদের জবাবদিহিতা ছিল মহান আল্লাহর কাছে। ইসলামে বিচারব্যবস্থা সাক্ষীনির্ভর। সত্য সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইসলামে শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ। সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং বাদী-বিবাদীর মধ্যে যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে বিচারকরা রায় দেন। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা) বলেছেন-
‘আমি তো একজন মানুষই। হতে পারে, তোমরা একটি মামলা আমার কাছে নিয়ে আসলে। এক্ষেত্রে দেখা গেলো, তোমাদের একপক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় অধিক বাকপটু এবং তার যুক্তি-প্রমাণ শুনে আমি তার পক্ষে রায় দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু জেনে রেখো, তোমার ভাইয়ের অধিকারভুক্ত কোনো জিনিস যদি তুমি এভাবে আমার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লাভ করো, তাহলে তুমি জাহান্নামের একটি টুকরো লাভ করলে’।
এখানে ঘটনার তেমন কোনো বর্ণনা নেই। তবে স্পষ্ট করা হয়েছে, আল্লাহপাক কাউকে রসূল হিসেবে প্রেরণ করলে সেই জাতি এবং শেষ নবী হলে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুগত্য আল্লাহপাক অপরিহার্য করে দেন। তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পোষণ ঈমানেরই পরিচায়ক এবং তাঁর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিরোধীতা কুফুরির নামান্তর। রসূলের বিরোধীতা অর্থ আল্লাহপাকের বিরোধীতা এবং তিনি তাকে সেই পথেই এগিয়ে দেন।
পথ এখানে দু’টি-এক ঈমানের পথ, দুই. কুফুরির পথ। কুরআনের ভাষায়, ‘যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, আর যারা কুফুরির পথ অবলম্বন করে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে (খোদাদ্রোহীতার পথ), তোমরা লড়াই করো শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের সাথে, বিশ্বাস করো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’-সূরা নেসা ৭৬। এখানে ঈমানদারদের পথ বলতে আল্লাহর রসূল (সা) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের (রা) পথ বোঝানো হয়েছে, যাঁরা দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন।
ঈমানদারদের পথ ছেড়ে অন্য ধরনের নিয়ম-নীতির অনুসরণকারী বলতে এখানে মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে। প্রকাশ্যে ইসলামের লেবাসধারী হলেও এরা মূলত ইসলামের অপ্রকাশ্য দুশমন এবং নামায-রোযার মতো ইবাদত অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে নিজেদেরকে আড়াল করে রাখতে চায়। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ভালো কিছু দেখলে এদের অন্তরে আনন্দ অনুভূত হয় না এবং দুঃখ-ব্যথায় ব্যথিতও হয় না। মুসলমানদের সমাজে চলাফেরা করলেও এদের সম্পর্ক থাকে কাফির, মুশরিক ও ইসলামের দুশমনদের সাথে।
শধু মানুষই নয় সকল সৃষ্টির প্রতি সদাচরণের তাগিদ দেয় ইসলাম। কিন্তু বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও অন্তরে মুহাব্বত সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহপাক বিভিন্নভাবে মু’মিনদের বোঝাতে চেয়েছেন, তাদের প্রকৃত বন্ধু হলেন আল্লাহ, আল্লাহর রসূল এবং সেই সব ঈমানদার লোক যারা নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। কাফির-মুশরিক এবং যারা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধীতা করে ও মু’মিনদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে তারা কখনই কোনো মু’মিনের বন্ধু হতে পারে না এবং যারাই তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারা নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নন। আমরা চিহ্নিত মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে জানি যে রসূল (সা)-এর পেছনে নামায আদায় করেছে ও আনুষ্ঠানিক সকল ইবাদত-অনুষ্ঠান পালনের পরও তার আন্তরিক বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা ছিল ইসলামের শত্রুদের সাথে।
মুনাফিকদের ধারণা, তাদের এই দ্বৈত নীতি কেউ টের পায় না, তাদের ধারণা সত্য হতেও পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কোনো কিছু গোপন নেই। আল্লাহপাক মুনাফিকদের ঐ পথটিকে তাদের জন্য শোভন করে দেন এবং তাদেরকে সেই পথে চলাটা সহজ করে দেন ও অগ্রসর করে দেন। কিন্তু তাদের শেষ পরিণতি জাহান্নাম।
ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং মানুষের হেদায়াতের (সুপথপ্রাপ্তি) জন্য এটিই যথেষ্ট। ইসলামের পথই ঈমানদারদের পথ। এর বাইরে যারা আর কিছু তালাশ করে তা সম্পূর্ণ গোমরাহীর পথ এবং কখনই তা গ্রহণ করা হবে না। আল্লাহপাক আমাদেরকে ইসলামের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। ০৪.১০.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment